Advertisement
E-Paper

খিস্তিমাত

টিআরপি-জমানায়, রাজনৈতিক বক্তৃতায় হাততালি গজাবার মহাদায় থাকে। আর, আমরাও কি দিনরাত অমানবিক খার ওগরাচ্ছি না? চন্দ্রিল ভট্টাচার্য।তাপস পালে বাঘ পড়েছে, আর রেস্ট অব দ্য ওয়ার্ল্ড নিরীহ ছাগ হয়ে ঘাস চিবু-চিবু, ব্যাপার এত পবিত্র নয়। শুধু তাপস তো নন, অনুব্রত মনিরুল অরূপ, অনিল বিমান আনিসুর, গাদিয়ে একই ওয়াগনে আদুড়ঝোলা।

শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০১৪ ০০:০০

তাপস পালে বাঘ পড়েছে, আর রেস্ট অব দ্য ওয়ার্ল্ড নিরীহ ছাগ হয়ে ঘাস চিবু-চিবু, ব্যাপার এত পবিত্র নয়। শুধু তাপস তো নন, অনুব্রত মনিরুল অরূপ, অনিল বিমান আনিসুর, গাদিয়ে একই ওয়াগনে আদুড়ঝোলা। কোশ্চেন: কেন? নবারুণ সৃজিতের শিল্প-প্রভাবে খিস্তি অধুনা হইহই হেপ? এই নেতারা সব্বাই ভয়াল ভিলেন, আর স্বরূপ লুকিয়ে রাখার কোচিং-ক্লাসও বাংক মেরেছেন? না কি, এ ট্র্যাডিশন চির-ফুটন্ত, আজি হতে ছশো বছর আগেও জন-কাপ্তেনগণ হুবহু এ ভাবেই লোক খ্যাপাতেন, এখন আচমকা স্টেরয়েড-ছুটন্ত মিডিয়ার পুচকে ক্যামেরা সর্বত্র কালোজিরের ন্যায় ছড়ায়েছে বলে সটাসট সব বক্তিমে ডকুমেন্টেড হয়ে যাচ্ছে? আন্দাজগুলো পাঁচ-সাত ভাগ ঠিক, কিন্তু মহাঠিক হল: এই বক্তারা প্রকাণ্ড প্রেশারে ছিলেন। টিআরপি-র প্রেশার।

লেখা, আঁকা, সকল শিল্পেই বহুত খসড়া করে, শেষে ফাইনাল বয়ান। তাই শুধরে নেওয়ার, জিভ কেটে অ্যাল কামড়াবার বহুত স্কোপ। কিন্তু বক্তৃতায় সে চান্স উঁহু। ফটাস করে রক্তের ঝাঁঝে মুখ দিয়ে এক বার ফ্যাচাং উগরে গেল, ঢ্যানট্যাঁর্যাঁ। টিভির সান্ধ্য সিন্থেটিক তরজাটাকে বক্তৃতা ধরলে অবশ্য হবে না। হোথা সিনটাই এমন এসি-লাগানো তত্‌সম টাইপ, রবীন্দ্র-ফিল্টার সর্বদা ফিট। নখফখ পকেটে লুকিয়ে রাখা সোজা। প্রকৃত চনমনানি ঘটে, যখন জনসভায়, জ্যান্ত মহাভিড়ের সামনে বক্তৃতা দিতে হয়। মানুষের বাস্তব মুখে নিজের কথাগুলো রিবাউন্ড খায়, চলকে ওঠে। যত বড় নেতা/নেত্রীই হোন, তখন সেই বক্তা আদতে এক পারফর্মার। কথা হাঁকড়ে ক্রাউড-মনস্টারকে টুঁটি আঁকড়ে ঝুঁটি পাকড়ে বসিয়ে রাখতে হবে। মিরাক্ল-শক্ত।

কারণ সাধারণ মানুষ পেশাদার অন্যমনস্ক এবং আপাদমস্তক ক্যালাস। তার ব্রেনখানি ব্যাটারি-পচে-আসা টর্চের মতোই ফোকাস মারতে গিয়ে নাগাড়ে ছেতরে পড়ে। সেই উসুখুসু প্রাণীটিকে ভোলাবে তুমি কীসে? যেই তার অ্যান্টেনা নড়ে যাবে, ভিড় পাতলা, স্ট্রেট বাড়ির পথে হনহন। এই কূট কোশ্চেনমার্ক টিকটিক করলে, বক্তার আর এ-ঘাড়ে বিদ্যেসাগর ও-ঘাড়ে সুনীতি চাটুজ্জে চাপিয়ে রাখলে চলে না। মেঠো সভা হচ্ছে রাজ্যসভার বাবা, লোকসভার মেসো। তার ব্যাকরণ টোটালি ভিন্ন। আর এই টি-টোয়েন্টি যুগে, এখানে তোমায় ট্রফি বাগাতে গেলে, দেড় মিনিট অন্তর ক্ল্যাপ তুলতেই হবে, হর্রা। এও মনে রাখো, আদ্ধেক সময়েই এরা আটশো ভোল্টের সূূর্য মাথায় নিয়ে সাতাশি মাইল ঠেঙিয়ে এসেছে, তাপ্পর তুমি মুড়িজল খাচ্ছ বলে ঝাড়া আড়াই ঘণ্টা কুটকুটে ঘাসে ওয়েট করেছে। এই বার সেই তিতকুটে, হেদিয়ে-পড়া, ঘেমো পিলপিলে ভিড়কে হিপনোটাইজ করতে গেলে, সাতাশ গুণ চনচনে মাল চাই। তাইলে তুমি কী সাপ্লাই করবে? ঈশপের গল্প? অসতো মা সদ্গময়? না কি, পাছা, সোনাগাছি, রেপ, চন্দননগরের মাল? চয়েস সিম্পল। অ-ন্যাকা সত্য: সাধারণ মানুষ সতত ইতরোমোর দিকে প্রাণপণ হুমড়ি। খিস্তি তার আত্মার শান্তি, কেচ্ছা তার মনের আনন্দ, এমএমএসে নায়িকার স্তন তার প্রাণের সফ্ট আরাম। চুটকি-চাটনি ছেড়ে জিন্দেগিতে সে ব্রহ্মসংগীত শুনবে না। অতএব সব ঔচিত্যে তাগড়া ফ্রিকিক কষিয়ে, তাকে খাটনি-উসুল জোগাও।

সঙ্গে নাচছে পারফর্মারের সাংঘাতিক লোভ। হাততালির তেষ্টা। স্টার নিজেকে পাতে বাড়লেন, আর ওয়েদার শ্রাদ্ধবাড়ি মার্কা থমথমে ডিসেন্ট: যাচ্ছেতাই পরাজয়। এই তো ফেব্রুয়ারিতে বামফ্রন্টের ব্রিগেড-সভা যখন মিনমিনিয়ে মিন্নু, মিডিয়া প্যাঁকমাস্টার। ছ্যা, অ্যাগ্রেসিভ নয়, সমর্থকদের তাতাতে গিয়ে মুখথুবড়ি, ব্লাডে বিটনুনের টাচ দিন ওম্মা এ তো স্যাকারিন! তাই রাজনৈতিক বক্তৃতার কাছে সবেধন ডিম্যান্ড: চাঙিয়ে দিয়ে যাও। বক্তা যখন সেই চেতিয়ে তোলার কনটেস্টটায় ‘কুমির তোর জলকে’ ফুকারি ছপাত্‌-ডাইভ, হাততালির ঝড় প্রসবের চ্যালেঞ্জটা নিয়ে পেনাল্টি স্পটে বল চিপকে থরথর, তাঁর মেগাজগত্‌খানি কুঁচকে ওই লেকচারের মাইক্রো-মাঠে ঘনিয়ে আসে। তাপ্পর মুহুর্মুহু তালি গজালে, জিনিসটা মালাইচমচমাচ্ছে বুঝলে, অডিয়েন্স এক তুড়িতে ডানপটকান ইয়া বামঝটকান উপলব্ধিলে; উয়াঃ, কেয়া ধুমকি, চোলাইয়ের জেঠু! জ্যা রোপণ করে পর পর পাঞ্চ-লাইন ছুড়ব আর জনসমুদ্রে ইয়ায়ায়া জোশ-সাউন্ড হুহু, এই ফ্যান্টাসি-মালিশ বলে: নে, নে, টানা চটপটা হজমি ছড়া। ফের, পুনরায় তুবড়ি ছাড়। এই দায় বক্তাকে একটা ইনার্শিয়ায় সওয়ার করে, ঢাল বেয়ে হু-হু গড়িয়ে নিয়ে চলে। ইচ্ছে থাকলেও তখন থামা না-মুমকিন। ওই অলীক দাবনা-দপদপের মুহূর্তে, মনে হয়, এই ভিড়ের হিস্টিরিয়াই আমার যায়িচ্ছে আওড়াবার জাস্টিফিকেশন। চিড়বিড়ে চিলি সস, পাঁক, অ্যাসিডের দিকে জিভ আপনিই চুবে যায়।

এ বার আয়নাবাজি। ক্যান্টিনে কলেজে অফিসে বাসে বেডরুমে বারান্দায় রোলদোকানে, আমাদের ওষ্ঠ হতে প্রিয় খৈনির ন্যায় নাগাড়ে ছিটকোচ্ছে ঘেন্না, দ্বেষ, খার। সমকামীদের খিস্তি করছি, মুসলিমদের (মুসলিম হলে হিন্দুদের), হিজড়েদের, গরিবদের। ছেলেরা মেয়েদের মাংসগোল্লা হিসেবে প্রোজেক্ট করছি। প্রতি মুহূর্তে আমরা সাম্প্রদায়িক, অমানবিক, গাঁট, পলিটিকালি ইনকারেক্ট। তা হলে পলিটিশিয়ানরা হঠাত্‌ পলিটিকালি কারেক্ট হতে যাবেন কেন? আমাদেরই তো ক্লোন। তিনি তো মঙ্গলগ্রহ থেকে পড়েননি। এই ইতর জাত, এই অশিক্ষিত রাজ্যই তাঁকে পেলেছে পুষেছে। তাইলে আমাদের যদি অনবরত ও ধারাবাহিক নীচতার লাইসেন্স ও অভ্যাস থকথকায়, তিনি ভোটবাবু বলে রাতারাতি নেতাজি ও চিত্তরঞ্জনের মশালা-মিক্স হয়ে স্ট্যাচুপোজে দাঁড়িয়ে যাবেন কেন এবং কী উপায়ে? বরং, একটা উলটো-কুর্নিশ মারুন, মনের মধ্যে ও জিভের ডগায় প্রকৃত যা টগবগ, তাকে সারা ক্ষণ চেপ্পে গাঁতিয়ে ভেতরে না পাঠিয়ে, কৃত্রিম টুনি ঝুলিয়ে লেকচার সাজানোর ভণ্ডামি থেকে নিজেকে মুক্তি দিয়েই কি তিনি সত্‌-তম বক্তা নন? আন্তরিক অশ্লীল? স্বতঃস্ফূর্ত স্লিপারি? আমাদের অভিযোগটা কি আসলে এ-ই নয়: ‘আহা, এ-সব প্রাইভেটে বলো, পার্টির মধ্যে, কিংবা ফ্রেন্ডের বাড়ি, মরতে পাবলিক প্লেসে ভাঙলে কেন সত্যি থটের হাঁড়ি’? ‘মাইক সামনে নিলে একটা ধাস্টামির বাধ্যতা বিপবিপায়, স্লাইট পিতির-পিতির মোডে বিরাজিতে হয়, সেইটে খতিয়ে মনে রাখার নামই রুচি, মহিমে-লুচি’? তা যদি না-ই হয়, তবে সভায় সভায় অমন উদগ্র হিংস্র সমর্থন শিস বগলবাজনা কেন, প্রিসাইসলি এই কথাগুলির প্রতি? এখন যাঁরা নিন্দে করে ফাটাচ্ছেন, আর ওই সভায় যাঁরা কথাগুলো শুনে উল্লাসে ফাটছিলেন, তাঁদের ডিএনএ কি সম্পূর্ণ আলাদা? সভাদর্শকদের এখন সহসা ক্যামেরালে কি তাঁরা বলবেন না ‘ধিক তাপস’? নিয্যস বলবেন, কারণ ভাতে ভণ্ডামি মেখেই বাঙালির নেয়াপাতি। আমরা তারিয়ে পর্নো গিলি আর নগ্ন নায়িকাকে শূলে চড়াই। তার চেয়ে তাবত্‌ ধাস্টামি ঝেড়ে, বক্তৃতাগুলোকে আনসেন্সর্ড রিয়েলিটি শো বানিয়ে দে না বাপ! জীবন কত্ত চুলবুলোবে! বোরডম ঘ্যাঁচ হবে। ভরাভত্তি বিশ্বকাপের সিজনে তাপস পাল আমাদের মেসির চেয়ে বেশি এন্টারটেন করলেন তো!

post editorial chandril bhattacharya
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy