Advertisement
E-Paper

ভাঙতে হলে জানতে হয়

প্রতিষ্ঠান বাধা দিয়েছিল। সুকুমারী ভট্টাচার্য (১৯২১-২০১৪) দমেযাননি। নিজের উদ্যমে সংস্কৃত পড়লেন। ঢুকলেন শাস্ত্র, কাব্য, পুরাণের অন্দরে। ভাঙলেন প্রাচীন ভারতের ‘পবিত্র’ একমাত্রিক ধারণা। বিশ্বজিত্‌ রায়।সদ্যপ্রয়াত সুকুমারী ভট্টাচার্য যে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন, সেই একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্-এর। মুসলমান বলে শহীদুল্লাহ্কে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত পড়াতে রাজি হননি সত্যব্রত সামশ্রমী। আর সুকুমারী ভট্টাচার্যের ক্ষেত্রে বলা হয়েছিল, বাঙালি খ্রিস্টান পরিবারের মেয়ে, সে কেন সংস্কৃত পড়বে?

শেষ আপডেট: ০১ জুন ২০১৪ ০০:০০

সদ্যপ্রয়াত সুকুমারী ভট্টাচার্য যে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন, সেই একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্-এর। মুসলমান বলে শহীদুল্লাহ্কে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত পড়াতে রাজি হননি সত্যব্রত সামশ্রমী। আর সুকুমারী ভট্টাচার্যের ক্ষেত্রে বলা হয়েছিল, বাঙালি খ্রিস্টান পরিবারের মেয়ে, সে কেন সংস্কৃত পড়বে? ভাবখানা এই, সংস্কৃত যেন নানা স্রোতে-উপস্রোতে গড়ে ওঠা ভারতীয় জীবনের অঙ্গ নয়, তা কেবল ‘আদি হিন্দুদের ভাষা’। অর্বাচীন মুসলমান আর খ্রিস্টানদের সে ভাষা পড়ার কোনও ‘অধিকার’ নেই। অনধিকারী সংস্কারহীনদের হাতে পড়লে ‘সংস্কৃত’-এর বিশুদ্ধি বিনষ্ট হবে। তাই পড়তে দিয়ো না, ঢুকতে দিয়ো না ‘দেবভাষার দেবালয়ে’, বাদ দাও, বহিরাগত হিসেবে দাগিয়ে রাখ।

এই যে বাদ দেওয়ার প্রকল্প, তার নানা কৌশল। প্রাচীন ভারতকে সব পেয়েছির দেশ বলে, নির্ভেজাল পুণ্যভূমি বলে তুলে ধরতে চাইতেন যে সংকীর্ণ হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা, তাঁরা আসলে পুরনো ভারতের নানা জটিল খাঁজখোঁঁজকে বাদ দিতেন। পুরনো ভারতের ছবিটি তাতে বেশ গৌরবময় হয়ে উঠত। সুকুমারী সেই ছবিটি ভেঙেছিলেন। প্রতিষ্ঠানের প্রত্যাখ্যান হয়তো শাপে বর হয়েছিল। সংস্কৃত পড়তে না পেয়ে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে এম এ পাশ করেন সুকুমারী। কিন্তু সংস্কৃতের পিছু ছাড়েননি। প্রাইভেটে সংস্কৃতে এম এ পাশ করলেন। ঢুকলেন শাস্ত্র, কাব্য, পুরাণের অন্দরে। পুরনো ভারতের নামে হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা যে গৌরবময় একমেটে ছবিটি তুলে ধরতেন, তার বিরুদ্ধে কলম ধরলেন।

‘মা’ কেমন ছিলেন? সুকুমারীর যুক্তি, তথ্য দিয়ে সাজানো নিবন্ধগুলি প্রমাণ করছে ভাল ছিলেন না ‘বহু অনুসন্ধানেও নারী-কে সেকালের সমাজে সম্মানের আসনে দেখতে পাইনি। অশিক্ষার অন্ধকারে নির্বাসিত, স্বাধীন অর্থকরী বৃত্তি থেকে বঞ্চিত নারী,’ লিখেছিলেন সুকুমারী। তাঁর পাঠ এক দিক থেকে বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়া, কিন্তু লক্ষ করা যায়, অ্যান্টিথিসিস তৈরির ঝোঁকে মনের জানলাকে বন্ধ করছেন না। ‘এগুলিতে কোনো বিষয় সম্পর্কেই শেষ কথা বলার ধৃষ্টতা নেই; চিন্তার একটি স্তরই বিধৃত আছে এগুলিতে; চিন্তা চলছে এখনো।’ দামি কথা। এই কথাটার দাম না বুঝলে কী হয়, পশ্চিমবঙ্গবাসী দেখেছেন। এক সময় দেওয়াল লিখনে মার্ক্সবাদকে অপরিবর্তনশীল বিজ্ঞান হিসেবে দাগানো হত, ‘চিন্তা চলছে এখনো’ মানুষদের প্রতিক্রিয়াশীল বলে বাদ দিয়ে দিতেন আগমার্কা বাম শিবির। তার ফল যে কী ভয়ংকর আত্মঘাতী হতে পারে, সেটা এখন তাঁরাই হয়তো সবচেয়ে বেশি টের পাচ্ছেন। পুরনো ভারতকে একমাত্রিক ভাবে আধ্যাত্মিক ভাববাদের গর্ভধারিণী বলার মধ্যে যে গোঁড়ামি আছে, বস্তুবাদ ও যুক্তির নামে সাধারণ ভারতবাসীর ধর্ম-সংস্কৃতিকে অস্বীকার করার মধ্যেও সেই একই গোঁড়ামি আছে।

সুকুমারী কিন্তু তাঁর লেখায় যতটা পারতেন স-তথ্য পুরো ছবিটি দেওয়ার চেষ্টা করতেন। যেমন, রামায়ণ। এই মহাকাব্য এক দিনে গড়ে ওঠেনি। এর মধ্যে সময়ের নানা স্তর মিশে আছে। সীতা চরিত্রের সূত্রে তিনি বিষয়টি ব্যক্ত করেছিলেন। সীতা ‘ভারতীয় সতীত্ব’-এর আদর্শ, হিন্দুত্ববাদীর কাছে পাতিব্রত্যের আলোকোজ্জ্বল নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত। সুকুমারী রামায়ণের নির্দিষ্ট শ্লোক তুলে দেখিয়েছিলেন, ‘পতিই একমাত্র গতি’ এই পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধের জন্য মোটেই সীতা রামের সঙ্গে বনে যাননি, রামের বিরহ তাঁর অসহ হবে বলে ভালবেসে বনে গিয়েছিলেন। সীতার বনযাত্রার কারণ পাতিব্রত্যের সামাজিকতা নয়, ভালবাসার ব্যক্তিগত উপলব্ধি। এই সীতাই তাই পরে রাবণ-সংসর্গের জন্য প্রশ্নের সম্মুখীন হলে স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘আমার নিজের আয়ত্তে আমার যে মন তা তো তোমাতেই আছে, আমার যে শরীরটা পরাধীন সেটার সম্বন্ধে অক্ষম আমি কী করব।’ প্রশ্নটা আমাদের ভাবায়। পতিব্রতা হলে যে চুপ করে থাকতে হয়, বর পেটালেও মানিয়ে গুছিয়ে নিতে হয়, হিন্দু পাতিব্রত্যের এই বিচিত্র আদর্শকে মান্য করার আদেশ দেয় বর্ণহিন্দু সমাজে প্রচলিত পুরুষতন্ত্র। এমনকী কোনও কোনও সংঘের সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট একই কথা বলতে চায়। সরব সীতা এর বিরোধী, প্রতিবাদী। এ প্রসঙ্গে মনে পড়বে, শারীরিক সতীত্ব রক্ষার নামে ভারতে মেয়েদের আত্মাহুতি দিতে বলা হত। এখনও মেয়েরা ধর্ষিতা হলে সমাজ ও পরিবার শারীরিক শুচিতা অশুচিতার প্রশ্নে মেয়েদের নাকাল করে। সুকুমারীর উদ্ধার করা শ্লোকটি কিন্তু এই সব কৌশলের মূলে আঘাত করছে। পুরুষরা এসে শরীর দখল করবে বলে কেন মরতে হবে মেয়েদের? সতীত্ব প্রমাণের জন্য কেন অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে? ২০০৩ সালে পাকিস্তানের ইসলামিকরণের বিরুদ্ধে সাবিহা সুমার নির্মাণ করেছিলেন চলচ্চিত্র ‘খামোশ পানি’। দেশভাগ হয়েছে। পঞ্জাবের গ্রাম। একাংশ পাকিস্তানের। পুরুষেরা গ্রাম ছাড়ছে। সতীত্ব বাঁচাতে মেয়েদের আত্মহত্যা করতে হচ্ছে কুয়োয় ঝাঁপ দিয়ে। একটি মেয়ে করেনি। ‘আমার যে শরীরটা পরাধীন সেটা সম্বন্ধে অক্ষম আমি কি করব’ এ প্রশ্ন তার মনেও উঠেছিল। তাই সে আত্মহত্যা না করে পালায়, ‘জীবনের অধিকার’ বজায় রাখে। মেয়েদের শরীর-সম্বন্ধীয় এই প্রশ্নটি অমোঘ এবং নির্দিষ্ট কালের সীমা ছাড়িয়ে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে উদ্যত।

সুকুমারীর মতে, প্রাচীন ভারতে গণিকারা শিক্ষা পেতেন, স্বাধীনতাও ছিল তাঁদের। শূদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকের অনুবাদ করেছিলেন সুকুমারী। সুখপাঠ্য সেই অনুবাদে বসন্তসেনার মতো সু-মনা গণিকার সঙ্গে পরিচিত হন বাঙালি পাঠক। অর্থের প্রতি আকর্ষণ ছিল না স্বাধিকারসচেতন এই রমণীর। প্রেমিক চারুদত্তকে অর্থনৈতিক সংকটের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন তিনি। আবার লক্ষ করতে হবে, নরনারীর সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমাজের বাস্তব প্রেক্ষিতে ‘বিবাহ’ নামের প্রতিষ্ঠানটি যে গুরুত্বপূর্ণ, সুকুমারী সে কথা অস্বীকার করেননি। তাঁর নারীবাদ দায়িত্বজ্ঞানহীন ছিল না।

প্রাচীন ভারতের নামী-দামি মুনিঋষিদের শ্রেণিস্বার্থের প্রশ্ন ও প্রসঙ্গগুলি উত্থাপন করতেও সুকুমারী দ্বিধা করেননি। জন্মান্তরবাদের প্রবক্তা যাজ্ঞবল্ক্য যে ধনিক, ঋত্বিক ও দার্শনিক এই তিনের স্বার্থ রক্ষা করেছিলেন, তা জানিয়েছিলেন। এই ধরনের লেখালিখিতে এমন সব প্রসঙ্গ তিনি উত্থাপন করতেন, যেগুলি প্রাত্যহিক ও জরুরি। প্রাচীন ভারতের নিয়তিবাদ নিয়ে দর্শনগ্রন্থ লিখেছিলেন, ক্ষুধার প্রসঙ্গও এড়িয়ে যাননি। দর্শন জীবন থেকে আলাদা নয়, দেশকালের সমাজ ও অর্থনীতির ছাপছোপ তার শরীরে।

বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক

post editorial biswajit roy
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy