Advertisement
E-Paper

সক্ষমতার সহজপাঠ

এমন কাজ নজর টেনেছে। যে মেয়ে জীবনে কোনও দিন রেলে চাপেনি, সে প্লেনে চেপে গিয়েছিল নিউ ইয়র্কে। রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপদ মাতৃত্বের অধিবেশনে (২০১৫) ভারতের প্রতিনিধি ছিল সে।

স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২২ মে ২০১৮ ০০:০৮

ওই যে কাঠকুটো, ওগুলো মেয়েটি (ছবিতে) কুড়িয়ে এনেছে। দশটায় বেরোলে বেলা তিনটে হয়ে যায় কাঠ নিয়ে ফিরতে। তার পর মাটি-লেপা উনুনে হাঁড়ি বসানো। আদিবাসী মেয়ে, উজ্জ্বলা প্রকল্পের গ্যাস তারই আগে পাওয়ার কথা। আবেদন করেছে, কিন্তু...

কিন্তু আজও গ্যাস মেলেনি। তাই উনুনে হাঁড়ি বসিয়ে চাল ধোয়। বাইশ টাকা কিলোয় কেনা চাল। রেশনের দু’টাকা কিলোর চাল ও পায় না। কেন? ডিলার বলেছে, ওর কার্ডে নেই। কই কার্ড? তাতে তো লেখা, চিনি ছাড়া সবই মেলার কথা ওর। কিন্তু...

কিন্তু কেরোসিন ছাড়া কিছুই জোটে না। স্বামী রাজমিস্ত্রির হেল্পার, মেয়েটিও খাটে। অন্যের ধান কেটে, ঝেড়ে, গোলায় তুলে পায় একশো কুড়ি টাকা। সে কী, খেতমজুরের ন্যূনতম মজুরি তো একশো আশি টাকা? তা হবে, ও জানে না। দক্ষিণ দিনাজপুরের ব্লক কুশমাণ্ডি, গ্রাম পঞ্চায়েত দেউল। সেখানে মেয়েরা মজুরি কমই পায় পুরুষদের থেকে। যা পায়, তা-ই নেয় হাত পেতে। দুই সন্তানকে ভাত দিতে হবে।

কত বড়? ছোটটার বয়স পাঁচ। আর মায়ের? একুশ। সে কী, কবে বিয়ে হয়েছিল? চোদ্দো বছরে। পর পর দুই বছর দুই কন্যা। ষোলো বছরে দ্বিতীয় বার জন্ম দিতে গিয়ে রক্তে ভেসে মরতেই বসেছিল। ইস্কুলের পড়া বন্ধ হল। কিন্তু...

এই ‘কিন্তু’ বইছে উজানে। এ বছর মাধ্যমিক দিয়েছে একুশ বছরের মেয়েটি। টিউশন জোটেনি, ইস্কুল-মাস্টারই ভরসা। সোলার ল্যাম্পে পড়া। দুপুরেও রাতের মতো অন্ধকার ওর মাটির ঘরে।

অথচ রোগাপাতলা মেয়েটির নামের আলো ছড়িয়ে পড়েছে গোটা জেলায়। অকালে অপুষ্ট সন্তানের জন্ম না দেয় মেয়েরা, সেই প্রচারের মুখ এই মেয়ে। স্কুলপড়ুয়ার বিয়ে হচ্ছে, শুনলেই ছুটে যায়। ধমকানি, শাসানি গায়ে মাখে না। একটি অসরকারি সংস্থা আছে পাশে। বিডিও, সভাপতি সাহায্য করেন। গত বছর তিনেকে সাতটা বিয়ে নাকি আটকেছে মেয়েটি। তারা এখনও স্কুলে পড়ছে।

এমন কাজ নজর টেনেছে। যে মেয়ে জীবনে কোনও দিন রেলে চাপেনি, সে প্লেনে চেপে গিয়েছিল নিউ ইয়র্কে। রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপদ মাতৃত্বের অধিবেশনে (২০১৫) ভারতের প্রতিনিধি ছিল সে। এখন কলকাতার নানা অনুষ্ঠানেও ডাক পড়ে। এ বার ঘাসফুল দল পঞ্চায়েতে দাঁড়াতে বলেছিল। মেয়েটির ইচ্ছেও ছিল, কিন্তু...

কিন্তু শ্বশুরবাড়ি রাজি নয়। বাড়ির বৌ ভোটে দাঁড়াবে? হল না।

এমন মেয়েরাই আজ সক্ষমতার ‘পোস্টার গার্ল।’ তাদের সাহস, পরিশ্রম সত্যিই অবাক-করা। কিন্তু কাছে গেলে মনে হয়, যেন মাটির প্রতিমার পিছনটা দেখছি। অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী নিজে ভোগে রক্তাল্পতায়। মিড-ডে মিলের রাঁধুনির শিশুসন্তান অপুষ্ট। আর আশাকর্মী? এই সে দিন ট্রেনিং চলছিল আশাদিদিদের। তার মধ্যে খবর এল, তাদের এক জনের মেয়েকে পুড়িয়ে মেরেছে শ্বশুরবাড়ি। দু’দিন আগে সেই মেয়েই মাকে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল গঙ্গারামপুরের ট্রেনিং সেন্টারে। কিসের ট্রেনিং? গার্হস্থ্য নির্যাতন প্রতিরোধ।

প্রকল্পের দিকে চাইলে মনে হয়, কী না পেয়েছে মেয়েরা? কন্যাশ্রীর টাকা, সবুজসাথীর সাইকেল, জননী সুরক্ষা যোজনার সহায়তা। আর মেয়েদের দিকে চাইলে মনে হয়, কী পেল মেয়েরা? সেই তো না-পছন্দ পাত্রে বিয়ে, সংসারে হাড়খাটুনি, ঘরে-বাইরে রক্তচক্ষু। এমন নয় যে গরিব মেয়েরা সরকারি-অসরকারি নানা প্রকল্পের কলাটা-মুলোটা পায়নি। পেয়েছে, কিন্তু তা দিয়ে কী করতে পেরেছে? কতটা বদলাতে পেরেছে নিজের জীবনটাকে?

‘ন্যায়’ বলতে কী বুঝব, তার উত্তর দিতে গিয়ে এই প্রশ্নই তুলেছিলেন অমর্ত্য সেন। দার্শনিক জন রলস্ বলেছিলেন, মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটাতে যা যা নিতান্ত দরকার, তা দেওয়াই হল ন্যায্য কাজ। কিন্তু অমর্ত্য বললেন, ক’টা জিনিস দিলেই হবে না। তা দিয়ে মানুষ তার কাঙ্ক্ষিত কাজ করতে পারছে কি? তার জীবন কি সার্থকতার দিকে যাচ্ছে? ‘মানুষ কী পারল’, তা না দেখে, কেবলমাত্র ‘মানুষ কী পেল,’ তা দেখব কেন? তা হলে শেষে মনে হবে, ওই বিতরণ করার জিনিসগুলোই যেন ‘ন্যায়।’

আজ ঠিক তা-ই হয়েছে। এটা-ওটা বিলি করাকেই মনে হচ্ছে গরিবের প্রতি, মেয়েদের প্রতি ন্যায়। তাতে কাজ কী হল, সেটা দেখার দরকার বলেই মনে হচ্ছে না। আদিবাসী মেয়েটিকে যেমন কেঁচো সারের চৌবাচ্চা করে দিয়েছে পঞ্চায়েত, কিন্তু কেঁচো দেয়নি, ট্রেনিংও দেয়নি। অথচ একশো দিনের কাজে জৈবসার প্রকল্পের ‘বেনিফিশিয়ারি’ তালিকায় নির্ঘাত উঠে গিয়েছে ওর নাম। সায়া সেলাই কিংবা গামছা বোনার ট্রেনিং দিলেই ধরা হয়, ‘স্বনির্ভর’ করা হল। পঞ্চান্ন টাকার সুতোয় গামছা বুনে বাষট্টি টাকায় বিক্রি করে মেয়েটা কেমন আছে, কে দেখতে যাচ্ছে? মুরগিছানার নাম ‘স্বরোজগার’, হাসপাতাল বেডের নাম ‘জননী সুরক্ষা,’ পঞ্চায়েত অফিসে প্লাস্টিকের চেয়ারটার নাম ‘রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন।’

মানুষ যা চায়, আর প্রকল্প যা দেয়, সে দুটোর সংযোগ হল তো হল, না হল তো হল না। এই কেয়ার-না-করার ছাপ এখন এনজিও-দের মধ্যেও। যে মেয়ে নাবালিকার বিয়ে বন্ধ করতে পারে, সে কেন নিজের প্রাপ্য রেশন, মজুরি আদায় করতে পারে না, এ প্রশ্ন ওঠে না ট্রেনিং-বাগীশ দাদা-দিদির মনে। কেন উঠবে? এটা হল চাইল্ড ম্যারেজ, আর ওটা হল মিনিমাম ওয়েজ। ওটা আমার প্রজেক্ট নয়।

ছিল মানুষ, হল ‘টিক’ চিহ্ন। এ অপমানের সান্ত্বনা নেই। কিন্তু ...

কিন্তু কুশমাণ্ডির সুবর্ণপুর গ্রামের মেয়েটির নাম সান্ত্বনা মুর্মু।

Santona Murmu Poverty poster girl
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy