Advertisement
E-Paper

ক’টা দোলনা আর একটু সহমর্মিতা, ব্যস

কাজের জায়গায় একটা চলনসই ক্রেশ থাকলেই চাকরি করা মায়ের জীবনের গল্প অন্য রকম হত। তাঁর দক্ষতা এবং সময় পরিপূর্ণ ভাবে ব্যবহার করে সংস্থাও লাভবান হত। কিন্তু সে কথা আমাদের অফিসরা কবে বুঝবে?মা হওয়ার পর চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল মেয়েটি। স্বামী-স্ত্রী-র সংসার। বাড়িতে বাচ্চা দেখার কেউ নেই। শুধু আয়ার ভরসায় ছোট্ট শিশুকে ছেড়ে আসার সাহস পায়নি সে। সন্তানের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সম্ভাবনাময় কেরিয়ার বিসর্জন দিয়ে অবসাদের রোগী হয়েছিল সেই মেয়ে।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০০

মা হওয়ার পর চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল মেয়েটি। স্বামী-স্ত্রী-র সংসার। বাড়িতে বাচ্চা দেখার কেউ নেই। শুধু আয়ার ভরসায় ছোট্ট শিশুকে ছেড়ে আসার সাহস পায়নি সে। সন্তানের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সম্ভাবনাময় কেরিয়ার বিসর্জন দিয়ে অবসাদের রোগী হয়েছিল সেই মেয়ে।

কিংবা সেই মেয়েটি, যার বাড়িতে পরিজনেরা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন, আয়া ঠিকঠাক বাচ্চাকে দেখছে কি না সে দিকে তাঁরা নজর রাখতে পারবেন না। অফিসে এসে প্রতি মুহূর্তে উদ্বেগ— আয়া ঠিকঠাক যত্ন করছে তো? মারছে না তো? কামাই করবে না তো? সেই সঙ্গে বাচ্চাকে সময় দিতে না-পারার আত্মগ্লানি। কাজের মান খারাপ হচ্ছিল। বাড়ি যাওয়ার তাড়া আর কামাই দু’টোই বাড়ছিল। কাজের জায়গায় কিছুদিনের মধ্যেই ফাঁকিবাজ কর্মীর তালিকাভুক্ত হয়ে পড়ে সে। ঘর-বাইরের টানাপড়েনে দিশেহারা হয়ে পড়ে সে।

নিজেদের কাজের জায়গায় একটা চলনসই ক্রেশ থাকলেই এই মেয়েদের জীবনের গল্প অন্য রকম হত। তাঁর দক্ষতা এবং সময় পরিপূর্ণ ভাবে ব্যবহার করে সংস্থাও লাভবান হত। কিন্তু বেসরকারি অফিস দূরে থাক, এ দেশে বেশির ভাগ সরকারি অফিসের ভাবনার কক্ষপথেই এখনও ক্রেশের প্রয়োজনীয়তার কথা ঢোকেনি।

অনেক পুরুষকর্মীদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায় এবং বাচ্চা বাবার কাছে থাকে, অথবা তাঁর স্ত্রী অসুস্থ থাকতে পারেন, চাকরির প্রয়োজনে অন্যত্র যেতে পারেন বা মারা যেতে পারেন। তখন বাচ্চা মানুষ করার ক্ষেত্রে পুরুষ কর্মীদেরও বড় সহায় হয়ে ওঠে অফিসের ক্রেশ। শ্রম আইনে কাজের জায়গায় কর্মীদের কিছু বাধ্যতামূলক সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে ক্রেশ যার অন্যতম। অথচ সেই সহায়ক ব্যবস্থা গড়ার প্রতি রাষ্ট্র উত্‌সাহহীন।

ইদানীং বেঙ্গালুরু, মুম্বই, চেন্নাইয়ের মতো শহরে অন্তত বেসরকারি সেক্টরে অফিস ক্রেশের ব্যাপারে কিছুটা সচেতনতা এসেছে। ক্রেশের জন্য একই কমপ্লেক্সে বা কাছাকাছি এলাকায় জায়গা দিচ্ছে সংস্থা। সেখানে বাচ্চা রাখার জন্য কর্মীদের থেকে মাসমাইনে নেওয়া হচ্ছে। ক্রেশ চালু হওয়ার পর কর্মীদের চাকরি ছেড়ে অন্য সংস্থায় যাওয়ার প্রবণতা কমে গিয়েছে।

মহারাষ্ট্র সরকারের নগরোন্নয়ন দফতর ২০০৮ সালের জুন মাসে একটি নোটিফিকেশন জারি করে। তাতে বলা হয়, কোনও বেসরকারি সংস্থায় যদি ৫০০-র বেশি মহিলা কর্মী থাকেন তা হলে তাঁদের নতুন ভবন তৈরির সময় ক্রেশের জন্য জায়গা রাখতেই হবে। আরও এক ধাপ এগিয়ে ‘বম্বে মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন’ (বিএমসি) তাদের ‘ডেভেলপমেন্ট কন্ট্রোল রেগুলেশনস’ সংশোধন করে ঠিক করেছে, ২০০-র বেশি মহিলা কর্মী রয়েছে এমন সংস্থা মুম্বই শহরে নতুন ভবন তৈরি করতে গেলে সেখানে ক্রেশ থাকতেই হবে। এই ক্রেশের আয়তন হতে হবে ন্যূনতম ২০-৮০ স্কোয়্যার মিটার।

গত ২৩ এপ্রিল মহারাষ্ট্র পুলিশের প্রথম অফিস ক্রেশের উদ্বোধন হয়েছে সাঙ্গলি পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স-এ। নারী-পুরুষ উভয় শ্রেণির পুলিশকর্মীর ২৪টি শিশু সেখানে ভর্তি হয়ে গিয়েছে। ৬ মাস থেকে ১০ বছর বয়সি শিশুরা সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত ক্রেশে থাকতে পারবে।

গত বছরের শেষ দিকে তামিলনাড়ুর নাগেরকয়েল-এ কালেক্টরেট বিল্ডিং ও সরকারি অফিস কমপ্লেক্সের পাশে ক্রেশ চালু করেছে কন্যাকুমারী জেলা প্রশাসন। চেন্নাইয়ে রাজ্য এবং কেন্দ্র সরকার পরিচালিত অনেক অফিসে এবং মহিলা পুলিশকর্মী পরিচালিত থানায় ক্রেশ রয়েছে। চেন্নাইয়ে সরকারি স্ট্যানলি হাসপাতালের শিশুবিভাগে ক্রেশ তৈরি হয়েছে। হাসপাতালে চিকিত্‌সার জন্য আসা মায়েরা প্রয়োজনে তাঁদের সঙ্গে নিয়ে আসা শিশুদের সেখানে ডে-কেয়ারে রাখতে পারেন।

সেই জায়গায় কলকাতা বা গোটা পশ্চিমবঙ্গই কোথায় দাঁড়িয়ে? কলকাতায় হাতেগোনা কয়েকটা জায়গা বাদ দিলে দূরবিন নিয়ে ঘুরলেও অফিস ক্রেশ মিলবে না। নবান্ন, নিউ সেক্রেটেরিয়েট, কোর্ট চত্বর, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, স্বাস্থ্য ভবন, ভবানীভবন, লালবাজারের মতো জায়গাই হোক কিম্বা শপিং কমপ্লেক্স, আইটি সেক্টর, ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টর, ব্যাঙ্ক— ক্রেশের ভাবনা সর্বত্র সমান ভাবে অনুপস্থিত। সল্টলেক আইটি সেক্টরে ২০১১ সালে এক বার তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলির সংগঠন ‘ন্যাসকম’ ক্রেশ তৈরির পরিকল্পনাই করেছিল মাত্র।

এখানে সরকারি হাসপাতালগুলিতে প্রতি দিন অসংখ্য মহিলা আসেন। তাঁরা হয় রোগী, বা তাঁর পরিজন। অধিকাংশই নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের। হাতে-কোলে একাধিক শিশু। সামলাতে না পেরে সঙ্গের শিশুকে পাশে বসে থাকা অপরিচিত মহিলার কাছে রেখে চিকিত্‌সকের কাছে বা ওষুধ আনতে যেতে হয়। কখনও কখনও এমনকী সেই অপরিচিতা শিশু সমেত উধাও হয়ে যান। হাসপাতালে একটা ক্রেশ থাকলে অসহায় এই মায়েদের অন্তত কিছুটা সুরাহা হত।

যে কাজের মহিলারা প্রতি দিন কাজ করতে আসেন তাঁদেরও এক সমস্যা। এঁদের অধিকাংশেরই বাড়িতে একাধিক বাচ্চা, দেখার কেউ নেই। বেশির ভাগ বাড়িতে বাচ্চা নিয়ে কাজে আসতে দেবে না। এঁদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে এমন একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতিনিধিরা জানান, ওই কাজের মহিলারা বাধ্য হয়ে অ-সুরক্ষিত পরিবেশে, বিনা নজরদারিতে বাচ্চাদের ছেড়ে আসতে বাধ্য হন। এঁদের শিশুদের মধ্যে তাই দুর্ঘটনায় মৃত্যু, লোপাট বা বিক্রি হয়ে যাওয়া, যৌন হেনস্থার হার মারাত্মক।

এই নিম্নবিত্ত এবং দারিদ্রসীমার নীচে থাকা কর্মরতা মহিলাদের শিশুদের জন্য ‘রাজীব গাঁধী জাতীয় ক্রেশ স্কিম’ চালু হয়েছিল। এই স্কিমে পশ্চিমবঙ্গে খাতায়-কলমে প্রায় ৯০০ ক্রেশ চলার কথা যেখানে নিখরচায় ওই মহিলারা নিজেদের বাচ্চাদের রেখে কাজে যেতে পারেন। কিন্তু খোদ সমাজকল্যাণ মন্ত্রীই জানিয়েছেন, সেগুলি কোথায়, কী ভাবে চলছে সে সম্পর্কে সরকারের কাছে কোনও খবরই নেই।

সমাজকল্যাণ বোর্ডের ওয়েবসাইটে দেওয়া এই রকম বেশিরভাগ ক্রেশেরই নম্বর ডায়াল করে দেখা যাচ্ছে, ‘ডাজ নট এগজিস্ট’! যে খেটে খাওয়া মহিলাদের ওই ক্রেশ দরকার তাঁদের ক্রেশের ফোন নম্বর বা ঠিকানা জানানো বা যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার কী ব্যবস্থা সরকার নিয়েছে? এই ক্রেশ আসলে চালানো উচিত বিভিন্ন মহল্লার যে বস্তি বা এলাকা থেকে কাজের মেয়েরা বেশি আসেন সেখানে কিংবা হাওড়া-শিয়ালদহ-ঢাকুরিয়া স্টেশন চত্বরের কাছে। কারণ রোজ অজস্র কাজের মেয়ে ট্রেনে করে কলকাতায় কাজে আসেন।

ঘরের পাশে বাংলাদেশেই কিন্তু কর্মক্ষেত্রে ক্রেশের ব্যাপারে নজরকাড়া কাজ হচ্ছে। বাংলাদেশে ছোট-বড় অসংখ্য জামাকাপড় তৈরির কারখানা প্রধানত বিদেশের সেরা সব ব্র্যান্ডের জন্য মাল সরবরাহ করে। প্রায় ১৫ লক্ষ কর্মী এই কাজে যুক্ত, যাঁদের ৯০ শতাংশ মহিলা। গড়ে দিনে ১২-১৪ ঘণ্টা তাঁদের কাজ করতে হয়, তার উপর ওভারটাইম। বেশ কিছু নামী আন্তর্জাতিক জামাকাপড়ের সংস্থা জানিয়ে দিয়েছে, যে কারখানায় মহিলা কর্মীদের জন্য শ্রম আইন মেনে ন্যূনতম সুযোগসুবিধা থাকবে না, সেখান থেকে তারা আউটসোর্সিং করবে না। এবং এই সুযোগসুবিধার অন্যতম হল মহিলা কর্মীদের বাচ্চাদের ক্রেশ।

কোটি কোটি টাকার ব্যবসা বলে কথা। এইটুকু হুমকিতেই ম্যাজিকের মতো কাজ হয়েছে। বাংলাদেশে ৩০০-র বেশি কাপড়ের কারখানা ক্রেশ চালাচ্ছে। জায়গা তারাই দিয়েছে। ক্রেশ পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে। ক্রেশকর্মীদের মাইনের দায়িত্ব সংস্থার। ঢাকা শহর ও তার আশপাশে ৩০টি জামাকাপড়ের কারখানায় এই রকম ক্রেশ চালায় ‘ফুলকি’ নামে একটি সংস্থা। সংস্থার প্রধান সুরাইয়া হক বললেন, ‘কারখানাগুলিতে এখনও অনেক ভাবে শ্রমিক-শোষণ চলে। পরিকাঠামো নিয়েও অনেক সমালোচনা-বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু ক্রেশের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ সিরিয়াস। কারণ তাঁরা বুঝেছেন ক্রেশে বাচ্চা থাকলে মহিলাকর্মীরা নিশ্চিন্তে অনেক ক্ষণ থেকে ভাল করে কাজ করেন, তাতে কারখানার লাভ।’

বেশ কিছু সংস্থা ফুলকির থেকে ট্রেনিং নিয়ে বিভিন্ন কাপড়ের কারখানায় ক্রেশ চালানোর দায়িত্ব নিয়েছে। যেমন ঢাকার সবুজের অভিযান, চট্টগ্রামের সংসপ্তক, অ্যাওয়েক সংস্থা। সুরাইয়া জানান, ফুলকি পরিচালিত ক্রেশে ২০-২৫টি করে বাচ্চা থাকে। নবজাতক থেকে ৬ বছর বয়সিরা এই সুবিধা পায়। বাচ্চা একটু বড় হলে তাঁকে স্থানান্তরিত করা হয় কাছাকাছি কমিউনিটি ক্রেশ-এ। মহিলা শ্রমিকেরা কারখানার কাছে যে বস্তিতে থাকেন সেখানেই ওই ক্রেশগুলি চলে। সেখানে পড়াশোনার ব্যবস্থা থাকে। বাচ্চাকে ক্লাস ওয়ানে ভর্তির জন্য তৈরি করে দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক, গ্রামীণ ফোন, রবি, বাংলা লিঙ্কের মতো সংস্থাতেও ফুলকি ক্রেশ চালাচ্ছে।

পশ্চিমবঙ্গে অন্তত কিছু প্রচেষ্টা কি আশা করা যায় না?

anandabazar post editorial parijat bandopadhay office creche
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy