Advertisement
E-Paper

মন খারাপ হবে না?

আর বেশি দিন থাকবেন না, গত কয়েক বছর ধরেই আঁচ করা যাচ্ছিল। ক্যান্সার, সঙ্গে স্মৃতিভ্রংশ। ২০০৫ সালে ‘মেমরিজ অব মাই মেলান্কলি হোরস’-এর পর একটি লাইনও লেখেননি। তিন খণ্ডে আত্মজীবনী ‘লিভিং টু টেল দ্য টেল’ লিখবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু প্রথম খণ্ডের পর অসুস্থতা আর এগোতে দেয়নি তাঁকে। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের কলম অনেক দিন আগেই থমকে গিয়েছিল, কিন্তু তবু আশ্বাস ছিল। আমাদের মধ্যেই তিনি আছেন।

গৌতম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৪ ০০:০৩

আর বেশি দিন থাকবেন না, গত কয়েক বছর ধরেই আঁচ করা যাচ্ছিল। ক্যান্সার, সঙ্গে স্মৃতিভ্রংশ। ২০০৫ সালে ‘মেমরিজ অব মাই মেলান্কলি হোরস’-এর পর একটি লাইনও লেখেননি। তিন খণ্ডে আত্মজীবনী ‘লিভিং টু টেল দ্য টেল’ লিখবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু প্রথম খণ্ডের পর অসুস্থতা আর এগোতে দেয়নি তাঁকে। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের কলম অনেক দিন আগেই থমকে গিয়েছিল, কিন্তু তবু আশ্বাস ছিল। আমাদের মধ্যেই তিনি আছেন।

গায়ে কাঁটা দিচ্ছে একটাই কারণে। কোমা থেকে ফিরে আসার পর, শেষ মুহূর্তে নিউমোনিয়ার সংক্রমণ। কর্নেল নিকোলাস মার্কেসও শেষ বয়সে বাড়ির চালায় উঠতে গিয়ে মই থেকে পা পিছলে পড়ে যান, শরীর ভেঙে যেতে থাকে। শেষে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় তাঁর। নিকোলাস, গার্সিয়া মার্কেসের দাদু। নাতির হাত ধরে রোজ পোস্ট অফিস যেতেন, পেনশন এসেছে কি না, খোঁজ নিতে। ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না’ গল্পের বৃদ্ধ কর্নেলকে মনে পড়ছে? ক্ষতি নেই। গার্সিয়া মার্কেস বলেছেন, তাঁর প্রতিটি লেখাই বাস্তব থেকে উঠে আসা।

গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস বললেই লোকে তোতাপাখির মতো ‘ম্যাজিক্যাল রিয়ালিজ্ম’ উচ্চারণ করে। জাদু-বাস্তবতা মানেই যেন, উঠোনে ঝোলানো শাড়ি বেয়ে কেউ স্বর্গে উঠে যাবে! অথচ, জাদুবাস্তব অন্য জিনিস। সেখানে সময়, তথ্য, কল্পনা স্পাইরাল ভঙ্গিতে জড়াজড়ি করে থাকে। ‘শতবর্ষের নির্জনতা’ উপন্যাসে পুলিশ ধর্মঘটী শ্রমিকদের ওপর গুলি চালায়। তিরিশ হাজার শ্রমিকের মৃত্যু হয়। লাশগুলি সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়। কলম্বিয়ার সরকারি ইতিহাস বলত, কোনও শ্রমিকের মৃত্যু হয়নি। গার্সিয়া মার্কেস এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘তিরিশ হাজার কাল্পনিক সংখ্যা। যদি লেখ, আকাশে গরু উড়ে যাচ্ছে, কেউ বিশ্বাস করবে না। কিন্তু চারশো গরু উড়ে যাচ্ছে লিখলে লোকে সত্যি ভাববে।’ খুঁটিনাটি তথ্য ছাড়া জাদু হয় না।

গত শতকের সত্তর, আশির দশকে আমরা যারা কলকাতায় বেড়ে উঠছিলাম, আমাদের সেই ‘নষ্ট প্রজন্ম’, যারা কোনও দিনই জীবনদেবতা নামক অলীকবাবুর সাক্ষাৎ পায়নি, বিপ্লব ও ধনতন্ত্র দুই মেরুকেই সমান সন্দেহ নিয়ে দেখেছে, তাদের সকলকে চমকে দিয়েছিল মাকোন্দো জনপদ। গার্সিয়া মার্কেস আজও যেন কানের কাছে ফিসফিস করেন, ‘দুপুরবেলায় ফুটপাথে চার জন দেহাতি রিকশাওয়ালাকে ছাতু খেতে দেখলে? ওখানেই বসে আছে তাৎমাটুলির ঢোঁড়াই। পাক্কি সড়ক ধরে এখানে এসে পৌঁছল আজ।’ কল্পনা, বাস্তব, সময়ের একরৈখিক গতি, সব ওলটপালট হয়ে যায়। তবু গার্সিয়া মার্কেস থামেন না। বলেন, ‘উপনিবেশ তোমাদের আলাদা করে দিয়েছে, নিঃসঙ্গ করে রেখেছে। শতবর্ষের এই নিঃসঙ্গতা কাটতে পারে শুধু সংহতির বোধে।’ কোন মূর্খ বলে, জাদুবাস্তবতা শুধুই লাতিন আমেরিকার কৃৎকৗশল?

কলম্বিয়ার লেখক কত জনের মুখেই ভাষা জোগালেন! ‘অটাম অব দ্য পেট্রিয়ার্ক’! রাষ্ট্রনায়কের প্রাসাদে গরু চরে, সমুদ্রে দাঁড়িয়ে কলম্বাসের রণতরী। পাশে মার্কিন ফ্রিগেট। উপনিবেশ তৈরির ভাষা বদলায় না। বদলায় না বলেই মুক্তিযুদ্ধের ঢাকা শহরে ‘চিলেকোঠার সেপাই’ দেখে, বখতিয়ার খিলজির আঠারো অশ্বারোহীর পাশে ঢুকে আসছে পাকিস্তানি ট্যাঙ্ক।

কিংবা নোবেলজয়ী উপন্যাসের শেষটা! বংশের শেষ জনকে পিঁপড়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, তখনই মেলকুয়াদিসের পাণ্ডুলিপির পাঠোদ্ধার করে ফেলে আউরিলিয়ানো বাবিলোনিয়া। মেলকুয়াদেস স্প্যানিশ হরফে সংস্কৃত ভাষায় লিখে গিয়েছিল, এত দিনে পড়া গেল। উপনিবেশ মাকোন্দো গ্রামের ঐতিহ্যের সঙ্গে সংস্কৃত ভাষাও ভুলিয়ে দেয় যে!

‘শতবর্ষের নির্জনতা’ ক’টি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল, স্প্যানিশ ভাষায় বাইবেলের পরই বিক্রিতে তার স্থান কি না, সে প্রশ্ন নগণ্য। আসলে গার্সিয়া মার্কেস না থাকলে তৃতীয় বিশ্বের এই সুদূরে বসে আমরাও সময়কে বুঝতে পারতাম না। কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া চিলেকোঠায় বসে সোনার মাছ তৈরি করে। উদারনৈতিক দলের হয়ে ৩২ বার রক্ষণশীলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গিয়েছে সে। তবু পরিবর্তন আসেনি। কেন না, সেই যুদ্ধের পিছনে কোনও আদর্শ ছিল না। রক্ষণশীলরা যখন সব নীল রঙে রাঙিয়ে দিচ্ছিল, কর্নেল বিরক্ত হয়ে ওঠে। নীল রং তার পছন্দ নয়। ‘উদারনৈতিক আর রক্ষণশীলদের আজকাল একটাই তফাত। প্রথম দল বিকেল পাঁচটায় গির্জায় যায়, দ্বিতীয় দল রাত আটটায়।’

বাঙালি গার্সিয়া মার্কেস বললে ফিদেল কাস্ত্রোর বন্ধুও বোঝে। ক্ষমতাবানদের সঙ্গে মিশতে ভালবাসতেন। কাস্ত্রো থেকে মিতেরঁ, বিল ক্লিন্টন, তাঁর বন্ধু। কিন্তু সীমারেখা টানতে জানতেন। বলেছিলেন, “আমার মাপা আছে, ফিদেলের সঙ্গে আমি কত দূর যেতে পারি।” তাঁর ভক্ত বাঙালি মেধাজীবীরা এই দূরত্ব মাপতে শিখলে ভালই হত।

‘ক্রনিক্ল অব আ ডেথ ফোরটোল্ড’ উপন্যাসের সান্তিয়াগো নাসারের মৃত্যুও মনে পড়ছে। ভিকারিও যমজ ভাইরা তাকে খুন করার আগে বাজারে জানায়, সান্তিয়াগোকে খুন করতে যাচ্ছে। তাদের বোন বলেছে, সান্তিয়াগো তার ইজ্জত নিয়েছে। দাবিটি সত্য কি না, উপন্যাসের শেষেও জানা যায় না। কিন্তু বাড়ির রাঁধুনি ভিক্টোরিয়া সব জেনেও চুপ। সান্তিয়াগো মাঝে মাঝে তার মেয়ের শরীরের এখানে সেখানে হাত দেয়। মাচিসমোর এই গল্প লিখেই গার্সিয়া মার্কেস আমাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বুঝিয়েছিলেন, মাচিসমো শুধু মেয়েদের ওপর পুরুষের দখলদারি নয়। পুরুষের প্রতি পুরুষের অত্যাচার, নারীর প্রতি নারীর ব্যবহারেও থাকে তার চিহ্ন।

কিন্তু শুধু জাদুবাস্তব আর শতবর্ষের নির্জনতা? ‘নীল পোশাকে স্কুল যায় সেই মেয়ে/ কেউ জানে না সে হাঁটে না ওড়ে/লঘুচপল ছন্দে সে হাঁটে, হাওয়ার তালে তালে।’ এটি ১৮ বছর বয়সি গার্সিয়া মার্কেসের লেখা কবিতা থেকে। যে মেয়েকে নিয়ে লেখা, তার বয়স ১৩। এই মেয়েই মার্সেদেস, পরে কবির স্ত্রী। প্রেমে পড়ে গোপনে কবিতা লেখার পরও গার্সিয়া মার্কেসকে বাঙালি বলা যাবে না?

আর ‘সরলা এরেন্দিরা’? সে গল্পে এরেন্দিরার হাতের কাচ কখনও লাল, কখনও নীল, কখনও সবুজ আলোয় ভরে যাচ্ছে। ঠাকুমা বলছেন, ‘তুই প্রেমে পড়েছিস। প্রেমে পড়লে এই রকম হয়।’ পরে লেখক বলেছিলেন, ‘ওটাই জাদুবাস্তবতা। পৃথিবীতে প্রেমে পড়ার মুহূর্ত এত বার লেখা হয়েছে যে নতুন ভাবে কথাটা বলতে হল।’ আমাদের মতো প্রতিদিন যারা নিত্য নতুন প্রেমে পড়ে, অহরহ আতস কাচের রংবদল দেখে, জীবনে ভুলতে পারবে এই লেখককে? তাঁর আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ডও তো শেষ করেছিলেন প্রেমে। তখনও বিয়ে হয়নি। ইউরোপ যাওয়ার আগে বোহেমিয়ান তরুণ রাত দুটোয় বিমানবন্দরের মেলবক্সে ফেলে দিলেন মার্সেদেসকে লেখা চিঠি: এক মাসের মধ্যে উত্তর না পেলে আমি আর দেশে ফিরব না। গার্সিয়া মার্কেস প্রেমে পড়তেও শিখিয়েছেন।

এর পরও মন খারাপ না হয়ে পারে?

goutam chakraborty
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy