Advertisement
E-Paper

তখন কার দ্বারস্থ হব আমরা

মনোবিজ্ঞানীদের মতে, কৈশোরে ছেলেমেয়েদের এত রকম দৈহিক ও মানসিক পরিবর্তন হয় যে তারা কিছুটা দিশেহারা হয়ে পড়ে। মনোবিদ স্ট্যানলি হল এই বয়সের (বিশেষত এগারো থেকে চোদ্দো) ছেলেমেয়েদের বোঝানোর জন্য ‘ফ্ল্যাপার’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন, যার অর্থ, যে পাখির পাখনার পরিপূর্ণ বিকাশ হতে এখনও বাকি, কিন্তু বাসার মধ্যে থেকেই যে ওড়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে

সুব্রত বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০১:৩০

বেশি দিন আগেকার কথা নয়। ব্লু হোয়েলের খবর পেয়ে সন্ত্রস্ত হয়েছিলাম আমরা। সে খবর মিলিয়ে যেতে না যেতে আবার এসে গিয়েছে মোমো চ্যালেঞ্জ। প্রায় একই ধরনের খেলা। কিশোর-কিশোরীদের আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়াই এদের লক্ষ্য। আর্জেন্টিনার এক কিশোরীর মৃত্যু মোমো চ্যালেঞ্জকে প্রচারমাধ্যমে এনে ফেলে। জাপানি শিল্পী মিদোরি হায়াশির একটি শিল্পকর্মের শরীরের উপরের অংশ মেয়ের মতো আর বাকিটা পাখির আদল— ভয়ঙ্কর মুখাকৃতির ওই অর্ধপাখি অর্ধমানব পুতুলটি হল মোমো। তাকে ঘিরে দুনিয়াময় অভিভাবকরা এখন চিন্তিত। মুশকিল হল, সাইবার-অপরাধ ক্রমে বাড়বে, এই রকম মারণ খেলাও সেই ফাঁক দিয়ে ঢুকতে থাকবে। তা হলে? শুধুমাত্র পুলিশ প্রশাসন ও সাইবার সেল-এর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকাই কি আতঙ্ক কাটানোর একমাত্র পথ?

ভাবার বিষয়। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, কৈশোরে ছেলেমেয়েদের এত রকম দৈহিক ও মানসিক পরিবর্তন হয় যে তারা কিছুটা দিশেহারা হয়ে পড়ে। মনোবিদ স্ট্যানলি হল এই বয়সের (বিশেষত এগারো থেকে চোদ্দো) ছেলেমেয়েদের বোঝানোর জন্য ‘ফ্ল্যাপার’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন, যার অর্থ, যে পাখির পাখনার পরিপূর্ণ বিকাশ হতে এখনও বাকি, কিন্তু বাসার মধ্যে থেকেই যে ওড়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে। বিজ্ঞানী হারলকের মতে, কৈশোরের সীমা বারো থেকে একুশ— এটা হল যৌন পরিণতির স্তর। এই স্তরে ছেলেমেয়েদের যুক্তি-শক্তির বিকাশ হলেও তাদের যুক্তি ঠিক পরিণত হয় না।

সব চেয়ে বড় কথা, এই বয়সে বিমূর্ত চিন্তনের ক্ষমতাও সবেমাত্র বিকশিত হতে শুরু করে। যুগপৎ তীব্র আনন্দ-অনুভূতি এবং বিমর্ষতা তাদের মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। আর তাই, লজ্জা, হীনম্মন্যতা, অপরাধবোধ, ভয়, কখনও বা আক্রমণাত্মক ভাব, এ ধরনের নানা আবেগ কিশোর মনকে নিয়ন্ত্রণ করে। ভুললে চলবে না যে এই স্তরেই ছেলেমেয়েরা শারীরিক পরিসরে পূর্ণ নারী ও পুরুষ হয়ে ওঠে, এবং সামাজিক দিক থেকে তার পূর্ণ স্বীকৃতি আদায় করতে চায়। প্রক্ষোভিক দিক থেকে এ সময়ে তাদের মধ্যে জায়গা করে নেয় উদ্বেগ (‘অ্যাংজ়াইটি’) এবং অন্তর্দ্বন্দ্ব (‘কনফ্লিক্ট’)। এ হল সেই মনস্তাত্ত্বিক ফাঁকের জায়গা, যেখানে সুপরিকল্পিত ভাবে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলে নানা মনোবিকলনের খেলা।

মনে রাখতে হবে, এই পর্যায়ে কিশোরকিশোরীর প্রক্ষোভিক সংঘাতের জন্য কিন্তু শুধুমাত্র ওই নির্দিষ্ট ছেলে বা মেয়েটি দায়ী নয়। দায়ী বাবা-মা বা অভিভাবকরাও। একে তো ওই বয়সে ছেলেমেয়েদের নিজেদের অবস্থান নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকে খুব বেশি। অন্য দিকে বয়স্কদের দিক থেকে তাদের অনিশ্চয়তাকে ছোট করে দেখার প্রবণতাও সর্বব্যাপী। ফলে সব দেশেই বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েরা ভুগতে থাকে সত্তা-সঙ্কটে (‘আইডেন্টিটি ক্রাইসিস’)। একটি ত্রিকোণ জটিলতার কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে থাকে তারা, যার তিনটি কোণ হল উদ্বেগ, অন্তর্দ্বন্দ্ব ও বিমূর্ত চিন্তন। আর এই ত্রিবিধ পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে ছেলেমেয়েরা একটু বেশি রকম অন্তর্মুখী হয়ে যায়। আর এখানেই এসে পড়ে বাবা-মা, আত্মীয়-বন্ধু বা শিক্ষকদের ভূমিকা।

কোনও মারণ-খেলা চালু হলেই আমাদের সব চেয়ে বেশি অভিযোগ চলে আসে প্রশাসনের উপর। সেই অভিযোগের খানিকটা হয়তো সত্যি। কিন্তু সত্যি বলতে কী, কৈশোরের এই সঙ্কটময় সময়ের দিকে খেয়াল রাখবে কোন রাষ্ট্রব্যবস্থা? হাল আমলের যোগাযোগ-মাধ্যমের প্রবল দাপটে একের পর এক যন্ত্রপ্রযুক্তি ছেলেমেয়েদের হাতে চলে আসে। আর সেখান থেকেই শুরু হয় পারস্পরিক দূরত্বের খাদ।

সন্তানের মনের সঙ্গে তার অভিভাবকের যোগাযোগটা যদি দুর্বল থাকে, তবে কোনও প্রশাসন দিয়ে সেই বিপদ এড়ানো যাবে না। সন্তানের বন্ধু হওয়ার উপদেশ বহু যুগ থেকে চলছে, কিন্তু সে সব শুনে আমরা ভাবি ছেলেমেয়েদের খেলনা, পোশাক, ফাস্ট ফুড থেকে দামি মোবাইল দিলেই ‘বন্ধুত্ব’-কর্তব্য সারা। কারও আর খেয়াল করার মতো সময় নেই যে, আমার সন্তান একা একা মোবাইল বা কম্পিউটার নিয়ে কী করছে। এগুলো আটকাতে বলার আজ আর কোনও অর্থ হয় না, সেটা সম্ভবও নয়। কিন্তু এর পাশাপাশি কি এইখানটাতেও আমরা তাদের বন্ধু হয়ে এক সঙ্গে থাকতে পারি না? যদি বলি— চলো আমরাও খেলি, চলো আমরা সবাই মিলে সিনেমা দেখি, চলো এক সঙ্গে মিলে কালো-সাদা ভাল-মন্দকে চিনি?

শিক্ষার ক্ষেত্রে একটা শব্দ শুনি: আনন্দ-পাঠ। জীবনের ক্ষেত্রে তা হতে পারে না কেন? হয়তো তা হলে দিশেহারা কৌতূহলের বশে ছেলেমেয়েরা জীবনের পথে অজানা ফাঁকফোকরে, মারণ-খেলার ফাঁদে পড়বে না। আজ মোমো আটকানোর জন্য প্রশাসনের দ্বারস্থ হওয়া যাচ্ছে। আগামী কাল হয়তো এমন আরও ‘খেলা’ আসবে, যা বাইরে থেকে প্রশাসন, সমাজ, রাষ্ট্র, কেউই আটকাতে পারবে না! তখন কার দ্বারস্থ হব আমরা?

Blue Whale Momo Suicide Game Cyber Crime
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy