Advertisement
E-Paper

খাজনা মকুব করে কী লাভ হল পশ্চিমবঙ্গের চাষির?

কৃষিজমির খাজনা মকুব হল, ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী। চাষির প্রশ্ন, তাতে কী হল? ‘খাজনা আর কত টাকা। আমাকে যা খাজনা দিতে হয় তাতে একটা এগ রোল-ও হয় না,’ ঝাড়গ্রাম ব্লক কিষাণ মান্ডিতে বসে বলছিলেন তরুণ এক চাষি।

স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০১৭ ০০:২২

কৃষিজমির খাজনা মকুব হল, ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী। চাষির প্রশ্ন, তাতে কী হল? ‘খাজনা আর কত টাকা। আমাকে যা খাজনা দিতে হয় তাতে একটা এগ রোল-ও হয় না,’ ঝাড়গ্রাম ব্লক কিষাণ মান্ডিতে বসে বলছিলেন তরুণ এক চাষি। ‘যারা ঠাকুরদার আমল থেকে খাজনা দেয়নি, দশ-বারো হাজার টাকা খাজনা বাকি আছে, তাদের লাভ হতে পারে। আমার আপডেট করা, লাভ নেই।’ একটু থেমে বললেন, ‘এতে কর না-দেওয়ার প্রবণতা বাড়বে।’

ঝাড়গ্রামের মতো দরিদ্র, আদিবাসী জেলাও খাজনা মকুবের ঘোষণায় নিরুত্তাপ। বরং অনেক চাষি ক্ষুব্ধ। তাঁদের নালিশ, এ হল গরু মেরে জুতো দান। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি কৃষিজমির মিউটেশন ফি এক শতক-এ (ডেসিমাল) এক টাকা থেকে চল্লিশ টাকা করেছে সরকার। এর পর এপ্রিল মাসে এক শতকে এক-দেড় টাকা খাজনা মাফ করার মানে কী? রাধানগরের নৃপেন্দ্রনাথ মাহাতো বললেন, ‘‘চোদ্দো-পনেরো বিঘে মিউটেশন করাতে (ঝাড়গ্রামে বিয়াল্লিশ ডেসিমালে এক বিঘা ধরেন চাষিরা) আমার এখন খরচ হবে পঁচিশ হাজার টাকারও বেশি। ওই জমিতে খাজনা কয়েকশো টাকা। মকুব না করলেও হত।’’

খাজনা মকুব করে কী হল, প্রশ্ন করলে আতান্তরে পড়ছেন ভূমি দফতরের কর্তারা। ঠিক কী মকুব হয়েছে, জানেন না এখনও তাঁরা। জমির কর, আর তার উপর সেস, এই দুটোকেই চাষিরা ‘খাজনা’ বলে জানেন। বাংলা ১৩৮৫ সালের পয়লা বৈশাখ থেকে ছয় একর জমির খাজনা তো মকুব করাই আছে বাম আমল থেকে। রাজ্যের ৯০ শতাংশ চাষিই আসেন তার আওতায়। তাঁরা ‘খাজনা’ বলে যা দেন, আসলে তা শুধু সেস। ‘খাজনা মকুব’ বলতে যদি বাকি দশ শতাংশ চাষির জমি-কর মকুব করে থাকেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সে লাভ কোনও হিসেবেই আসে না। আর বড় চাষির খাজনা মকুব করার দরকার কী, সে প্রশ্নও উঠতে পারে।

অথবা মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণার অর্থ হতে পারে, সেস মকুব। এখন থেকে কিছুই দিতে হবে না চাষিকে। কিন্তু তাতে চাষিদের সুবিধে হবে নাকি অসুবিধে, সে প্রশ্ন উঠছে। বামফ্রন্টের ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের এক প্রাক্তন আমলা বললেন, ‘সাতাত্তর সালে কৃষিজমির খাজনা সম্পূর্ণ মকুব করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তখন চাষিরাই এসে বললেন, খাজনার রসিদ বা দাখিলা হল জমির ওপর চাষির দখলের প্রমাণ। তাঁরা তা থেকে বঞ্চিত হবেন। তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, চাষির কাছ থেকে শুধুই সেস নিয়ে রসিদ দেওয়া হবে। সেই মতো ভূমি সংস্কার আইন বদলানো হয়েছিল।’

সেস থেকে পাওয়া টাকাটা যে সামান্য, সরকারি হিসেব থেকেই তা স্পষ্ট। ২০১৬-১৭ সালে রাজ্যে ভূমি রাজস্ব সংগ্রহ হয়েছে মোট ১৪২ কোটি টাকা। সরকারি কর্তাদের আন্দাজ, এর অন্তত ৭০ শতাংশ শহর থেকে এসেছে। অতএব, এ রাজ্যে কৃষিজমির খাজনা বছরে চল্লিশ-পঞ্চাশ কোটি টাকার বেশি ওঠে না। মুখ্যমন্ত্রী যে চাষির দু’শো কোটি টাকা মাফ করার কথা জনসভায় বলেছেন, সেটা কথার কথা।

কিন্তু চাষির চিন্তা অন্য। খাজনা মকুব বলতে যদি সেস তুলে দেওয়ার কথা বোঝানো হয়, তা হলে খাজনার রসিদের বিকল্প কী হবে? নির্মল বাংলার শৌচাগার থেকে বন্যার ক্ষতিপূরণ— যে কোনও বিষয়ে আবেদন করতে হলে আজও যে খাজনার রসিদই চান পঞ্চায়েত কর্তারা।

প্রশ্ন ওঠে, কেন এই রসিদ-নির্ভরতা? কান টানলে যেমন মাথা আসে, তেমনি খাজনার প্রসঙ্গ এনে নামান্তর-নথিভুক্তি বা মিউটেশনের বৃহত্তর সমস্যাটিকে আলোয় নিয়ে এলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী। জমির হাতবদল হলেও খতিয়ান বা পরচায় নতুন মালিকের নাম নথিভুক্ত (মিউটেশন) প্রায়ই করা হয় না। ফলে জমির রেকর্ড থেকে হালফিলের মালিকানার খবর মেলে না। তাই খাজনা বা সেস জমা-দেওয়ার রসিদকে হালফিল মালিকানার প্রমাণ হিসেবে মেনে নিয়ে গ্রামের জমি কেনাবেচা চলছে। ওই রসিদে রেকর্ডভুক্ত জমির মালিকের নাম ছাড়াও কার মারফত খাজনা দেওয়া হয়েছে, তা লেখা থাকে। তার ভিত্তিতে জমি বিক্রি হয়। খাজনার রসিদ আইনত মালিকানার প্রমাণ নয়, কিন্তু কার্যত তা-ই হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তাতে ক্ষতি হয়েছে চাষির, কারণ জমির মিউটেশন করা না থাকলে জমি বিক্রি করতে গেলে উচিত দাম মেলে না। সরকার তা অধিগ্রহণ করলে ক্ষতিপূরণ মেলে না। সেই সঙ্গে কৃষিকাজে সরকারি ঋণ, ‌‌‌শস্যবিমা, খরা বা বন্যার ক্ষতিপূরণ, নানা রকম প্রাপ্য সুবিধের কোনওটাই মেলে না। শিল্পায়নই হোক, পরিকাঠামোর উন্নতিই হোক আর কৃষিকে লাভজনক করার প্রকল্পই হোক, উন্নয়নের সঙ্গে চাষির সংযোগ করতে হলে জমির রেকর্ড ঠিক রাখতেই হবে। ক্ষতি সরকারেরও, কারণ যে কোনও কাজে জমি অধিগ্রহণ করতে গেলে আসল মালিকের হদিশ পেতে ঘাম ছুটে যায়। সিঙ্গুরে জমি নিতে গিয়ে দেখা গিয়েছিল, যাঁকে বৈধ মালিক বলে নথিপত্র পাওয়া যাচ্ছে, তাঁর পরে তিন-চারবার জমির হাতবদল হয়ে গিয়েছে।

তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় এসে মিউটেশনে গতি আনার চেষ্টা করেছিল। একটি সরকারি সূত্র অনুসারে, ২০১১-১২ সালে যেখানে চার লক্ষ পঁচাত্তর হাজার কৃষিজমির মিউটেশন হয়েছিল, ২০১৬-১৭ সালে সেখানে হয়েছে তেইশ লক্ষেরও বেশি। কিন্তু এত দিন মিউটেশন ফি ছিল সামান্য। এক লাফে এতটা ফি বাড়লে চাষিদের আগ্রহ আরও কমবে, সে আশঙ্কা থাকছে। ‘জমির রেকর্ড ঠিক রাখা সরকারের কর্তব্য। আয় বাড়াতে গিয়ে সরকার তা ভুলে যাচ্ছে,’ অভিযোগ ওই প্রাক্তন আমলার।

কিন্তু আসল সমস্যা বৈধ ফি নয়, ঘুষ। চাষিদের অভিযোগ, মিউটেশন কিংবা কৃষিজমির চরিত্র বদল করার কাজ মাসখানেকের মধ্যে হয়ে যায় ঘুষ দিলে। না হলে ঘুরতে হয় কয়েক বছর। নদিয়ার করিমপুরের এক চাষি বললেন, জমির চরিত্র বদলের আবেদন করলে তাঁর কাছে পঞ্চাশ হাজার টাকা দাবি করেন ব্লকের ভূমি রাজস্ব কর্তারা। অনেক দরাদরি, কাকুতি-মিনতি করেও যখন কুড়ি হাজারে নামাতে পারেননি, তখন অভিযোগ করেন ভূমি দফতরে। ব্লক থেকে মহকুমা, তার পর জেলার অফিসারদের কাছেও নালিশ করতে হয়। তাতে কাজ হয়েছে, তবে তিন বছর লেগে গিয়েছে। ‘আমাদের কথা ছাড়ুন। সরকারি অফিসারদেরও দেখেছি, টাকা না দিয়ে কাজ করাতে পারেন না,’ বললেন আর এক চাষি।

বীরভূমের বক্রেশ্বরের এক চাষি জমির মিউটেশন বা চরিত্র পরিবর্তন করতে সাহায্য করেন অনেককে। বললেন, ‘লাইন না করতে জানলে ঘুরতে হবে।’ তার খরচ কত? দশ-বিশ হাজারে হয় না, সাফ কথা তাঁর। আরও বেশিই লাগে। বছরের পর বছর চাষিরা কেউ মৃত বাপ-ঠাকুরদার নামে খাজনা দিচ্ছেন, কেউ অচেনা কোনও প্রাক্তন-মালিকের নামে, সে কি কেবল তাঁদের মূর্খামি?

মমতা নাকি চাষির হয়রানি বাঁচাতে খাজনা মকুবের কথা ঘোষণা করেছেন। কিন্তু কী বাঁচল চাষির? টাকা বাঁচল না, হয়রানিও না।

Farmers Profit tax
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy