Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

একা পুরুষ নয়, সমাজে মহিলাদেরও মর্যাদা আছে

বিদ্যাসাগর যন্ত্রণায় কাতর হলেন। তিিন অনুভব করলেন, নারীর যতই বুদ্ধি থাক উচ্চশিক্ষা ব্যতীত উৎকর্ষতা লাভ সম্ভব নয়। লিখছেন দেবযানী ভৌমিক চক্রবর্তীআমরা যে অদম্য মনোবলের দৃষ্টান্তস্বরূপ বিদ্যাসাগরকে জানি, সেটা নিশ্চিত ভাবেই তাঁর ঠাকুমা দুর্গাদেবীর সূত্রেই প্রাপ্ত, এ কথা তো বলাই যায়।

অঙ্কন: কুণাল বর্মন

অঙ্কন: কুণাল বর্মন

শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:৪২
Share: Save:

কথায় আছে, আমাদের রক্তে পূর্বপুরুষের বাস। পূর্বনারী কি নেই! অন্তত বিদ্যাসাগরের জীবন পর্যালোচনা করলে তো এই বক্তব্যের সমর্থনই মেলে যে, রক্তে পূর্বনারীর প্রভাব তীব্র ভাবেই সক্রিয় থাকে। একটু আগে থেকেই শুরু করা যাক তবে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ঠাকুর্দা রামজয় তর্কভূষণ ছিলেন খ্যাতিমান পণ্ডিত। কিন্তু দারিদ্র তাঁর নিত্যসঙ্গী। এ দিকে ভাইদের সঙ্গে সদ্ভাবের অভাব। এক সময় সংসারে চরম বিরক্ত রামজয় গৃহত্যাগী হলেন। তাঁর স্ত্রী দুর্গাদেবী সন্তানদের মুখ চেয়ে অগত্যা বাপের বাড়ি বীরসিংহ গ্রামে চলে এলেন। প্রবল আত্মমর্যাদাবোধ তথা সন্তানদের প্রতি দায়বদ্ধতায় বাপের বাড়ির অসম্মানের অন্ন তাঁর বেশি দিন রুচল না। সেই গ্রামেই কাঁচা ঘর তৈরি করে পুত্র, কন্যা-সহ তিনি বাস করতে শুরু করলেন। তাঁর পুত্র ঠাকুরদাস অর্থ রোজগারের তাগিদে অল্প বয়সেই কলকাতায় চলে আসেন। মায়ের মতো তাঁরও ছিল অদম্য জেদ ও সততা। তাঁরই সন্তান বিদ্যাসাগর। আমরা যে অদম্য মনোবলের দৃষ্টান্তস্বরূপ বিদ্যাসাগরকে জানি, সেটা নিশ্চিত ভাবেই তাঁর ঠাকুমা দুর্গাদেবীর সূত্রেই প্রাপ্ত, এ কথা তো বলাই যায়।

১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে বিদ্যাসাগরের জন্ম। ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও ভগবতী দেবীর এই সন্তান বাংলার মাটিতে নবচেতনাবোধের বিকাশ ঘটান। পুরনো ধ্যান-ধারণা, গতানুগতিক চিন্তাভাবনা তথা অন্ধবিশ্বাসের যে মজবুত স্তম্ভটি সমাজ উন্নতির মূলে অন্তরায় হিসেবে দাঁড়িয়েছিল সেটি উৎপাটনে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। ইতিপূর্বে রামমোহন রায় যে সমাজ সংস্কার আন্দোলন শুরু করেছিলেন সেটিকেই আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে দিলেন তিনি। এ ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের মায়ের ভূমিকাও অনস্বীকার্য। সন্তানকে নিজ সিদ্ধান্তে ঋজু থাকার দীক্ষা তিনি দিয়েছিলেন।

দারিদ্রকে সঙ্গী করেই বেড়ে ওঠা তাঁর। কিন্তু অন্তরের ঐশ্বর্যে তিনি রাজাধিরাজ। গ্রামের পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষালাভের পরে মাত্র ন’বছর বয়সে বাবার সঙ্গে কলকাতায় চলে আসেন। বড়বাজারে ভাগবতচরণ সিংহের বাড়িতে আশ্রয় নেন। সংস্কৃত কলেজে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হলেন। পর পর পরীক্ষায় বিশেষ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখলেন। ফলে পারিতোষিকও লাভ করলেন। একে একে সাহিত্য, অলঙ্কার, বেদান্ত, স্মৃতি, জ্যোতিষ, ন্যায়শাস্ত্র ইত্যাদিতে সাফল্যের সঙ্গে পাঠ সম্পন্ন করলেন। স্মৃতি শ্রেণিতে অসাধারণ কৃতিত্বের জন্যই তিনি বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ করেন। ১৮৩৯ সালে ‘হিন্দু ল’ কমিটি’-র পরীক্ষা শেষে প্রদত্ত শংসাপত্রে প্রথম তাঁর নামের আগে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধিটি ব্যবহার করা হয়।

বিদ্যাসাগরের ইতিমধ্যেই, মাত্র পনেরো বছর বয়সে সুপণ্ডিত শত্রুঘ্ন ভট্টাচার্যের কন্যা দিনময়ী দেবীর সঙ্গে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। বিদ্যাসাগরের জীবনে দিনময়ী দেবীর প্রভাব সে ভাবে কোথাও লেখা না হলেও আমরা এটুকু বুঝতেই পারি যে, তাঁর সকল কর্মপন্থায় অবশ্যই স্ত্রীর সমর্থন ছিল। না হলে তিনি সমাজ সংস্কারকের ভূমিকায় নিজেকে এতটা যুক্ত রাখতে পারতেন না। যদিও পুত্রের সঙ্গে বিধবার বিয়ে দেওয়ার সময়ে তিনি বিরোধিতা করেছিলেন বলে জানা যায়।

মাত্র একুশ বছর বয়সে তিনি ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের প্রধান অধ্যাপকের পদে নিযুক্ত হন। পাঁচ বছর তিনি সেখানে ছিলেন। এর পরে ১৮৪৬ সালে সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পাদকের পদে যোগ দেন। এ সময় থেকেই তিনি শিক্ষা তথা সমাজ সংস্কারের বিষয়গুলি বাস্তবায়নের কর্মসূচি নিতে থাকেন। যদিও দীর্ঘ দিন ধরে চলা সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু করা সহজ কাজ নয়। এ ক্ষেত্রে তাঁকেও বহু বাধার সম্মুখীন হতে হয়। বিদ্যাসাগর যে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতিকল্পে রিপোর্ট পেশ করেছেন কর্তৃপক্ষের কাছে, তাতে বেজায় চটেন সম্পাদক রসময় দত্ত। জি টি মার্শাল সাহেব ওই রিপোর্টের ভূয়সী প্রশংসা করলেও রসময়বাবুর প্রতি মুহূর্তের দুর্ব্যবহার বিদ্যাসাগরের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হয় না। ফলে আত্মমর্যাদাবোধের দৃঢ়তায় পরের বছরই তিনি ওই পদে ইস্তফা দেন। যদিও বেশি দিন তাঁকে কর্মহীন থাকতে হয়নি। ১৮৫০ সালে তিনি ওই কলেজেই সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। আর এক বছর পরেই সংস্কৃত কলেজেরই অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পান। এ ছাড়া বিদ্যালয় পরিদর্শক হিসেবেও কাজ শুরু করতে হয় তাঁকে। একাগ্রতা, নিষ্ঠা, অধ্যাবসায় তথা দায়ভার বহনের ক্ষমতা ইত্যাদি গুণে তাঁর বেতন বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করা হয় যা ১৮৫১ সালের নিরিখে অনেকটাই।

প্রশাসনিক কাজ পেয়ে তাঁর সুবিধেই হল। বিশেষত বিদ্যালয় পরিদর্শকের কাজে বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে ঘুরে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি আরও সচেতন হলেন। এ কী অশিক্ষার অন্ধকার ঘিরে রেখেছে তাঁর জন্মভূমিকে! বড় বেদনা অনুভব করলেন তিনি। মাত্র দু’মাসের মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে কুড়িটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেন। ইতিপূর্বে মধ্যযুগীয় বাতাবরণে সমাজে নারীজাতির কোণঠাসা অবস্থা হয়েছিল। পর্দানসীন নারীর ছিল না মানবোচিত সম্মান। সেখানে শিক্ষা তো দূর অস্ত্্! অথচ আমাদের দেশের ঐতিহ্যের মধ্যে রয়েছে নারীজাতিকে সম্মান প্রদর্শন। অনেক বেদজ্ঞ নারীর কাছে পুরুষের পরাজয়ের কাহিনি সুপ্রচলিত আজও। অথচ সেই নারীকুলের এমন পরিস্থিতিতে মানবদরদী বিদ্যাসাগর নিতান্তই যন্ত্রণায় কাতর হলেন। তিিন অনুভব করলেন, নারীর যতই বুদ্ধি থাক উচ্চশিক্ষা ব্যতীত উৎকর্ষতা লাভ সম্ভব নয়। দীর্ঘ দিন ধরে অবহেলিত, শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত নারীদের জন্য নিজে অক্লান্ত পরিশ্রম করে তিরিশটি স্কুল স্থাপন করলেন তিনি। কথাটা স্ববিরোধী শোনালেও অপ্রিয় সত্য এটাই যে, ভিনদেশি শাসকেরা ছিলেন বলেই তিনি তাঁর চিন্তাভাবনাগুলিকে বাস্তব রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। বিরোধিতা করেছিলেন এ দেশেরই কিছু লোকজন। যদিও পরাধীনতার গ্লানি তো তাঁরও ছিল। কোনও ভাবেই পরাধীনতা মেনে নেওয়া যায় না। কিন্তু আমাদের দেশ যে অজ্ঞানতার অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছিল তা থেকে উদ্ধারের পথটি দেখানো ও কার্যকর করাটা বোধ হয় অকল্পনীয়ই থাকত। নবচেতনার যে ধারায় স্নাত হলেন আমাদের দেশীয় সংস্কারকগণ, সেটাও কিন্তু পাশ্চাত্য শিক্ষা সভ্যতার হাত ধরেই।

শিক্ষিকা, শ্রীপৎ সিং কলেজ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Vidyasagar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE