রাজ্য সরকারের প্রথম কর্তব্য: রাজ্যে প্রশাসন অর্থাৎ প্রকৃষ্ট শাসনের ব্যবস্থা করা। কোনও সরকার যদি এই প্রাথমিক দায়িত্বটি পূরণ করিতে ব্যর্থ হয়, তবে তাহার ক্ষমতায় থাকিবার নৈতিক অধিকার নাই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন সরকার গত চার বৎসরে ক্রমাগত এই প্রথম কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হইয়াছে। রানাঘাট কাণ্ডের তদন্তের ভার সিবিআই-এর উপর ছাড়িতে চাহিয়া মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং সেই ব্যর্থতার কথা স্বীকার করিয়া নিলেন। তিনি প্রকারান্তরে বলিয়া দিলেন, তাঁহার পুলিশ অযোগ্য। হুমকি এবং নিরাপত্তাহানির আশঙ্কা সম্পর্কে পূর্বেই সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া সত্ত্বেও তাঁহার পুলিশ রানাঘাটের আবাসিক বিদ্যালয়টিতে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করিতে ব্যর্থ হইয়াছে। প্রায় এক সপ্তাহে এক জন অপরাধীকেও ধরিতে পারে নাই বা ধরে নাই। পুলিশকে এমন অকেজো করিয়া ফেলিবার প্রত্যক্ষ দায় তাঁহারই। তাঁহার শাসনকালে পুলিশ প্রমাণ খুঁজিয়াছে কম, লোপাট করিয়াছে বেশি। কোন অভিযোগ ‘খাঁটি’, আর কোনটি নিতান্ত ‘সাজানো ঘটনা’, তাহাও তিনিই স্থির করিয়া দিয়াছেন। কে মাওবাদী আর কে সিপিআইএম, এবং কাহার অভিযোগে কান দেওয়ার দরকার নাই, সবই মুখ্যমন্ত্রী জানেন, এবং পুলিশকে জানান। পুলিশ তাঁহার অঙ্গুলিহেলনে নাচিয়াছে মাত্র। কোনও ব্যতিক্রমী অফিসার নাচিতে অসম্মত হইলে তাঁহার বেমক্কা বদলি হইয়াছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে বিষবৃক্ষ রোপণ করিয়াছেন, রানাঘাট-কাণ্ড তাহার অবশ্যম্ভাবী ফল।
আজ মুখ্যমন্ত্রী ভাবিতেছেন, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা আসিয়া বুঝি তাঁহার পুলিশের, এবং তাঁহার, সমস্ত ব্যর্থতা আড়াল করিয়া দিবে। অতএব, সিবিআই বিষয়ে মন পাল্টাইতে তাঁহার বিশেষ সময় লাগে নাই। সারদা-কাণ্ডের তদন্তভার সিবিআই-এর উপর ন্যস্ত হওয়া ইস্তক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে চাঁদমারি বানাইয়াছিলেন। তাঁহার সেই অনাস্থার চরিত্র সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। আর, আজ যখন পাকে পড়িয়া তিনি সিবিআই-এ আস্থা ফিরিয়া পাইলেন, তাহার অন্তর্নিহিত রাজনীতির সুরটিও চোখ এড়াইবার নহে। তিনি বলিয়াছেন, রানাঘাটের ঘটনাটি ‘অতি গুরুতর ও স্পর্শকাতর’। দ্বিতীয় বিশেষণটি একান্তই রাজনীতির— তাঁহার ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ভারবাহী। এই চালাকি তাঁহার ব্যর্থতাকে দ্বিগুণ প্রকট করিয়া দিল। তিনি যে শুধু প্রশাসক হিসাবে ব্যর্থ, তাহাই নহে, তিনি সেই ব্যর্থতাকে ঢাকিতে অতি বিপজ্জনক রাজনীতির ব্যবহারেও পিছপা হন না।
সিবিআই তদন্তের যৌক্তিকতা হিসাবে নদিয়া জেলার ভৌগোলিক অবস্থানের কথা তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্বের মুখে মুখে ফিরিতেছে। বলা হইতেছে, অপরাধীরা সীমান্ত পার হইয়া বাংলাদেশে লুকাইতে পারে। সে ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের পক্ষে তাহাদের ধরা মুশকিল। প্রথম প্রশ্ন, অপরাধীরা বাংলাদেশেই আত্মগোপন করিয়াছে, মুখ্যমন্ত্রী বা তাঁহার প্রশাসন এত নিশ্চিত হইলেন কী উপায়ে? কোনও ঘটনা ‘সাজানো’ কি না, তাহা মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে বোঝেন, সেই পন্থাতেই কি? দ্বিতীয় প্রশ্ন, অপরাধীরা যদি সত্যই বাংলাদেশে পলায়, সে ক্ষেত্রে সিবিআই এমন কী করিতে পারে, যাহা পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের পক্ষে সম্ভব নহে? তদন্তের স্বার্থে বাংলাদেশ সরকারের সাহায্য লওয়া যাইতে পারে, প্রয়োজনে ইন্টারপোলের দ্বারস্থ হওয়াও সম্ভব। কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্য প্রয়োজন হইলে তাহাও বিলক্ষণ চাওয়া যাইতে পারে। কিন্তু, তদন্তের দায়িত্ব পশ্চিমবঙ্গ পুলিশকেই লইতে হইবে। রানাঘাট-কাণ্ডে নরেন্দ্র মোদীর একটিই কর্তব্য। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিবিআই তদন্ত প্রার্থনা করিলে তাঁহাকে তৎক্ষণাৎ প্রত্যাখ্যান করা। তাঁহাকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলিয়া দেওয়া, পশ্চিমবঙ্গে শাসনের দায়িত্ব যখন তিনি লইয়াছেন, সেই দায়িত্ব পালন করাও তাঁহারই কাজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy