Advertisement
E-Paper

ভোট এল, জাতপাতের ভূমিকা আদৌ কমল কি

জাতপাত নির্ভরতা শুধু পুঁজিবাদী বিকাশের প্রতিবন্ধকতা নয়, সুষ্ঠু গণতন্ত্রের বিকাশের পরিপন্থীও। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষালআজ এত বছর পর, ২০১৪ সালের ভোট লগ্নে আবার এই প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে যে, ভোটের আচরণে জাতপাতের ভূমিকা কমছে না বাড়ছে? দীপঙ্কর গুপ্তের মতো সমাজতাত্ত্বিকেরা বলছেন, নির্বাচনী আচরণে জাতপাতের প্রেক্ষিতটা আসলে একটা মিথ। আর্থ-সামাজিক নানা কারণে মানুষ ভোট দেয়, গ্রামীণ ভোটারদের সে আচরণকে ভারতীয় রাজনীতি বা সংবাদমাধ্যম বুঝতে ভুল করে।

শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৪ ০০:০৭

আমরা কলকাতার বাঙালি জাতপাত নিয়ে আলোচনা করতেই একদা লজ্জা পেতাম। আবার মার্কসবাদী বিদ্বৎসমাজ তো শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই সব কিছু দেখতে চাইতেন, তাই জাতপাত নির্ভর আলোচনায় ছিল অরুচি। আঁদ্রে বেঁতে লিখেছেন, একদা ইএমএস নাম্বুদিরিপাদ তাঁকে বলেছিলেন জাতপাত নির্ভর আলোচনা বস্তুত মার্কিন সমাজতাত্ত্বিকদের প্রভাব, ভারতে জাত নয়, শ্রেণির নিরিখে রাজনীতিকে বিশ্লেষণ জরুরি। পরবর্তী কালে কিন্তু মার্কসবাদীরাই তাঁদের পুরনো অবস্থানে পরিবর্তন এনেছেন। আজ তাঁরাও উত্তর আধুনিক যুগের বৈশিষ্ট্য হিসাবে জাতপাতকে এক বিশেষ ধরনের আইডেন্টিটি পলিটিকস হিসাবে গ্রহণ করেছেন।

ম্যাক্সওয়েবার প্রথম স্ট্র্যাটা বা সামাজিক স্তরের কথা বলেছিলেন। গ্রামশ্চিও তাঁর কারাবাসের ডায়েরিতে হেজেমনি এবং এই স্তরের কথা বলেন। ভারতে শ্রীনিবাসন ও আঁদ্রে বেতেকে ম্যাক্সওয়েবারিয়ান তাত্ত্বিক হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে।

আজ এত বছর পর, ২০১৪ সালের ভোট লগ্নে আবার এই প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে যে, ভোটের আচরণে জাতপাতের ভূমিকা কমছে না বাড়ছে? দীপঙ্কর গুপ্তের মতো সমাজতাত্ত্বিকেরা বলছেন, নির্বাচনী আচরণে জাতপাতের প্রেক্ষিতটা আসলে একটা মিথ। আর্থ-সামাজিক নানা কারণে মানুষ ভোট দেয়, গ্রামীণ ভোটারদের সে আচরণকে ভারতীয় রাজনীতি বা সংবাদমাধ্যম বুঝতে ভুল করে। আমরা ধরে নিই, জাতপাতের নিরিখেই ভোট দিচ্ছেন তাঁরা। শতকরা কত ভোট কোনও একটি জাতি বা উপজাতির আছে কোনও একটি নির্বাচন কেন্দ্রে তা জানা গেলেও এই শতকরা ভোট কতগুলি আসনে হাতেগরমে ফল দিচ্ছে তা কিন্তু আসলে জানা খুবই কঠিন। কোনও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি এটির সূক্ষ্ম বিচারের জন্য আজও আবিষ্কৃত হয়নি।

দীপঙ্করবাবু সুপণ্ডিত এবং আধুনিক সমাজতাত্ত্বিক। কিন্তু বাস্তবের মাটিতে এই জাতপাতের প্রভাব সত্য সত্যই কমেছে কি না তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ আছে। ’৫০ সালের পর নেহরুর শিল্পায়ন ও উন্নয়নের স্লোগানেও জাতপাতের ভূমিকা কমে গেছে বলে অনেকে মনে করেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক সুরিন্দর জোধকা বলছেন, “Since 1950 the process of economic growth and institutionalization of democratic politics have transformed almost every aspect of indian society, including the institution of caste. However, the reality of caste has not disappeared. Though in some cases caste groups have horizon-tally consolidated themselves into caste associations and political formations, the elements of hier-archy and inequality continue to be reproduced even today in many different ways.” (গ্রন্থসূত্র: Catse)

জাতপাত যদি এতটাই অপ্রাসঙ্গিক বিষয় হত তবে গত ২০০৪ ও ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশে প্রথমে মায়াবতী ও পরে সমাজবাদী পার্টির সাফল্যের ব্যাখ্যা দেওয়া কঠিন হয়ে যায়। এ কথা ঠিক, মায়াবতী বুঝতে পেরেছিলেন যে শুধুমাত্র দলিত ভোট নিয়ে লখনউয়ের তখত দখল করা যাবে না, তাই তিনি দলিত ভোটের পাশাপাশি উচ্চবর্ণের হিন্দুভোট করায়াত্ত করার সামাজিক কারিগরি করেছিলেন। মুলায়ম সিংহ যাদবও তো যাদব ভোটের পাশাপাশি মুসলমান ভোটের জন্য ছক কষেছিলেন।

এ বার, ২০১৪ সালে হিন্দি বলয়ে বিজেপি শুধুমাত্র নরেন্দ্র মোদীর নামেই যদি ভোট করতে প্রস্তুত, তা হলে বাড়মেড় কেন্দ্রে জাঠ ভোটের বিরুদ্ধতার যুক্তিতে ঠাকুর যশোবন্ত সিংহকে টিকিট না দেওয়ার সিদ্ধান্ত তারা কেন নিচ্ছে? তবে কি এটা মিথ? না বাস্তবতা।

যাদব, কুর্মি, লোধ, অন্য নিম্নবর্গ তথা ওবিসি, জাঠ ও অন্য দলিত ইত্যাদি ভোটের শতকরা ভোট কোথায় কতটা তার ভিত্তিতে ২০০৯ সালেও তো ভোট হয়েছে। নীতীশ কুমারের জেতার পরেও এই কারণে লালুর যাদব ভোটের অনেকটাই সুসংহত থাকে। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের জাঠরা একত্রিত হয়ে ভোট দেন। তার জন্য অজিত সিংহ একদা ভোট পেয়েছেন, আজও টিকায়েত ভ্রাতৃদ্বয়ের সঙ্গে বিজেপি যোগসূত্র তৈরি করে জাঠ ভোট করায়ত্ত করতে চাইছেন।

জাতপাত নিভর্রতা শুধু পুঁজিবাদী বিকাশের প্রতিবন্ধকতা নয়, সুষ্ঠু গণতন্ত্রের বিকাশের পরিপন্থী, এ কথা সত্য। দীপঙ্কর গুপ্ত তাঁর রিভলিউশন ফ্রম অ্যাবাভ— ইন্ডিয়া’জ ফিউচার অ্যান্ড দ্য সিটিজেন এলিট’ গ্রন্থে বলেছেন, মণ্ডল কমিশনের ভিত্তিতে সংরক্ষণকে ভারতের প্রায় সব রাজনৈতিক দলই মেনে নিয়েছে। তাতে নিম্নজাতের বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা বেড়েছে, কিন্তু দারিদ্র দূরীকরণের বিষয়ে আমাদের অগ্রাধিকার তাতে ধাক্কা খেয়েছে। দীপঙ্করবাবু বলেছেন, হিটলার জনপ্রিয় ভোট নিয়ে ক্ষমতাসীন হলেন, কিন্তু তাঁর ‘থার্ড রাইখ’ অন্ধ জাতিবাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ছিল।

ইহুদি, কমিউনিস্ট ও জিপসিদের তিনি জাতির বিপদ বলে মনে করেছিলেন। সেটাও ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠের মত, কিন্তু তা গণতান্ত্রিক ছিল না।

অবশ্য শুধু দীপঙ্কর গুপ্ত নন, কানপুরের ক্রাইস্ট চার্চ কলেজের রাজনীতি বিজ্ঞানের অধ্যাপক এ কে বর্মা ‘হ্যান্ডবুক অফ পলিটিক্স ইন ইন্ডিয়ান স্টেটস’ গ্রন্থে ‘ডিকলাইন অফ ব্যাকওয়ার্ড কাস্ট পলিটিক্স ইন নর্দার্ন ইন্ডিয়া’ প্রবন্ধে বলেছেন, উত্তর ভারতে জাতপাতের রাজনীতির বদলে নিম্নবর্গের শ্রেণিভিত্তিক রাজনীতির প্রভাব আবার বাড়ছে। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও অন্য রাজনৈতিক স্বাধীনতা নির্বাচনী রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। জাতিভিত্তিক ভোটের শতকরা পরিমাণ উত্তরপ্রদেশে সব দলের ক্ষেত্রেই ২০০৯ সালে কমেছে বলে তিনি রেখচিত্র সহকারে দেখিয়েছেন।

নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি-ও এ বার মতাদর্শগত ভাবে সেটাই চাইছে। তারাও বলছে, উন্নয়ন ও শক্তিশালী অখণ্ড ভারত গঠনই তাদের লক্ষ্য। আর এই কারণে বিজেপি জাতপাতের কণ্টকতা থেকে ভারতকে মুক্ত করতেই বেশি আগ্রহী। নরেন্দ্র মোদী নিজে ওবিসি নেতা, কিন্তু তিনি তার ভারতীয় সত্তাকে প্রতিষ্ঠায় বেশি আগ্রহী।

কিন্তু এই কথা বলা সত্ত্বেও গোটা দেশে কংগ্রেস শুধু নয়, বিজেপি-ও জাতপাতের ভিত্তিতে প্রার্থী বাছাই করল কেন? পুরনো অভ্যাস মাত্র না বাস্তবতা বোধ?

হয়তো জাতপাতের ভূমিকা কমছে, কিন্তু রাজনীতিকরাই বোধহয় এখনও অনেকেই তাকে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক করতে দিতে চান না ক্ষুদ্র স্বার্থে!

আর গ্রামীণ মানুষ? হয়তো এক নীরব ও ধীর রূপান্তর পর্বের মধ্য দিয়ে হেঁটে চলেছেন তাঁরা।

—ফাইল চিত্র।

jayanta ghoshal shahi samachar
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy