Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

বাঁচিলে হয়

অ র্থনীতির ৯৫ শতাংশই আসলে কাণ্ডজ্ঞান, দুর্বোধ্য ভাষায় লেখা’। অর্থনীতিবিদরা হয়তো ‘রে রে’ করিয়া উঠিবেন, কিন্তু গত এই বৎসরের জানুয়ারি হইতে মার্চ মাসের জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির হার দেখিলে কথাটিতে বিশ্বাস না করিয়াও কোনও উপায় থাকে না।

শেষ আপডেট: ০২ জুন ২০১৭ ০০:০২
Share: Save:

অ র্থনীতির ৯৫ শতাংশই আসলে কাণ্ডজ্ঞান, দুর্বোধ্য ভাষায় লেখা’। অর্থনীতিবিদরা হয়তো ‘রে রে’ করিয়া উঠিবেন, কিন্তু গত এই বৎসরের জানুয়ারি হইতে মার্চ মাসের জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির হার দেখিলে কথাটিতে বিশ্বাস না করিয়াও কোনও উপায় থাকে না। আয়বৃদ্ধির হার ৬.১ শতাংশে ঠেকিয়াছে। গত তিন বৎসরে সর্বনিম্ন। কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান দফতর অনেক আঁক কষিয়া বলিয়াছে, নোটবাতিলের প্রভাব পড়িয়াছে বটে। অর্থনীতির উপর নোটবাতিলের কু-প্রভাবের এই প্রথম সরকারি স্বীকারোক্তি। নোটবাতিল যে অর্থনীতিকে কাবু করিবেই, কাণ্ডজ্ঞান সেই কথাটি মাস ছয়েক পূর্বেই বুঝিয়াছিল। সরকারি অলিন্দের বাহিরে থাকা অর্থনীতিবিদরাও প্রায় সমস্বরে বলিয়াছিলেন, বৃদ্ধির হার অনেকখানি কমিবে। নির্দিষ্ট অনুমানগুলি যে সব মিলিয়াছে, তেমন নহে। কিন্তু, প্রধানমন্ত্রী-অর্থমন্ত্রীরা যে ভঙ্গিতে সেই সব আশঙ্কা উড়াইয়া দিয়াছিলেন, তাহাও যে ভ্রান্ত ছিল, সে কথা প্রমাণিত। কাণ্ডজ্ঞান থাকিলেই যে কথাটি বোঝা যায়, দেশের কর্তারা তাহা বোঝেন নাই, তাহা কি বিশ্বাসযোগ্য? কেহ সন্দেহ করিতেই পারেন, ইহা একটি জটিলতর ছক। জাতীয় অর্থনীতিতে কোনও সিদ্ধান্তের ফল কী হইল, পরিসংখ্যানের মাধ্যমে তাহা বুঝিতে অন্তত মাস ছয়েক সময় লাগেই। যখন সেই হিসাব মিলে, তখনও বহুবিধ ভিন্নতর ঘটনার ছাপ তাহার উপর থাকে। ফলে, মোদীরা জানিতেন, নোটবদলে ভারতীয় অর্থনীতির কতখানি ক্ষতি হইল, সেই হিসাব মিলিতে মিলিতে নোটবদল লইয়া হইচইয়ের রেশ পরবর্তী হল্লায় ঢাকা পড়িয়া যাইবে। তাঁহারা এই সময়টিকে ব্যবহার করিয়াছেন।

কিন্তু, কিসের স্বার্থে? নোটবদলের ফলে ভারতীয় অর্থনীতির কী লাভ হইল, এত দিনেও তাঁহারা বলিতে পারেন নাই। কালো টাকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জেহাদ ইত্যাদি আর শোনা যাইতেছে না। যে ব্যাখ্যাটি টিকিয়া আছে, তাহা ক্যাশলেস অর্থনীতির। কিন্তু, নোটবদলের ফলে ভারতীয় অর্থনীতি কতখানি ক্যাশলেস হইল, এবং তাহাতে আখেরে ভারতের কী লাভ হইল, এখনও জানা নাই। জানা যাইবে, সেই ভরসাও নাই। বৃহত্তর প্রশ্ন, ক্যাশলেস অর্থনীতিকে গতিশীল করিবার জন্য নোটবদল করিতে হইল কেন? নোটবদলের ছয় মাস পরে ভারত যতখানি ক্যাশলেস হইয়াছে, দুনিয়ার বহু দেশে নগদের ব্যবহার তাহার তুলনায় ঢের কম। নোটবদল ছাড়াই যদি সেই দেশগুলি নগদ-নির্ভরতা কমাইতে পারে, ভারতের ক্ষেত্রে তাহার ব্যতিক্রম হইবে কেন? এই প্রশ্নগুলির উত্তরে নরেন্দ্র মোদীরা এমনই মৌন যে সন্দেহ হয়, উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনই সম্ভবত নোটবদলের একমাত্র কারণ। ভয়াবহ বলিলে খুবই কম বলা হইবে।

নোটবদলের কুফল সংক্রান্ত আলোচনার সিংহভাগই জিডিপির বৃদ্ধির হারকে কেন্দ্র করিয়া ঘুরিতেছে। পরিসংখ্যান প্রকাশিত হইবার পর সেই আলোচনায় আরও জোর বাড়িয়াছে। চাপা পড়িয়া গিয়াছে এই সিদ্ধান্তের শ্রেণিচরিত্রের কথা। বৃদ্ধির হার এক শতাংশ কমিয়াছে, তাহার তুলনায় অনেক বেশি জরুরি তথ্য হইল, শ্রমনিবিড় ক্ষেত্রগুলিতেই তাহার প্রভাব গভীরতর। নির্মাণশিল্প বিপর্যস্ত, অসংগঠিত ক্ষেত্র বিপুল ধাক্কা খাইয়াছে। এই ক্ষেত্রগুলিতে যাঁহাদের কর্মসংস্থান হয়, তাঁহারা গরিব মানুষ। অর্থাৎ, বৃদ্ধির হারের তর্কে ঢুকিয়া এই কথাটি ভুলিয়া যাওয়া গিয়াছে যে নোটবদল অনেক বেশি মারিয়াছে গরিবদের। ক্যাশলেস অর্থনীতিতে যাঁহাদের প্রবেশাধিকার ন্যূনতম। আয়বৃদ্ধির সুফল যাঁহাদের নিকট সর্বাপেক্ষা বিলম্বে পৌঁছায়। বৃদ্ধির হার কাল না হউক পরশুর পরের দিন ঠিক হইয়া যাইবে। কিন্তু, নোটবদল যাঁহাদের রুজি কাড়িয়া লইয়াছে, তাঁহারা সেই বর্ধিত বৃদ্ধির হারের সুফল পাইবার জন্য বাঁচিয়া থাকিবেন তো?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Indian economy Demonetisation
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE