কাহারও প্রাণদণ্ড ঘোষণা করা অতি কঠিন সিদ্ধান্ত। আর, নির্দোষের প্রাণদণ্ড? কেবল নির্দোষ নহে, সম্পূর্ণ অসহায়, ক্ষমতাহীন? সেই সিদ্ধান্তের অভ্যন্তরীণ জটিলতার বুঝি সীমাপরিসীমা নাই। সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি দীপক মিশ্র ও বিচারপতি এম খানউইলকরের বেঞ্চকে তেমনই একটি সিদ্ধান্ত করিতে হইল। বারাসতের যে দম্পতি বিশ সপ্তাহের অধিক বয়সি ভ্রূণের গর্ভপাত করাইবার আর্জি লইয়া আদালতের দ্বারস্থ হইয়াছিলেন, তাঁহাদের নিকট গর্ভস্থ সন্তানের জন্ম এক দুঃস্বপ্নে পর্যবসিত হইয়াছিল। জটিল হৃদ্রোগে আক্রান্ত সেই ভ্রূণ ভূমিষ্ঠ হইলেও যে তাহার বাঁচিবার সম্ভাবনা নিতান্ত ক্ষীণ, চিকিৎসকরা সে কথা জানাইয়া দিয়াছিলেন। অর্থাৎ, এই দম্পতির নিকট সন্তানের জন্ম শুধু তাহার মৃত্যুর প্রতীক্ষা হইত। মহামান্য শীর্ষ আদালত দম্পতিকে সেই যন্ত্রণা হইতে মুক্তি দিয়াছে। আদালতের সিদ্ধান্তটি দুই দিক হইতে সংবেদনশীল। এক, আদালত এই দম্পতির সমস্যাটি অনুধাবন করিয়াছে— ২০ সপ্তাহের পর গর্ভপাত আইনে নিষিদ্ধ বলিয়া তাঁহাদের ফিরাইয়া দেয় নাই। দুই, কত সপ্তাহ অবধি গর্ভপাত করানো চলিতে পারে, সেই ফয়সালা যে প্রতিটি মামলার নিজস্ব চরিত্র অনুযায়ী হইবে, এই কথাটি ভুলিয়া যায় নাই। একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর গর্ভপাত করাইবার অনুমতির উপর কড়াকড়ি নিতান্ত অকারণ নহে। সদ্যনিষিক্ত ভ্রূণ হইতে সম্পূর্ণ একটি মানুষ— গর্ভধারণের মেয়াদটিতে গর্ভস্থের চরিত্র ক্রমে বদলাইয়া যায়। ফলে, কোন পর্যায় হইতে তাহাকে একটি পূর্ণ প্রাণের মর্যাদা দেওয়া হইবে, তাহা নির্ধারণ করা জরুরি বইকি। ২০ সপ্তাহের সীমারেখাটি এই ক্ষেত্রে একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিভাজিকা। নিতান্ত নাচার না হইলে সেই গর্ভস্থ প্রাণটিকে নষ্ট করিবার অধিকার কি স্বয়ং গর্ভবতীরও থাকিতে পারে? আদালতের সিদ্ধান্ত এই প্রশ্নটিকে এ়ড়াইয়া যায় নাই।
এক্ষণে মূল প্রশ্নটি অধিকারের। শরীরের উপর অধিকার, জীবনের উপর অধিকার। সুপ্রিম কোর্ট তাহার রায়ে জানাইয়াছে, সব মহিলারই নিজের শরীরের উপর অলঙ্ঘনীয় অধিকার আছে। যে শিশুর বাঁচিয়া থাকিবার কার্যত কোনও সম্ভাবনাই নাই, তাহাকে গর্ভে ধারণ না করিবার অধিকার মহিলার আছে। কেহ প্রশ্ন করিতেই পারেন, সন্তানটি ভূমিষ্ঠ হইলে যে কোনও মতেই বাঁচিবে না, চিকিৎসাশাস্ত্র কি এমন নিশ্চয়তা দিতে পারে? উত্তরটি নেতিবাচক, তবে বিজ্ঞানের দুনিয়ায় নিশ্চয়তার তুলনায় সম্ভাব্যতারই আধিপত্য। গর্ভস্থ শিশুটির বাঁচিবার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ হওয়ায় এই ক্ষেত্রে গর্ভবতী মহিলাটির অধিকারই গুরুত্ব পাইয়াছে। তাহা হওয়াই বিধেয়।
কোনও গর্ভস্থ শিশুর মৃত্যু যদি এতখানি সম্ভাব্য না হয়, কিন্তু গর্ভবতী মহিলাটি যদি কোনও অনতিক্রম্য কারণে গর্ভপাত করাইতে চাহেন? সে ক্ষেত্রে প্রশ্নটি ভিন্ন। কারণ, মায়ের অধিকার ও শিশুর অধিকারের মধ্যে সংঘাত প্রত্যক্ষ। নিজের শরীরের উপর মহিলার যেমন অধিকার আছে, তেমনই গর্ভস্থ শিশুটির জীবনের অধিকারও অনস্বীকার্য। আদালতের রায়টি এখানেই গুরুত্বপূর্ণ যে ২০ সপ্তাহের পর শুধুমাত্র মায়ের ইচ্ছাক্রমে গর্ভপাত করাইবার ঢালাও ছাড়পত্র দেওয়া হয় নাই। কোন ক্ষেত্রে মায়ের অধিকার শিশুর জীবনের অধিকারের তুলনাতেও গুরুত্বপূর্ণ হইবে, একমাত্র সেই বিচার হইতেই এই গোত্রের মামলায় সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব। যে ক্ষেত্রে সন্তানের জন্ম দেওয়া মায়ের পক্ষে প্রাণঘাতী হইতে পারে, সম্ভবত শুধুমাত্র তেমন ক্ষেত্রেই এই অনুমতি দেওয়া চলিতে পারে। এবং, গর্ভপাতের সিদ্ধান্তে যদি মহিলার পূর্ণ সম্মতি থাকে, তবেই। নির্দিষ্ট মেয়াদের পূর্বে গর্ভপাত আর মেয়াদ অতিক্রান্ত হইবার পর গর্ভপাত যে এক নহে, এই কথাটি অস্বীকার করিবার কোনও উপায় নাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy