Advertisement
E-Paper

কাকে বলে ‘পপুলিস্ট বাজেট’

বাজেটের আগে ‘পপুলিজম’ আর ‘পপুলিস্ট’, এই দুটো শব্দের ব্যবহার হঠাৎ করেই অনেকখানি বেড়ে যায়। নির্বাচনের আগের বাজেট হলে, আরও বাড়ে।

অমিতাভ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:১২
অরুণ জেটলি। —ফাইল চিত্র।

অরুণ জেটলি। —ফাইল চিত্র।

আশিস নন্দী আর প্রণব বর্ধন দ্রুত একমত হলেন, ‘পপুলিজম’-এর কোনও বাংলা প্রতিশব্দ নেই। আইসিসিআর-এ আশিসবাবুর ‘সমর সেন স্মারক বক্তৃতা’ শুরু হতে তখনও খানিক দেরি। ‘পপুলিজম’-এর বাংলা, দুই তাত্ত্বিকই বললেন, চলতি অনুবাদে খুব জোর দাঁড়ায় ‘সস্তা জনপ্রিয়তা’। শুধু জনপ্রিয়তা নয়, ‘সস্তা’। এবং দু’জনেই বললেন, খামকা এই নেতিবাচক অনুবাদ ব্যবহার করার কোনও অর্থ হয় না।

বাজেটের আগে ‘পপুলিজম’ আর ‘পপুলিস্ট’, এই দুটো শব্দের ব্যবহার হঠাৎ করেই অনেকখানি বেড়ে যায়। নির্বাচনের আগের বাজেট হলে, আরও বাড়ে। এ-বছরও যেমন, টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দিয়ে নরেন্দ্র মোদী জানিয়েছেন, ‘পপুলিস্ট’ বাজেট নয়, তাঁর লক্ষ্য ‘ইজ অব লাইফ’ বাড়ানো। নীতি আয়োগের কর্তা রাজীব কুমার ঘোষণা করে দিয়েছেন, নির্বাচনের আগের শেষ পূর্ণ বাজেট হলেও এই বাজেট মোটেই ‘পপুলিস্ট’ হবে না। অর্থনৈতিক সংবাদপত্রের পাতাজোড়া আলোচনা, সত্যিই কি ‘পপুলিস্ট’ হবে না বাজেট?

সে-প্রশ্ন আপাতত থাক। বঙ্গানুবাদে ফিরি। অভিধানে যে শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ নেই, সেটা ঠিক ‘সস্তা জনপ্রিয়তা’ শব্দবন্ধটায় এসে দাঁড়াল কেন? একমাত্র উত্তর, রাজনীতি। ভোটের আগে ‘পপুলিস্ট’ বাজেট পেশ করার রাজনীতি নয়। কোন নীতিটা ঠিক, আর কোনটা বেহদ্দ ভুল, সেটা চিহ্নিত করে দেওয়ার ক্ষমতার রাজনীতি। আর্থিক নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে কার কণ্ঠস্বর শোনা যাবে, কারটা যাবে না, তার উত্তর পাওয়ার জন্য অক্সফ্যাম-এর সাম্প্রতিক সমীক্ষার ফলাফলই যথেষ্ট: ভারতের মোট সম্পদের ৭৩ শতাংশ মাত্র এক শতাংশ মানুষের হাতে রয়েছে। নীতির ঠিক-ভুল নির্ধারণের ক্ষমতা এই এক শতাংশেরই। বাকি ৯৯ শতাংশের জন্য পথ বেছে দেওয়ার অধিকার এক শতাংশের হাতে— এটাই রাজনীতি। আর, এই রাজনীতিই স্থির করে দেয়, ‘জনপ্রিয়তা’ বস্তুটা ‘সস্তা’ কি না।

‘ঠিক’ নীতি তা হলে কী? এক শতাংশের মত বলবে, যে নীতি আর্থিক বৃদ্ধির বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভাবে, সেটাই ‘ঠিক’। স্বাধীনতার সত্তর বছরের মধ্যে শেষ অর্ধশতক কেটে গিয়েছে এই আর্থিক বৃদ্ধির সাধনাতেই। ফলে, শুধু আর্থিক বৃদ্ধির লক্ষ্যে ঘোড়া ছোটানোই ‘ঠিক’ নীতি কি না, সেই প্রশ্নটাই ক্রমে অবান্তর, এমনকী অ-বৈধ, হয়ে গিয়েছে। অতএব, কৃষকের দুর্দশার কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়ে দিতে হয়, তিনি ঋণ মকুব করার ‘সস্তা’ রাজনীতির কথা ভাবছেন না, তাঁর লক্ষ্য দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার। সংস্কার যে গুরুত্বপূর্ণ, অস্বীকার করার কোনও কারণ নেই। রাজনীতিকরা যে ঋণ মকুবও করেই থাকেন, সেটাও সমান সত্য। কিন্তু, খেয়াল করার কথা হল, কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল, সেই তর্কের দাঁড়িপাল্লায় ‘ঠিক’-এর দিকে ঋণ মকুবকে চাপানোর সাহস ছাপ্পান্ন ইঞ্চির ছাতিতেও কুলোয় না। এটাই ক্ষমতার গল্প। যা রাজনৈতিক ভাষ্যে ন্যায্যতার ধারণাকেই বদলে দিতে পারে।

আর্থিক বৃদ্ধির মতোই রাজকোষ ঘাটতির হার কমিয়ে আনাও ‘ঠিক’ নীতির আর এক আরাধ্য। কেন এই ঘাটতি কমাতেই হবে, সে প্রশ্নটা আর ওঠে না। দশক দুয়েক আগেও উঠত। আলোচনা হত, কী ভাবে নিয়োক্ল্যাসিকাল অর্থনীতির পূর্ণ কর্মসংস্থানের অনুমানটাকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয় কেইনসের মডেলের ওপর, যেখানে রাজকোষ ঘাটতি বাড়িয়ে বেকারত্ব কমানো অর্থনীতির পক্ষে একটি ঘোর জরুরি কাজ। সে-সব কথা এখন আর ওঠে না। অর্থনীতি বিপাকে পড়লে কেইনস-এর পুনর্জন্ম হয়, যেমনটা ২০০৭ সালের সংকটের পর হয়েছিল। অর্থনীতির হাল ফিরলেই কেইনস ফিরে যান পাঠ্যপুস্তকের পাতায়। নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে কোনটা ‘ঠিক’, তা স্থির হয় চেনা ছক মেনে— সরকার ক্রমে গুটিয়ে যাবে, আর বেসরকারি পুঁজির হাতে থাকবে লগ্নির যাবতীয় অধিকার। সেই পথে হেঁটে যদি অসাম্য ক্রমে বাড়তেই থাকে, তবে তা-ই সই। যাঁরা সেই অসমতার ভুল দিকে পড়লেন, তাঁরা ‘ঠিক’ নীতির কোল্যাটেরাল ড্যামেজ বই তো নন।

লোকসভা নির্বাচনের আগের শেষ পূর্ণ বাজেটে সরকার কতখানি ব্যয় বাড়ায়, তার হিসাব বাজারে ঘুরছে। ২০০৩-০৪ সালে সরকার ১৩.৪ শতাংশ খরচ বাড়ানোর কথা ঘোষণা করেছিল বাজেটে। ২০০৮-০৯ সালে ২৪ শতাংশ, আর ২০১৩-১৪ সালে ১০.৬ শতাংশ। সে টাকার কতখানি কোন খাতে গেল, তার কিছু উদাহরণ দিলেই চলবে। ২০০৮-০৯ সালে সরকার কৃষি ঋণ মকুব করেছিল। প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র চাষিদের জন্য ঋণের গোটাটাই, আর অন্যদের জন্য ২৫ শতাংশ। ইন্দিরা আবাস যোজনায় ভরতুকি বেড়েছিল। ২০১৩-১৪ সালে গ্রামীণ ক্ষেত্রে খরচ বৃদ্ধি পেয়েছিল ৪৬ শতাংশ। আয়বৃদ্ধির সুফল যাঁদের ঘরে সরাসরি পৌঁছয় না, এই টাকার সিংহভাগ যে তাঁদের হাতে গিয়েছিল, অন্তত যাওয়ার কথা, সেটা অনস্বীকার্য।

ভোটের বাজারে এই দেওয়াটুকুর ‘ঠিক-ভুল’ নিয়ে প্রশ্ন অনেক। কোন খরচে জিডিপি-র পালে হাওয়া লাগতেও পারে, আর কোনটা নিতান্তই বাজে খরচ, তার বিশ্লেষণ হয়। তার পর বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘নির্বাচন কেন বাধ্যতে!’ যে অসাম্য জমতে জমতে সর্বজনীন বৃদ্ধির মাপকাঠিতে ভারত পাকিস্তানের চেয়েও পিছিয়ে যায়, এই ছিটেফোঁটা প্রাপ্তিতে তার ইতরবিশেষ হয় কি না, সেই প্রশ্ন অবশ্য ওঠে না কখনও।

ঘটনা হল, ভোটের আগের এই খুচরো প্রাপ্তিতে অর্থনীতির কাঠামো তিলমাত্র বদলায় না। প্রাক্‌নির্বাচনী বাজেটেও বৃদ্ধির হারের জয়ধ্বনিই থাকে, রাজকোষ ঘাটতি কমিয়ে আনার শপথই থাকে। সেই বাজেটও কখনও বলে না, বৃদ্ধির বদলে লক্ষ্য হোক ন্যায্য পুনর্বণ্টন। বলে না, কিছু দিনের জন্য না-হয় বকেয়াই থাক চিনের সঙ্গে বৃদ্ধির হারের প্রতিযোগিতা, ভারত মন দিক সত্যিই সবার জন্য একটা বিশ্বমানের স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজে। বলে না, সেনসেক্সের উত্থানে নয়, দেশের অগ্রগতি মাপি সব শিশুর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।

প্রাক্‌নির্বাচনী বাজেটও ক্ষমতার বেঁধে দেওয়া ছকের বাইরে একটা পা-ও ফেলে না। এ-বারও যেমন খুব আলোচনা হচ্ছে আয়করের হার কমিয়ে আনা নিয়ে। আধার-লিংকেজের ফলে করদাতার সংখ্যা বেড়েছে, অতএব বেশি আয়ের মানুষের থেকে আর খুব বেশি হারে কর আদায়ের প্রয়োজন নেই। নতুন করদাতাদের বেশির ভাগই নিতান্ত স্বল্পবিত্ত— করযোগ্য আয়ের নিম্নসীমার চেয়ে সামান্যই বেশি আয় তাঁদের। তাঁদের থেকে যৎসামান্য হলেও কর আদায় করে বড়লোকদের— এক শতাংশের মধ্যে থাকা লোকদের— করের বোঝা কমিয়ে দেওয়াও কিন্তু সেই ক্ষমতারই যুক্তি।

তার পরেও ‘সস্তা জনপ্রিয়তা’ নিয়ে তুমুল আলোচনা হবে। বিশেষজ্ঞরা নৈর্ব্যক্তিক মুখে হিসাব কষে দেখিয়ে দেবেন, এই টাকা ‘ঠিক’ খাতে খরচ হলে অর্থনীতির কতখানি লাভ হত। সেই লাভ কার ঘরে যেত, সে-কথা উঠবে না। ভোটের রাজনীতির প্যাঁচে পড়া অর্থনীতির সমালোচনা হবে।

এই যুক্তিগুলো আসলে কার, সেই আলোচনা শোনার সময় এইটুকু মনে রাখা ভাল।

Arun jaitley Union budget Budget 2018 অরুণ জেটলি বাজেট
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy