Advertisement
E-Paper

‘স্ত্রীর বয়স ১৫ হলেই স্বামীর যৌনাচার ধর্ষণ নয়’!

আদালতে স্ত্রীর অমতে স্বামীর যৌন সংগম শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ধার্য করতে হবে, এই নিয়ে আবেদনের সাপেক্ষে শুরু হয় মামলা।

ঈপ্সিতা হালদার

শেষ আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০১৭ ০০:৩৮

স্বামী কর্তৃক জবরদস্তি সংগম ধর্ষণ নয়— কেন্দ্রীয় সরকার যদি এই মর্মে হলফনামা দাখিল করে, তখন স্পষ্ট হয় যে, রাষ্ট্র দাম্পত্য যৌনতাকে আসলে ব্যক্তি নারীপুরুষের যৌনতা হিসেবে দেখছে না, যেখানে থাকতে পারে নারীর অমত, থাকতে পারে নানা কারণে অনিচ্ছুক বা অপারগ নারীকে যৌন শাসনে ঢিট করার পুরুষালি ইচ্ছা। অর্থাৎ ধর্ষণ বিষয়ক আইন থাকলেও, বিবাহ ব্যতিক্রম। কারণ বৈবাহিক যৌনতাকে দেখা হচ্ছে আবশ্যিক হিসেবে, প্রজনন যেমন, নিজ শরীরকে পুরুষের শিশ্নবাদী কামনায় সঁপে দেওয়া ছাড়া তাতে নারীর কোনও সমান ভূমিকা বা সিদ্ধান্ত নেই। না হলে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৫ নম্বর ধারায় ধর্ষণকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তার ব্যতিক্রম হিসেবে বলা যেতে পারে যে, ‘স্ত্রীর বয়স ১৫ হলেই তার সঙ্গে তার স্বামীর যৌনাচার ধর্ষণ নয়’। আইনি বয়ানের দ্বিচারিতা লক্ষ করুন, স্ত্রীর অমতে বা বিনা মতে যৌনসংগম হতে পারে সেটা নিয়ে ধন্দ নেই, কিন্তু তাকে স্রেফ ধর্ষণ হিসেবে দেখা হবে না, সেই নিদানটি এখানে দেওয়া হয়েছে। স্ত্রীর অমত বলে কিছু নেই বিবাহে।

আদালতে স্ত্রীর অমতে স্বামীর যৌন সংগম শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ধার্য করতে হবে, এই নিয়ে আবেদনের সাপেক্ষে শুরু হয় মামলা। গত অগস্টের শেষে দিল্লি হাইকোর্টে এই আবেদন ও তার সাপেক্ষে যাবতীয় যুক্তির বিপক্ষে বলা হয়, এই আইন হলে স্বামীকে ধর্ষক বানিয়ে তাকে চূড়ান্ত আইনি আর সামাজিক হেনস্তা করতে পারে জাহাঁবাজ মহিলারা। সর্বোপরি বিবাহের মধ্যে ধর্ষণ হতে পারে, এমনটা সাব্যস্ত হলে বিবাহ নামক পবিত্র পীঠস্থান ধসে পড়ে ভারতবর্ষের পৌরাণিক পূতভূমির উত্তরাধিকার থেকে আমরা বিচ্যুত হব।

যে কোনও ধর্মই নারীকে যৌনক্রিয়ায় যৌন যন্ত্র হিসেবে তৈরি করে, পিতৃতান্ত্রিক সমাজকে সুসংগঠিত করে, বিবাহকে মন্দির বানায়। কিন্তু সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সমাজে নারী-পুরুষের বৈষম্য খেয়াল করে পিতৃতান্ত্রিক দমনপীড়নকে মোকাবিলা করার ওই বৈষম্যকে দেখতে শেখার দরকার হয়। তখন প্রয়োজন হয়, ধর্ম বিবাহ পরিবার— এই ত্রয়ীকে আলাদা ভাবে ও একসঙ্গে নারীর অবমাননা ও পীড়নের ক্ষেত্র হিসেবে দেখার। ধর্ম যা বলে তা নারীর পক্ষে সম্মানজনক বা সমানাধিকারসূচক না হতে পারে, আর ধর্ম বলে তাকে প্রশ্নহীন মেনে নেওয়ার কিছু নেই, ধর্ম একটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক মুহূর্তে মানুষের প্রয়োজনে উদ্ভূত। ধর্ম আসলে সভ্যতার একটি রূপ, অভিব্যক্তি, স্বতঃসিদ্ধ কিছু নয়। ক্ষমতার রূপ বদলালে তা বদলেছে, আবার ক্ষমতার প্রয়োজনে তার উপাদানগুলি রেখে দেওয়া হয়েছে অবিকৃত। যৌনতায় স্ত্রীর সম্মতির কথা গ্রাহ্য না করা তেমনি একটি উপাদান, যা ধর্মকে, বিবাহকে, পরিবারকে পুরুষতান্ত্রিক করে রেখে দেয়, যেন ধর্ষণ বলে কিছু হয় না বললেই ধর্ষণ না-মুমকিন হয়ে যায়।

প্রশ্ন ওঠে, আইন তো কোনও কট্টর ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নয়। আইনে তো কিছু অপরাধ অপরাধ হিসেবে স্বতঃসিদ্ধ হওয়ার কথা। কিন্তু এখানে ব্যবহৃত হয় একটি অতি চমৎকার যুক্তিজাল, যে যুক্তির বলে এক দিন আইনকে পরিস্থিতি-সংবেদী করে তোলার চেষ্টা করেছিলেন মানবাধিকার আন্দোলন কর্মীরা, নারীবাদীরা। তাঁরা বলেছিলেন, শাস্তি নির্ধারণ শুধু অপরাধ প্রমাণের ওপর নির্ভর করে না। কে কখন কোথায় কেন কোন পরিস্থিতিতে অপরাধ করে, সেখান থেকে সাব্যস্ত হওয়া দরকার, অপরাধ কী আর তার শাস্তিই বা কী। রাষ্ট্র এই রাজনৈতিক ভাষ্যকে ব্যবহার করে ও বলে, নানা রাজ্য আদালতে সেই সব রাজ্যের নির্দিষ্টতা অনুযায়ী অপরাধমূলক আইন যদি ভিন্ন হতে পারে, তা হলে পশ্চিমি আইনি কায়দায় আমরা কেন বিবাহে ধর্ষণ সম্ভব বলব! আমরা চলব আমাদের প্রথা অনুযায়ী, ভারতীয় বিবাহকে সনাতনী মর্যাদা দিয়ে, যেখানে পতির কামলোভহতাশাভয়ক্রোধ পূরণে সংগমেচ্ছা মেটালে সতীর অক্ষয় স্বর্গ। এখানে প্রশ্ন করাই যায়, পশ্চিম কী, কারণ পশ্চিম ইউরোপ আমেরিকা কানাডা ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া, সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক, রাশিয়া, পোল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, আয়ার্ল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ঘানা, ইজরায়েল থেকে নেপাল পর্যন্ত মেনে নিয়েছে স্বামীর বলপ্রযুক্ত সংগম ধর্ষণ এবং তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

অপব্যবহার হতে পারে, ব্যক্তিগত রাগ-ঝাল মেটাতে বা টাকাকড়ি দখল করতে স্ত্রীরা ধর্ষণের মিথ্যে অভিযোগ এনে স্বামীকে ফাঁসাবে, এই ভয়ে রাষ্ট্র যদি আইন প্রণয়নে পিছিয়ে যায়, তা হলে কি আইন বলে যে জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র আছে, এবং সেখানে যাঁরা সেই জ্ঞানের চর্চা করেন তার উপর ভরসা রাখতে আমাদের রাষ্ট্র নারাজ? কেননা যেহেতু ইতিমধ্যে নারীর ওপর গার্হস্থ্য হিংসা বিষয়ক ৪৯৮এ ধারার যথেষ্ট অপব্যবহার হয়ে গেছে? না কি, দাম্পত্য যৌনতা এতটাই ব্যক্তিগত আর সাক্ষ্যপ্রমাণ ব্যতিরেকী যে, দাম্পত্য ধর্ষণের বিষয়টিকে অনেক জটিল ও ব্যতিক্রমী হিসেবে দেখতে হবে?

আমাদের সনাতন দেশে এ সব এ ভাবে হয় না, এই সাধারণীকরণের পরেও হলফনামার বয়ান থেকে উঠে আসে কতগুলি খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। সাধারণ ভাবে ধর্ষণের সংজ্ঞা দাঁড়িয়ে আাছে নারীর অসম্মতির উল্লঙ্ঘনের ওপর, কিন্তু দাম্পত্যের ক্ষেত্রে স্ত্রীর যৌন সম্মতি আগে থেকে ধরে নেওয়া বলে সম্মতি ও ধর্ষণের মাঝখানের সূক্ষ্ম ভেদকে বুঝে ধর্ষণের সংজ্ঞা নির্ধারণ অত্যন্ত জটিল একটি প্রক্রিয়া। এমনকী ধর্ষক যেহেতু স্বামী, কতখানিতে স্ত্রীর সম্মতি, আর কার পর থেকে বলপ্রয়োগ, তার কোনও একটি নির্দিষ্ট সাধারণ ধাঁচা নির্ণয় করা কঠিন। যেহেতু বলপ্রয়োগ আর সম্মতির ধারণা নারী থেকে নারীতে আলাদা, কী ভাবে সেই পার্থক্যের ধারণা নিয়ে আসা যাবে দাম্পত্য ধর্ষণের সংজ্ঞায়? কী ভাবেই বা নির্ণয় হবে এত পার্থক্য-সহ দাম্পত্য ধর্ষণের একটি নির্বিশেষ সংজ্ঞা?

যাঁরা স্বামীর ধর্ষণকে শাস্তিযোগ্য বলে আবেদন করেছেন, তাঁরাও কিন্তু, এই হল দাম্পত্য ধর্ষণ আর এটা নয়— এ রকম কোনও সাদামাটা বিভাজন চাইছেন না। তাঁরা চাইছেন ৩৭৫(২) ধারার অপসারণ, যার বলে স্বামী তার ১৫ বছরের উপরে অপ্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রীর সঙ্গে বলপ্রয়োগ যৌনতা করে পার পেয়ে যায় স্বামীর অধিকার বলে। তাঁরা এই নারীবাদী দাবি রাখেন যে দাম্পত্যের বাধ্যতামূলক যৌনতার বদলে গ্রাহ্য হবে স্ত্রীর নিজ যৌন শরীরের ওপর নিজের অধিকার ও ইচ্ছে-অনিচ্ছে প্রয়োগের ক্ষমতা। কী ভাবে দাম্পত্য যৌনতা থেকে দাম্পত্য ধর্ষণকে আলাদা করা যাবে, কী ধর্ষণ আর কী নয়, তার বিচারে স্ত্রীর বিবেচনা ছাড়া আর কোন বিশ্লেষণের ক্ষেত্র কী ভাবে আনা যাবে— এই আত্মপ্রক্ষেপণ মুলতুবি রেখে যদি সামাজিক রীতিনীতি মূল্যবোধের দোহাই পাড়া হয়, তা হলে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে কি?

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে শিক্ষক

Wife Rape Sexual issue
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy