Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

কাশ্মীরে নয়া বেণীসংহার পালা

যে দিন প্রাচীন চিনার বৃক্ষে-ঘেরা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে গিয়েছিলাম সে দিনও দেখা পেলাম এ রকম বেশ কয়েক জন মেয়ের।

শর্মিষ্ঠা দত্তগুপ্ত
শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

শ্রীনগরের লালচকে একটি বইয়ের দোকানে গিয়েছিলাম কাশ্মীরি কবিতা ও গানের সন্ধানে। এক কোণের গোল কফি-টেবিলে কিছু বই আমার জন্যে নামিয়ে রেখে আরাম করে বসতে বললেন বিপণির মহিলা ম্যানেজার। অল্পবয়সি দুটি হিজাব-পরিহিত মেয়ে একটু দূরে বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে আমার দিকে তাকাচ্ছিল। তাদেরই এক জন আলাপ করল এগিয়ে এসে। কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ে পলিটিকাল সায়েন্স নিয়ে পড়ে সে। ক্যাম্পাসের কাছেই ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে আরো তিন-চারটি মেয়ের সঙ্গে। ওর মুখেই জানলাম বারামুলা, ত্রাল, শোপিয়াঁ— নানা জায়গা থেকে এসে পড়াশোনা করছে এ রকম অনেক মেয়ে। আবার শহরে ঘর ভাড়া দিয়ে থাকবার মতো আর্থিক অবস্থা যাদের নয়, তারা প্রতিদিন ঘণ্টা দুই-চার বাস জার্নি করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসছে, এমনকী অনন্তনাগের মতো অশান্ততম জেলা থেকেও।

যে দিন প্রাচীন চিনার বৃক্ষে-ঘেরা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে গিয়েছিলাম সে দিনও দেখা পেলাম এ রকম বেশ কয়েক জন মেয়ের। বিক্ষুব্ধ কাশ্মীরের এই অসমসাহসী মেয়েদের কথা কলকাতায় বসে জানার উপায় বিশেষ নেই। ওখানকার কাগজ যে দিনপাঁচেক উলটেছিলাম, তাতে কিন্তু নানা পেশায় কর্মরতা মেয়েদের খবরও থাকত। ‘জম্মু ও কাশ্মীর ওয়ার্কিং উইমেন্স অ্যাসোসিয়েশান’-এর একটা সভার খবরে নড়েচড়ে বসলাম একদিন। ওই সভায় পুলিশ ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়েছে মেয়েরা। কারণটা চমকে দেওয়ার মতো! সেপ্টেম্বর মাস থেকে কাশ্মীরে রহস্যজনক ভাবে মেয়েদের বিনুনি খোয়া যাওয়ার ঘটনা ঘটে চলেছে একের পর এক। প্রথমে ঘটনাগুলো ঘটছিল গ্রামাঞ্চলে। তার পর শহরেও। মেয়েদের একা পেয়ে আততায়ীরা পেছন থেকে তাদের চেপে ধরে, কোনও ওষুধ স্প্রের মাধ্যমে অজ্ঞান করে তাদের চুল কেটে হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। এই রহস্যের কিনারা এখনও পর্যন্ত করতে পারেনি প্রশাসন। মেয়েরা তাই বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন।

এ বছর জুলাই-অগস্ট মাস নাগাদ উত্তর ভারতের চার-পাঁচটি রাজ্যে মেয়েদের বিনুনি কেটে নেওয়ার ৫০-৬০টি ঘটনা নথিভুক্ত হয়। যত দূর জেনেছি, ঘটনাগুলো মোটের ওপর রহস্যাবৃতই থেকে গেছে।

দিল্লি-হরিয়ানা-রাজস্থান আর কাশ্মীরের পরিস্থিতি এক নয়। সেনা-অধ্যুষিত বিক্ষুব্ধ কাশ্মীরে গ্রামকে গ্রাম চিরুনি তল্লাশি চালিয়ে আত্মগোপনকারী আজাদপন্থীদের যেখানে খুঁজে বের করতে পারা যায়, পুলিশ অতি দুর্গম অঞ্চল থেকেও পাথর-ছোড়া অপরাধীদের ধরে আনে, সেখানে মেয়েদের বেহুঁশ করে চুল কেটে নেওয়ার এতগুলো ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরও আক্রমণকারীরা অধরা!

আতঙ্কিত স্থানীয় মানুষ বহু জায়গায় ইতিমধ্যে রাত-পাহারা চালু করেছেন। যাঁরা চল্লিশোর্ধ্ব তাঁদের মনে আছে ৯০-এর দশকে এ রকম একটা আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল ‘স্টিল-ম্যান’-কে ঘিরে। ‘স্টিল-ম্যান’ নাকি মানুষের মুখ স্টিল দিয়ে আঁচড়ে দিত, বলছিলেন লেখিকা ও সমাজকর্মী ইসার বাতুল। অনেকে তখন বাড়ি-ঘর ছেড়ে চলে যায় এবং কিছু দিন পর ফিরে এসে দেখে প্রচুর লুটপাট হয়ে গেছে। তখনও নিয়মিত রাত-পাহারা দিয়ে, থালা-বাসন বাজিয়ে গোটা মহল্লা সজাগ থাকার চেষ্টা করত।

২০১৭-র চূড়ান্ত রাজনৈতিক সংঘাত কবলিত কাশ্মীরে নানা মানসিক চাপে এমনিতেই বিপর্যস্ত অধিকাংশ মানুষজন। সন্দেহজনক কাউকে দেখলেই পিটিয়ে মারা বা আটকে রাখা হচ্ছে, তিনি কাশ্মীরি বা বিদেশি পর্যটক যে-ই হোন না কেন! পরস্পরের প্রতি সন্দেহ ও অবিশ্বাসের বিষ চারিয়ে যাচ্ছে দ্রুত!

অজ্ঞাতপরিচয় আক্রমণকারীদের সন্ধান যারা দিতে পারবে তাদের জন্য পুলিশ-প্রশাসন এক দিকে পুরস্কার ঘোষণা করে জেলায় জেলায় হেল্পলাইন চালু করেছে, আবার অন্য দিকে পুলিশ ও ইনটেলিজেন্স-এর কর্তারা বলছেন যে অভিযোগকারিণীরা বেশির ভাগই মানসিক রোগী।

চিরকালই পুরুষতান্ত্রিক মনোরোগবিদদের একটা বড় অংশ মেয়েদের দাগিয়ে দিয়েছেন হিস্টিরিয়ার রোগী বলে। নিজেদের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণের কৌশল হিসেবে তারা নাকি মনগড়া ব্যথা-বেদনা/ অভিযোগ তৈরি করে! কিন্তু এ ক্ষেত্রে একটা উপদ্রুত অঞ্চলে এতজন মেয়ের অভিযোগকে পাগলামির লক্ষণ বলে চিহ্নিত করার মধ্যে একটা গভীর অশ্রদ্ধা প্রকাশ পাচ্ছে কাশ্মীরি মেয়েদের প্রতিদিনকার বেঁচে থাকার লড়াইয়ের প্রতি।

আমি যে দিন শ্রীনগর ছাড়ি তার আগের দিন দুপুরবেলা শহরের একটি পুরনো অঞ্চলের বাজারে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু গাড়ির চালক জানালেন সেখানে কার্ফু। কারণ বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠী কাশ্মীরি মেয়েদের এহেন অসম্মান বরদাস্ত করা হবে না জানিয়ে দিকে দিকে পথসভা ডাকছে।

গাড়ি ঘুরিয়ে শান্ত নিগিন লেক-এর হাউসবোটে ফেরার পথ ধরি। সেটাও সহজ হয় না অবশ্য। সে দিন যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় কাশ্মীরে ট্যুরিস্ট আকর্ষণে উদ্দেশ্যে আদনান সামির সংগীতানুষ্ঠান! তাই অনেক রাস্তা সাধারণ মানুষের জন্য বন্ধ। আমাদের গাড়িও আটকে দিল পুলিশ। মানুষকে এখানে হামেশাই কী পরিমাণ ভোগান্তির মধ্য দিয়ে যেতে হয়, ট্যুরিস্ট হয়েও সে দিন তার স্বাদ পেলাম!

আগের দিনই সন্ধেবেলা ডাল লেক-এ সূর্যাস্ত দেখে ফিরছি যখন, সামনে-চলা একটি সেনা-জিপ থেকে আমাদের ড্রাইভারের প্রতি ইঙ্গিত এল গাড়ির ভেতরের আলো জ্বালানোর। একটি অশান্ত অঞ্চলে নিরাপত্তার স্বার্থে এহেন সর্বব্যাপী সারভেলেন্সের মধ্যে কীভাবে কেশ কর্তনকারীরা এতগুলো ঘটনার পরও পার পেয়ে যাচ্ছে, ভেবে গা ছম ছম করে!

দিনকয়েকের ছুটিতে প্রায় পর্যটকশূন্য স্বর্গরাজ্যে প্রকৃতির নির্জনতা ও মানুষের উষ্ণ সান্নিধ্য উপভোগ করে, বেশ তারিয়ে তারিয়ে একটা ভ্রমণ কাহিনি লিখব ভাবছিলাম। কিন্তু হায়, নয়া বেণীসংহার পালার জন্য সে গুড়ে বালি! পাঞ্চালীদের বেণী সংহারে কে ভীম কে দুর্যোধন, সেটাই দেখার!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Kashmir Women bravery
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE