Advertisement
E-Paper

না কি, আমার চোখে ন্যাবা হয়েছে?

উন্নয়ন মানে, নীল সাদা-য় মোড়া শহর আর রাশি রাশি হাসি-মাখা অনুপ্রেরণা নয়, একটা সার্বিক ভাল থাকার বোধ, বুভুক্ষুর মতো যার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছি।আজ থেকে বছর আটেক আগে কলেজ ফেস্টের এক সন্ধেবেলা ফসিলস-এর লাইভ শো দেখছিলাম। ‘কেন করলে এ রকম’ গানটা শুনে মনে হচ্ছিল, যে মেয়েটা আমাকে গত সপ্তাহে রিজেক্ট করে দিয়েছে, তাকে ঠাস করে একটা থাপ্পড় মেরেই জাপটে ধরে চুমু খাই।

অম্লানকুসুম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৬ ০০:৪১
কীসের প্রত্যাশায়। ভোট চলছে। কলকাতা, ২১ এপ্রিল। ছবি: সুমন বল্লভ

কীসের প্রত্যাশায়। ভোট চলছে। কলকাতা, ২১ এপ্রিল। ছবি: সুমন বল্লভ

আজ থেকে বছর আটেক আগে কলেজ ফেস্টের এক সন্ধেবেলা ফসিলস-এর লাইভ শো দেখছিলাম। ‘কেন করলে এ রকম’ গানটা শুনে মনে হচ্ছিল, যে মেয়েটা আমাকে গত সপ্তাহে রিজেক্ট করে দিয়েছে, তাকে ঠাস করে একটা থাপ্পড় মেরেই জাপটে ধরে চুমু খাই। এই গানটা শুনলেই কেন যেন আমার না-হওয়া প্রেমগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। ইতিমধ্যে আরও আটটি বসন্ত পার করে ফেলেছি। গত কাল গানটা রেডিয়োতে আর এক বার শুনলাম। চোখ বুজলাম। স্বপ্নের কোনও ঘোর এসেছিল কি না কে জানে! কিন্তু কী আশ্চর্য, প্রেমিকার মুখের বদলে সেখানে দেখি বেশ কিছু বয়স্ক আর সেমি-বয়স্ক লোকের মুখ। তাঁরা সবাই দু’হাত ভরে টাকা পকেটস্থ করছেন। আরও দেখলাম, পুরো ঘটনাটাই ঘটে চলেছে একটা মঞ্চের উপরে আর দর্শকের আসনে বসা সমস্ত লোক তারস্বরে বার বার গেয়ে চলেছেন শুধু এই চারটি শব্দ: কেন করলে এ রকম, বলো। কেউ কেউ আবার গানের তোড়ে মাথা ঝাঁকাচ্ছেন, কিন্তু কাঁদছেন। মঞ্চের লোকরা কিন্তু হেসেই চলেছেন। স্বপ্নের সত্যিই কোনও মাথামুণ্ডু নেই!

কিছু কিছু স্বপ্নের ধরন অনেকটা শেষ হয়ে হইল না শেষ-এর মতো। অধিকাংশ স্বপ্নের কথাই তো সকালবেলা চোখ খুললে আর মনে থাকে না আমার। কিন্তু গ্রামোফোনের ট্র্যাক ব্যাক করার মতো টাকা নেওয়ার দৃশ্যটা চোখ খোলার পরেও জ্যান্ত সত্তায় কেন বার বার ঠোক্কর মেরে চলেছে! নারদ কাণ্ডের ভিডিয়োর সত্যি-মিথ্যে তো এখনও জানা যায়নি, কবে জানা যাবে তাও জানা নেই। কিন্তু যেটা দেখলাম, সেটা ভাবাচ্ছে কেন এত? এত চেনা স্বঘোষিত ‘সততার প্রতীক’-দের আগে প্রকাশ্যে এ ভাবে টাকা পকেটস্থ করতে দেখিনি বলে? না কি গুটিকয় যাঁদের উপরে সামান্য হলেও ভরসা ছিল, তাঁরা ভরসার জায়গাটা ভেঙে চুরমার করে দিলেন বলে? অবশ্য যাঁরা যাঁরা টাকা নিয়েছেন বলে দেখা গিয়েছে, তাঁদের মধ্যে কয়েক জন সেটি না নিলেই বেশি আশ্চর্য হতাম। একটু লুকনো ক্যামেরা চক্ষুকর্ণের মানভঞ্জন করে দিয়েছে, এই যা। যদিও সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরা এক জন ব্যক্তির কথা আলাদা করে বলতে ইচ্ছে করছে, যাঁকে এই ভিডিয়োয় দেখে সত্যিই তাজ্জব বনে গিয়েছি। এই ভিডিয়োটি, অন্তত তাঁর অংশটিও যদি জাল প্রমাণিত হয়, তা হলে খুশি হব।

ভোট বড় বালাই। জোট কোনও কোনও লোকের কাছে বহুদিন কিউমুলোনিম্বাস লেপ্টানো রাজনীতির আকাশে আশা-মাখা সূর্যোদয়ের মতো, কারও কারও অবশ্য এই জোটে কাঁচকলা হয়। মানুষের রায় জানতে এখনও অনেকটা সময় অপেক্ষা করতে হবে। আমরা সাধারণ মানুষ। চেয়ারে কে বসছেন, তার থেকে বেশি আশা থাকে এই চেয়ারটার থেকে। টিভি, রেডিয়ো খুললেই দেখা যাচ্ছে, শোনা যাচ্ছে, প্রতিটি রাজনৈতিক দলই অন্য দলের বিরুদ্ধে যুক্তির অস্ত্র শানাচ্ছে বিজ্ঞাপনে। কেউ শুধু ৩৪ বছরের কথা বলে, কেউ বা আবার ওই ৩৪-এর সঙ্গে আরও পাঁচ জুড়ে মোট ৩৯ বছরের অপশাসনের থেকে বাংলার মুক্তি চায়। শাসক দলটি তো হাল আমলের জনপ্রিয় শিল্পীদের নিয়ে গানই বেঁধে নিয়েছে। সেটি শুনলে অবশ্য সারা গায়ে বিছুটির জ্বালা নিয়েও ‘ফুলের উপর ঘুমিয়ে পড়ি ফুলের মধু খেয়ে’-র মতো আমেজ আসে।

বাংলার মানুষের সত্যিই বেশি প্রত্যাশা নেই, না কি ক্রমাগত আশাহত হতে হতে একটা অক্ষয় অমর নিরাশাকেই বিধির লিখন বলে মেনে নিয়েছি, জানা নেই। সেই কলেজজীবন থেকে শুনে আসছি ‘এখানে কিছু হবে না। যদি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাও, তা হলে ভিন রাজ্যে সেট্‌ল করো।’ সেটা করতে পারিনি। এর ফলে মূল্য দিতে হয়েছে, আজও হচ্ছে। দিল্লি, বেঙ্গালুরু, পুণে, হায়দরাবাদ থেকে ভেসে আসা বন্ধুদের ফেসবুক পোস্টে আমার থেকে, আমাদের থেকে অনেক ভাল থাকার আনন্দ-শিশির চুঁইয়ে পড়ে। আমি ক্যাবলার মতো লাইক মারি। যে কোনও সেক্টরই হোক, ওদের কাছে সুযোগ অফুরান। আজ এই কোম্পানি, কাল অন্য কোম্পানি। কিন্তু কথা বলে বুঝেছি, এই টো টো কোম্পানির মধ্যেও ওদের মধ্যে সিনেমার আবহসংগীতের মতো এটা করুণ এস্রাজও বেজে চলেছে। সেটা হল, এই শহর আর এই শহরে একা একা বেঁচে থাকা প্রিয়জনদের কাছে ফিরে আসার একটা ইচ্ছে। যে মাটিতে জন্ম নিই, সে মাটি তো রক্তেও মেশে। যে কোম্পানিগুলিকে শুধু কলকাতায় জমি দেওয়া হল না বলে কয়েক হাজার বাঙালি ছেলেমেয়েকে বাধ্য হয়ে চেন্নাই, হায়দরাবাদ বা কোয়েম্বত্তুরে দিন গুজরান করতে হচ্ছে, তাদের মনে তো এই না-হওয়া, এই না-পাওয়ার জন্য ক্ষোভ থাকবেই। ভাবতে অবাক লাগে। রাজ্যের বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে এখন পড়ানো হচ্ছে অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং। কিন্তু এ রাজ্যে কাজের সুযোগ শূন্য। যেখানে সুযোগ হতে পারত, সেখানে একটা দমবন্ধ করা শূন্যতা আজও হাহাকার করে। সম্প্রতি জানলাম, সেই বিখ্যাত এবং ‘অভিশপ্ত’ ন্যানো ছাড়াও গুজরাতের সানন্দের কারখানায় একেবারে নতুন প্ল্যাটফর্মে তৈরি হয়েছে আরও একটি গাড়ি: ‘টিয়াগো’। খবরটা পড়লে আনন্দ হয় না, বরং একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ইচ্ছে করে। আমাদের রাজ্যের জননেত্রী কথায় কথায় লক্ষ লক্ষ চাকরির প্রতিশ্রুতি দেন। আখেরে কর্মসংস্থানের গ্রাফটি বাড়ে অন্য রাজ্যগুলিতে। তেলেভাজা, আলুর চপ আর আচারকে ভিত্তি করে কোনও রাজ্য শিল্পের মানচিত্রে এগোতে পারে না, সেটি আমরা বুঝব কবে? আমি কোনও হরিদাস পাল নই। কিন্তু এ কথা তো বলছেন স্বয়ং অমর্ত্য সেনও। তাঁর উপদেশ আমরা উপেক্ষা করি কোন সাহসে?

সরকারে কে আসবেন, তা ঠিক করবেন বাংলার মানুষ। কিন্তু এক জন ভোটদাতা হিসেবে সবার মতো আমারও কিছু দাবি থাকতে পারে। সরকারে হাত জোড়াফুল পদ্ম কাস্তেহাতুড়িতারা, যাঁরাই আসুন না কেন, মুখে জলের ঝাপ্টা দিয়ে তাঁরা এ বারে অন্তত আমাদের রাজ্যটির দিকে নজর দিন। আমরা লন্ডন চাই না, কলকাতা সুন্দর হয়ে উঠুক কলকাতার মতো করে। যে চোখের তলায় কালি পড়েছে, সেটিকে ঢাকতে আরও বেশি করে সস্তার ফেস পাউডার না ঘষে, ভিতর থেকে তা সতেজ হয়ে ওঠার চেষ্টা করুক। সিন্ডিকেট রাজ নিপাত যাক, সেটি যে আমলেই জন্ম নিয়ে থাকুক না কেন। টেন্ডারে স্বচ্ছতা আসুক। সামনের বর্ষায় বারোটা বেজে গেলে পরের টেন্ডারটাও আমি পাব— এই হঠকারিতা নিয়ে রাস্তা মেরামতির কাজ করা বন্ধ হোক। অন্যের ঘাড়ে দায় চাপানোর অত্যন্ত কুরুচিকর অভ্যেসটাতেও অবিলম্বে দাঁড়ি টানা প্রয়োজন। আজ ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের একটি পিলারে ফাটল দেখা গেলে আমরা ব্রিটিশ স্থপতির ঘাড়ে দোষ চাপাতে পারি না। যাহা খারাপ তাহা বাম, কিন্তু যাহা সুন্দর তাহা শুধুমাত্র আমারই— এই মানসিকতা হাস্যকর নয়, মূর্খামি। লক্ষ লক্ষ চাকরি— ফ্লেক্সে না— বাস্তবের কঠিন মাটিতে হোক। এ রাজ্যের নতুন প্রজন্ম আর দুধেভাতে থাকতে চায় না, খেটে খেতে চায়। খাটার সুযোগটা করে দিন। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষদের কলারটা যে ইচ্ছে করলেই ধরা যায় না, সেটা তথাকথিত মস্তান পড়ুয়াদের চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া দরকার। ছোটবেলায় একটি কথা শুনেছিলাম— বড় হওয়া ভাল, ভাল হওয়া আরও বড়। কিছু নেতা-নেত্রীর সেটি বোঝার সময় সত্যিই এসে গিয়েছে।

বিশ্ববাংলার ‘ব’ মাখামাখি রাজারহাট-নিউটাউন কিংবা ই এম বাইপাসের ধার-ঘেঁষা সদ্য গজিয়ে ওঠা অসংখ্য পানশালায় নর্তকীদের চটুল নাচ দেখে হাজার টাকার বান্ডিল ওড়ানোটাকে উন্নয়ন বলে না। উন্নয়ন মানে, নীল সাদা-য় মোড়া শহর আর রাশি রাশি হাসি-মাখা অনুপ্রেরণা নয়, একটা সার্বিক ভাল থাকার বোধ, বুভুক্ষুর মতো যার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছি।

না কি, আমার চোখে ন্যাবা হয়েছে? কে জানে! কাজ নেই তো, তাই কুৎসা রটাচ্ছি।

development election
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy