Advertisement
E-Paper

পর্বান্তর

বহুত্ববাদ, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নিধনের সঙ্গে আধুনিক ভারতের আর একটি বৈশিষ্ট্যও মৃত্যুমুখে পতিত হইল। তাহা যুক্তরাষ্ট্রীয়তা।

শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০১৭ ০০:১৩

কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবেশ মন্ত্রক গবাদি পশু কেনাবেচা বিষয়ক সাম্প্রতিকতম নিষেধাজ্ঞাটি কেন ঘোষণা করিল? যদি তাহা পশুকল্যাণার্থেই হয়, তবে পরিবেশ মন্ত্রক কেন, কৃষি মন্ত্রকের অধীনে পশু দফতর করিল না কেন? কেবল গরু-বাছুরের উপর নিষেধাজ্ঞা কেন, ভে়ড়া ছাগল নয় কেন? ইত্যাকার প্রশ্ন শুনিলে মনে হয়, সস্তা নাটকের মহড়া চলিতেছে। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরই এত প্রবল রকম স্পষ্ট ও উজ্জ্বল যে, কোনও প্রশ্নের অবকাশ থাকিবারই কথা নয়। সেই অবকাশ যাঁহারা তৈরি করিতেছেন, নিরীহ গোবেচারা প্রশ্নাকুলতা দেখাইতেছেন, সন্দেহ জন্মে যে তাঁহারাও নিশ্চয়ই এই স্পষ্টোজ্জ্বল বিজেপি অ্যাজেন্ডারই সহচর, তাই উত্তরের ছলে কিছু অবান্তর অপ্রয়োজনীয় অজুহাতের জায়গা করিয়া দিতেছেন। যে দেশে কয়েক বৎসর যাবৎ গোমাংস ভক্ষণের সত্য কিংবা মিথ্যা অভিযোগে এক বিশেষ ধর্মাবলম্বীদের গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়, যেখানে গোরক্ষা বাহিনী বিভিন্ন প্রদেশে লাগাতার হামলা হুমকি অত্যাচারে বিভিন্ন গোমাংস বা গোচর্মের কারবারি সম্প্রদায়কে ভয়ে কাঁটা করিয়া রাখে, নিরীহ দরিদ্র মানুষকে কেবল গরু লইয়া বিচরণ করিবার অভিযোগে পিটাইয়া হত্যা করে, এবং যে দেশে প্রশাসন তাহার সর্বৈব সমর্থনের নীরবতা অবিরাম ভাবে গোরক্ষক গুন্ডাদের দিকে প্রসারিত করিয়া দেয়— সেখানে কেন গবাদি পশু বিক্রয় বন্ধের বিধি পাশ হয়, তাহা কি প্রশ্ন করিয়া জানিবার বস্তু? বিজেপি সরকার কি ইতিমধ্যেই একটি বহুসম্প্রদায়-অধ্যুষিত প্রদেশে কসাইখানা বন্ধের নির্দেশ দেয় নাই? বুঝাইয়া দেয় নাই যে ইহা তাহাদের তর্জনীচালিত হিন্দুত্ববাদী জীবনযাপনের নির্দেশ?

প্রশ্ন নিষ্প্রয়োজন। প্রয়োজন কেবল বুঝিয়া লওয়া যে, গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ দেশের সাত দশকের যাত্রা সমাপ্ত। এই বার ধর্মান্ধ স্বৈরতান্ত্রিক ভারতের নাগরিক হিসাবে নিজেদের চিনিয়া লইবার সময় আসিয়াছে। যে দেশের বিরাট সংখ্যক মানুষের শতাব্দী-প্রাচীন অভ্যাস গোমাংস ভক্ষণ, তাহাদের এই বার নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করিতে খাদ্যাভ্যাস পাল্টাইতে হইবে। কিংবা যে মানুষরা গোমাংস খাক না খাক, গো-ব্যবসায়ে নিজেদের এত কাল নিরত রাখিয়াছে, নাগরিক হইতে গেলে তাহাদের অন্য জীবিকার সন্ধান করিতে হইবে। গোচর্মের কাজ করিয়া যে দরিদ্র জাতি দেশের বহুকোটিমূল্যের চর্মব্যবসায়ের স্তম্ভ হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে, নাগরিক হইবার সাধনায় তাহাদের এ বার বেকারত্ব স্বীকার করিতে হইবে। হিন্দু শাস্ত্র গোমাংস, গোচর্ম ইত্যাদি সত্যই নিষিদ্ধ করে কি না, সেই বিতর্ক বিশেষজ্ঞদের জন্য তোলা থাকুক। তবে অহিন্দুদের ধর্ম ও শাস্ত্র যে এই ভারতের রাজনীতি ও সমাজে অগ্রহণযোগ্য, এই বিধির সঙ্গে সঙ্গে তাহা প্রশ্নাতীত হইল।

বহুত্ববাদ, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নিধনের সঙ্গে আধুনিক ভারতের আর একটি বৈশিষ্ট্যও মৃত্যুমুখে পতিত হইল। তাহা যুক্তরাষ্ট্রীয়তা। সংবিধানমতে যে কয়েকটি বিষয় স্পষ্টতই রাজ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত, তাহার অন্যতম খাদ্য ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ। স্বাভাবিক। এই বৃহৎ দেশের বিভিন্ন প্রদেশের জনবিন্যাস বিভিন্ন রকমের, তাই খাদ্যাভ্যাস ও তৎসংক্রান্ত প্রশাসনিক সিদ্ধান্তও বিভিন্ন রকমের হওয়াই সঙ্গত। অথচ কোনও রাজ্যের সহিত কথা না বলিয়াই কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্ত। কেরল বা পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যের উচিত এই বিধির বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদ জ্ঞাপন। জনসমাজের মধ্যে বিভাজন তৈরি হইলে তাহা প্রথমে রাজ্য রাজনীতিকেই বিপন্ন করিবে, সুতরাং রাজ্য সরকারের অতি গুরুত্বসহকারে বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত। কেরলের পরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এই বিধির প্রতিবাদ করিয়াছেন। আশা করা যায়, প্রতিবাদের বলয় প্রসারিত হইবে।

pluralism democracy modern India
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy