Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

স্লোভাকিয়া দূর নহে

কাপুতোভা রাজনীতির বাহিরের দুনিয়ার মানুষ। ইউরোপের নানা দেশেই (ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমেরিকায়) সাম্প্রতিক কালে পরিচিত রাজনীতিকদের উপর বীতশ্রদ্ধ হইয়া নাগরিকরা রাজনীতির বাহিরের মানুষদের ক্ষমতায় বসাইয়াছেন, এমন দৃষ্টান্ত অনেক।

ভোটে জিতে বক্ত‌ৃতা দিচ্ছেন জ়ুজ়ানা কাপুতোভা। ছবি এএফপি।

ভোটে জিতে বক্ত‌ৃতা দিচ্ছেন জ়ুজ়ানা কাপুতোভা। ছবি এএফপি।

শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৯ ০০:৩৫
Share: Save:

সোভিয়েট যুগে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি সম্পর্কে ভারতের, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক সমাজে যে আগ্রহ ছিল, ঐতিহাসিক কারণেই তাহার কানাকড়িও অবশিষ্ট নাই। অতএব চেকোস্লোভাকিয়ায় ১৯৬৮ সালের ‘প্রাগ স্প্রিং’ নামে খ্যাত অভ্যুত্থান ও রেড আর্মির ট্যাঙ্ক দিয়া সেই বসন্তনির্ঘোষকে চূর্ণ করিবার কাহিনি আজও যাঁহাদের হৃদয়কে আলোড়িত করে, তাঁহারাও অনেকেই বোধ করি জ়ুজ়ানা কাপুতোভার নির্বাচনী সাফল্যের বিষয়ে বিশেষ অবহিত নহেন। এই অনাগ্রহ দুর্ভাগ্যজনক, কারণ ভূতপূর্ব চেকোস্লোভাকিয়ার অংশ, ১৯৯৩ সাল হইতে স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্র স্লোভাকিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রাথমিক পর্বেই ৫৮ শতাংশ ভোট পাইয়া কাপুতোভার জয়লাভ কেবল তাঁহার দেশের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ নহে, পূর্ব ইউরোপ তথা বৃহত্তর দুনিয়ার পক্ষেও তাৎপর্যপূর্ণ। ভারত সেই দুনিয়ার বাহিরে নহে।

কাপুতোভা রাজনীতির বাহিরের দুনিয়ার মানুষ। ইউরোপের নানা দেশেই (ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমেরিকায়) সাম্প্রতিক কালে পরিচিত রাজনীতিকদের উপর বীতশ্রদ্ধ হইয়া নাগরিকরা রাজনীতির বাহিরের মানুষদের ক্ষমতায় বসাইয়াছেন, এমন দৃষ্টান্ত অনেক। কিন্তু ইউরোপে (ও ট্রাম্প-ভূমিতে) অ-রাজনীতিকরা অনেকেই জনপ্রিয় হইয়াছেন অভিবাসী-বিরোধী অসহিষ্ণু সঙ্কীর্ণ অতিজাতীয়তাবাদের জোরে। দেশের মানুষকে তাঁহারা বুঝাইয়াছেন যে, অভিবাসী তথা অন্য দেশের, অন্য ধর্মের, অন্য জাতির মানুষই তাঁহাদের সমস্যার কারণ, দেশের দরজা বন্ধ করিয়া তাহাদের ঠেকাইয়া ‘স্বাধিপত্য’ জারি করিলেই সমাধান মিলিবে। হাঙ্গেরির ভিক্তর অরবান বা পোলান্ডের ল অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি এই ধরনের দক্ষিণপন্থী প্রকল্প হইতেই রাজনৈতিক মুনাফা লুটিতেছে। স্লোভাকিয়াতেও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দক্ষিণপন্থীরা প্রায় পঁচিশ শতাংশ ভোট পাইয়াছেন। কিন্তু কাপুতোভা সেই কুরাজনীতির বিপরীতে দাঁড়াইয়া যথার্থ উদার, বহুত্ববাদী আদর্শের পক্ষে কথা বলিয়াছেন। পরিবেশ আইনের বিশেষজ্ঞ হিসাবে জনসংগঠনের অভিজ্ঞতাকে তিনি এই সুরাজনীতির পক্ষে জনমত গড়িবার কাজে সফল ভাবে ব্যবহার করিয়াছেন। এমনকি, সম্মিলিত ইউরোপের অংশীদার হিসাবে, অভিবাসীদের প্রতি স্লোভাকিয়ার দায়িত্বের কথা প্রত্যয়ের সহিত বলিতে তিনি কিছুমাত্র দ্বিধা করেন নাই।

ভোটের ফল বলিতেছে, তাঁহার দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এই শুভবুদ্ধির কথা মানিয়া লইয়াছেন। অনুমান করা যায়, সুস্থ এবং উদার আদর্শ ও নীতির সপক্ষে প্রত্যয়ের সহিত দৃঢ়স্বরে কথা বলিতে পারিবার সামর্থ্যই এই সমর্থনের একটি বড় উৎস। স্লোভাকিয়া হইতে ভারত অনেক দূরে, দুই সমাজের দূরত্ব হয়তো বিপুলতর। কিন্তু কোনও সন্দেহ নাই, ভারতে যাঁহারা উদারপন্থী রাজনীতির পথে থাকিতে চাহেন তাঁহাদের কণ্ঠে প্রত্যয়ের রীতিমতো অভাব আছে। সম্ভবত তাঁহাদের চিন্তাতেও প্রত্যয়ের অভাব। অসহিষ্ণু অতিজাতীয়তাবাদের যে দাপট আজ এই দেশে প্রকট, তাহাকে প্রতিহত করিতে চাহিলে এই প্রত্যয় যথেষ্ট নহে, কিন্তু জরুরি। স্লোভাকিয়ার ভোটকে ‘ব্রাতিস্লাভা স্প্রিং’ বলা চলে না, বলিবার প্রয়োজনও নাই। কিন্তু রাজনীতির সম্ভাবনা কোথায়, কতখানি, তাহার মূল্যবান শিক্ষা এই নির্বাচন হইতে পাঠ করা যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Slovakia Zuzana Caputova
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE