নির্ভয়ার চার ধর্ষককে একসঙ্গে ফাঁসি দেবে ভারত সরকার। কঠিন-কঠোর সাজা দিয়ে ভবিষ্যতের ধর্ষকদের মনে ভয় ঢোকানোই এই ফাঁসির লক্ষ্য। আর কোনও দুষ্কৃতী ভবিষ্যতে যেন ধর্ষণ করার চিন্তাও মনে না জায়গা দেয়। কিন্তু মৃত্যুদণ্ড কি সত্যিই ধর্ষণ বা নারী নির্যাতন কমাবে?
কঠোর সাজা অপরাধ কমায়, এই প্রতিরোধী (ডেটারেন্স) তত্ত্ব কতটা বিশ্বাসযোগ্য? ভারতের আইন কমিশনের ৩৫তম রিপোর্টে ১৯৬৭ সালে বলা হয়েছিল, হ্যাঁ মৃত্যুদণ্ড অপরাধ কমায় এই ধারণার মধ্যে সত্যতা আছে। যদিও একই সঙ্গে রিপোর্টে এটাও বলা হয়েছিল, এ ব্যাপারে নানা দেশের তথ্য পরিসংখ্যান পরস্পরবিরোধী। তাতে এটা প্রমাণ হয় না মৃত্যুদণ্ড অপরাধ কমায়। আবার কমায় না, এটাও প্রমাণ হয় না। কিন্তু সমাজের চিন্তক ও বিশিষ্টেরা এটাই মনে করেন যে মৃত্যুদণ্ড অপরাধ কমায়। তাঁদের এই চিন্তা কমিশনের কাছে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টও মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়ার সময় এই ‘ডেটারেন্স’ বা প্রতিরোধী তত্ত্বকে সমর্থন করেছে। যদিও অধিকাংশ সময়ই তারা এই ব্যাপারে বিশেষজ্ঞের অভিমত এবং সমাজের চাহিদা বা জনমতের উপর নির্ভর করেছে।
২০১৫ সালে সর্বশেষ আইন কমিশন রিপোর্ট (রিপোর্ট নং ২৬২) কিন্তু মৃত্যুদণ্ড নিয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত কথা বলেছে। বিচারপতি এ পি শাহের নেতৃত্বাধীন আইন কমিশন স্পষ্ট বলেছে, পরিসংখ্যানবিদ, বিশেষজ্ঞ, তাত্ত্বিকদের বহু বছরের গবেষণা ও বিতর্কের পরে আজ এ বিষয়ে একটা মতৈক্যে পৌঁছনো গিয়েছে যে যাবজ্জীবন বন্দিত্বের চেয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশে সমাজে বাড়তি কোনও সুফল হয় না। গত পঞ্চাশ বছরের ইতিহাস ঘেঁটে, দেশের পর দেশের গবেষণা বিশ্লেষণ করে তাঁরা দেখিয়েছেন মৃত্যুদণ্ড ধর্ষণের বিরুদ্ধে কোনও বাড়তি প্রতিরোধ গড়ে তোলে না। রাষ্ট্রপুঞ্জ মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে প্রস্তাব নেওয়ার সময়ও বার বার বলেছে মৃত্যুদণ্ড বা ফাঁসির সাজা অপরাধ কমায়, এটা স্রেফ গল্পকথা বা মিথ। শেষ পর্যন্ত আইন কমিশন সন্ত্রাসবাদী অপরাধ ছাড়া আর সমস্ত ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড বিলোপের সুপারিশ করেছে। আইন কমিশনের অমূল্য এই রিপোর্টের সুপারিশ অবশ্য ভারত সরকার গ্রহণ করেনি। ঘোষিত ভাবে বর্জনও করেনি। কার্যক্ষেত্রে উল্টোটাই করছে। ২০০৪ সালে ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের ফাঁসির পর আট বছর এ দেশে ফাঁসি বন্ধ ছিল। কিন্তু তার পরে পর পর ফাঁসি দেওয়া হয়েছে আজমল কাসব (২০১২), আফজল গুরু (২০১৩) এবং ইয়াকুব মেমনকে (২০১৫)।