অরুণ জেটলি বাজেটের অঙ্ক মিলাইতে শিখিয়াছেন, রাজনীতির অঙ্ক মেলানো অনেক বেশি কঠিন। বিচক্ষণ রাজনীতিক বিবেচনা করেন, কোন সিদ্ধান্তে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা। সেই সিদ্ধান্ত ঘোষণার আগে যথেষ্ট প্রস্তুতি আবশ্যক হয়, সিদ্ধান্তটিকে যথেষ্ট দক্ষ ভাবে পেশ করিতে হয়। তাহার পরেও বিতর্ক চলিতে পারে, কিন্তু জোরের সহিত সেই বিতর্কের মোকাবিলা করা যায়। প্রভিডেন্ট ফান্ড হইতে প্রাপ্ত অর্থের উপর কর আরোপের সিদ্ধান্তটি সেই গোত্রের। অথচ বাজেট বক্তৃতায় তো বটেই, অর্থ বিল-এর টীকাতেও এই কর প্রস্তাব পেশ করা হইয়াছে অর্ধপক্ব অবস্থায়, তদুপরি ধোঁয়াশার আস্তরণে। ফলে তুমুল শোরগোল উঠিয়াছে। চাপে পড়িয়া অর্থ মন্ত্রক হইতে যে সব ব্যাখ্যা ও আশ্বাসবাণী শোনানো হইতেছে, তাহাতে বিভ্রান্তি আরও বাড়িতেছে। অর্থমন্ত্রীর কাজ, এ বিষয়ে নীতিটি ঠিক কী, তাহার বিশদ ও প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা জনসমক্ষে পেশ করা, এবং অবিলম্বে। তাহা না হইলে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের উদ্যোগ অবিবেচনার কানাগলিতে পথ হারাইতে পারে।
পিএফ সংক্রান্ত কর-প্রস্তাবের খুঁটিনাটি লইয়া তর্ক থাকিতে পারে, কিন্তু তাহার অন্তর্নিহিত নীতি ও আদর্শ প্রশ্নাতীত। কেবল এই বাজেটের নয়, সাম্প্রতিক কালের বিভিন্ন বাজেটের বৃহত্তর প্রেক্ষিতেও রাজস্ব নীতির মৌলিক সংস্কারের প্রচেষ্টা হিসাবে প্রস্তাবটি অনন্য, ইহার তুল্য বিশেষ কিছু বাজেট বিবৃতিতে দেখা যায় নাই। মূল নীতিটি সহজ ও স্পষ্ট: আয় করিলে কর দিতে হইবে। একই আয়ের উপর যাহাতে দুই বার কর না চাপানো হয়, তাহা নিশ্চয়ই দেখা দরকার, সেই কারণেই পিএফ তহবিলে কেবল অর্জিত সুদের উপরেই কর ধার্য করিবার ‘সংশোধিত’ আয়োজন। এই নববিধানের পরিণামে করদাতাদের একটি অংশের সামগ্রিক আয় কমিবে, তাঁহাদের ব্যক্তিগত অসুবিধা এবং ক্ষোভ অযৌক্তিক নহে, কিন্তু সেই কারণে নীতিটিকে অযৌক্তিক বলা চলে না। বরং এত দিন এই ক্ষেত্রে কর রেহাইয়ের যে ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল, তাহাই নীতিগত ভাবে আপত্তিকর। সেই কারণেই প্রস্তাবিত করটি যথার্থ সংস্কারের পথে একটি পদক্ষেপ। সংস্কার সচরাচর কিছু নাগরিকের— এ ক্ষেত্রে ষাট হইতে সত্তর লক্ষ নাগরিকের— পক্ষে অসুবিধাজনক, সুতরাং অপ্রিয়। ভারতের জনসংখ্যা প্রায় একশো ত্রিশ কোটি। বৃহত্তর স্বার্থ কোনটি, তাহা বিচার করিতে জটিল অঙ্ক কষিবার প্রয়োজন নাই।
পিএফ বিতর্ককে উপলক্ষ করিয়া একটি গভীরতর প্রশ্ন উঠিয়া আসিয়াছে। প্রশ্নটি রাজস্ব আদায়ের আদর্শ সংক্রান্ত। এ দেশে অর্থনীতি ও সমাজে সরকারের ভূমিকা বিপুল, তাহার পিছনে রহিয়াছে সরকারের নিকট নাগরিকদের বিপুল প্রত্যাশা। ভারতীয় রাজনীতিকরা (‘ন্যূনতম সরকার’ স্লোগানের প্রচারক নরেন্দ্র মোদী সহ) রাষ্ট্রবাদী, তাহার কারণ ভারতীয় সমাজ মজ্জায় মজ্জায় রাষ্ট্রবাদী। অথচ এ দেশের নাগরিক সমাজে সরকারকে কর দিবার বিষয়ে ঘোর অনীহা। কর ফাঁকি তো আছেই, কর এড়াইবার রকমারি ফন্দিফিকির খুঁজিতে বহু সচ্ছল এবং সম্পন্ন নাগরিকেরই ক্লান্তি নাই, দ্বিধাও নাই। এ বিষয়ে সরকারি নীতিকাররাও সতত তৎপর থাকিয়াছেন। গৃহঋণ হইতে জীবনবিমা— বিবিধ ক্ষেত্রে সঞ্চয় করিলে কর ছাড়ের এলাহি বন্দোবস্ত মধ্যবিত্তকে সন্তুষ্ট রাখিয়াছে, কিন্তু একই সঙ্গে কর নামক বস্তুটির প্রতি সমাজের অনাগ্রহে ও বিরূপতায় ইন্ধন জোগাইয়াছে। দ্বিতীয় দফার ইউপিএ জমানা হইতেই কর ছাড়ের বন্দোবস্তগুলিকে ক্রমশ প্রত্যাহারের একটি চেষ্টা শুরু হইয়াছে, বর্তমান সরকার ও তাহার অর্থমন্ত্রী এ বিষয়ে কিছু নির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতিও দিয়াছেন। কিন্তু তাহা কার্যকর করিতে চাহিলে করদানের অনুকূল মানসিকতা তৈয়ারি করা জরুরি। সেই উদ্যোগ জনপ্রিয় হইতে পারে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy