Advertisement
E-Paper

যাতে কিছুতেই নিশ্চিন্ত থাকতে না পারি

বাঙালির দেবকুলে স্থান পাননি মৃণালবাবু। ভাগ্যিস। পেলে কি আর কেবলই আমাদের টেনে এনে আয়নার সামনে দাঁড় করাতে পারতেন? শিলাদিত্য সেনবাড়িতে তখনও টিভি আসেনি। সত্তর দশক শেষ হয়ে আসছে, স্কুলে পড়ি। আমাদের আবাসনে যে দু’একটি পরিবারে টিভি ছিল, তাঁদের একটির বসবাস ঠিক আমাদের উপরের ফ্ল্যাটটিতে। সেখানেই প্রথম ‘পদাতিক’ দেখি। ছবিতে একটা বেবিফুডের বিজ্ঞাপন ছিল, তাতে আনন্দশঙ্করের আবহ-এর সঙ্গে ভাষ্যে বলা হচ্ছিল: চারিদিকে ভেজাল আর ভেজাল, ভেজালের রাজত্বে মায়ের বুকে আশা জাগাতে, শিশুর মুখে হাসি ফোটাতে খাঁটি বেবিফুড... সঙ্গে সুন্দর সচ্ছল পরিবারের মা ও শিশুর ছবি। হঠাৎ দ্বিতীয় বার বিজ্ঞাপনটা ফিরে এল, ওই একই আবহ আর ভাষ্যে, শুধু সুন্দর সচ্ছল মা ও শিশুর সঙ্গে ফুটপাথে পড়ে-থাকা অনাহারী, অপুষ্ট, নিদারুণ রুগ্ণ কয়েক জন মা ও শিশুর ছবি।

শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০১৪ ০০:৩৪
ছবিতে ‘আকালের সন্ধানে’র একটি মুহূর্ত।

ছবিতে ‘আকালের সন্ধানে’র একটি মুহূর্ত।

বাড়িতে তখনও টিভি আসেনি। সত্তর দশক শেষ হয়ে আসছে, স্কুলে পড়ি। আমাদের আবাসনে যে দু’একটি পরিবারে টিভি ছিল, তাঁদের একটির বসবাস ঠিক আমাদের উপরের ফ্ল্যাটটিতে। সেখানেই প্রথম ‘পদাতিক’ দেখি। ছবিতে একটা বেবিফুডের বিজ্ঞাপন ছিল, তাতে আনন্দশঙ্করের আবহ-এর সঙ্গে ভাষ্যে বলা হচ্ছিল: চারিদিকে ভেজাল আর ভেজাল, ভেজালের রাজত্বে মায়ের বুকে আশা জাগাতে, শিশুর মুখে হাসি ফোটাতে খাঁটি বেবিফুড... সঙ্গে সুন্দর সচ্ছল পরিবারের মা ও শিশুর ছবি। হঠাৎ দ্বিতীয় বার বিজ্ঞাপনটা ফিরে এল, ওই একই আবহ আর ভাষ্যে, শুধু সুন্দর সচ্ছল মা ও শিশুর সঙ্গে ফুটপাথে পড়ে-থাকা অনাহারী, অপুষ্ট, নিদারুণ রুগ্ণ কয়েক জন মা ও শিশুর ছবি। বয়ঃসন্ধিতে বেশ ধাক্কা লেগেছিল।

মৃণাল সেন বরাবরই এ রকম, বড় বেশি অস্বস্তিতে ফেলে দেন বাঙালি মধ্যবিত্তকে। তাঁর ছবি মাঝে মাঝেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে থাকে, আমাদের বেঁচে থাকায় কত রকমের অসঙ্গতি। যেমন, সাধারণের একটা বড় অংশ যখন বুভুক্ষাগ্রস্ত, এক শ্রেণির মানুষ তখন দিব্যি খেয়েপরে বেঁচে আছে, কী করে? বাজারে খাবার জোগান আছে, এক দলের দখল আছে সেই খাবারের ওপর, অথচ অন্য দলের নেই বলে তারা শুকিয়ে মরে যাচ্ছে, এ-ও বা হচ্ছে কী করে? অনেক সময় দেশে খাদ্যের প্রাচুর্য সত্ত্বেও বহু লোক ক্ষুধার্ত থাকতে বাধ্য হয়, কেন? খিদের অনুষঙ্গে এ সমস্ত প্রশ্ন তুলে গিয়েছেন মৃণাল সেন অবিরত।

‘কোরাস’-এ এক রাঁধুনির চরিত্রে গীতা সেন চুপচাপ নানান সুস্বাদু পদ রান্না করে চলেন ছিমছাম এক ফ্ল্যাটে, ভেসে-আসা ভাষ্যে শুনি তাঁর মনের কথা: কত কী রান্না করি এখানে, অথচ এর একটা টুকরোও দিতে পারি না আমার বাচ্চাগুলোর মুখে। ‘কলকাতা ৭১’-এ চোদ্দো-পনেরো বছরের ‘স্মাগলার’ ছেলেটি, চলন্ত অবস্থায় ট্রেন বদল করে যে চাল পাচার করত, তার দলবলকে দেখে ভদ্রলোক ট্রেনযাত্রী বলে ওঠেন: সারা দেশটা ছোটলোক বনে যাচ্ছে। ছেলেটি এ-সব কিছুই পরোয়া করে না, কাউকে ভয় পায় না, পুলিশকেও না, ভয় পায় শুধু একটা জিনিসকে। খিদে।

‘বাইশে শ্রাবণ’-এ তেরোশো পঞ্চাশের মন্বন্তর ঢুকে পড়ে প্রিয়নাথ-মালতীর সংসারে, তাদের সম্পর্কের ভিত নড়ে যায়। এক মধ্যাহ্নে গোগ্রাসে খেতে খেতে ভাতের হাঁড়ির দিকে তাকায় প্রিয়নাথ, মালতী হাঁড়ি থেকে চেঁচেপুঁছে তাকে ভাত দেয়। স্বামী উঠে গেলে হাঁড়িতে হাত ঢুকিয়ে এক মুঠো ভাতও পায় না, হাঁড়িতে জল ঢেলে দেয়, বলে ‘বড়লোক মামার সংসারে লাথিঝাঁটা খেয়ে মানুষ, দু’চার বেলা খেতে-না-পাওয়া, ও আমার গা-সওয়া হয়ে গেছে।’ বিদেশে এক ফেস্টিভ্যালে এ ছবি দেখানোর আগে দিল্লির তথ্য-সম্প্রচার মন্ত্রক থেকে উপদেশ এসেছিল মৃণালবাবুর কাছে: প্রিয়নাথের খাওয়ার দৃশ্যটা বাদ দিতে হবে। কারণ? একটা মানুষ শীর্ণকায় আঙুল দিয়ে ভাত চটকে চটকে খাচ্ছে, এ তো এক ধরনের অসুস্থতা! উপদেশটা অবশ্য বলবৎ হয়নি শেষ পর্যন্ত।

‘বাইশে শ্রাবণ’-এর কুড়ি বছর পর ১৯৮০-র সেপ্টেম্বরে কলকাতার কাছেই একটা গ্রামে ১৯৪৩-এর সেই আকাল নিয়ে ছবি করতে যান এক পরিচালক, সঙ্গে তাঁর ফিল্ম ইউনিট। ‘আকালের সন্ধানে’। হাইওয়ে থেকে গাড়িগুলো গ্রামে ঢোকার সময় এক হাড়-জিরজিরে বুড়ো বলে ওঠে ‘বাবুরা এয়েচেন আকালের ছবি তুলতে, আকাল তো আমাদিগের সব্বাঙ্গে।’ পরিচালক টের পান, আশির মধ্যে তেতাল্লিশ ঢুকে পড়ছে। তিনি তখন ইউনিটের মানুষজনকে দুর্ভিক্ষের ডকুমেন্টেশন আছে এমন ফোটোগ্রাফ দেখাতে শুরু করেন, আর বলতে থাকেন ‘এক বছরে মরে গেল পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ, স্রেফ না খেতে পেয়ে...’

অভিনেতাদের অন্যতম নীলকণ্ঠ সেনগুপ্ত হঠাৎ প্রশ্ন করেন, ‘সব ছবি কি তেতাল্লিশের?’ পরিচালক সঙ্গে সঙ্গে ‘একটা ছবি দেখবে? দেখবেন? দেখুন’ বলে অর্ধেক ভাঁজ করা হাড়-বের-করা এক বুভুক্ষু মানুষের ভয়ঙ্কর এক ছবি দেখান, তার পর ছবিটা একটু সরিয়ে পুরোটা মেলে ধরেন গৌতম বুদ্ধের অনাহারের ছবি। দেখে দীপঙ্কর দে বলেন, ‘স্টার্ভিং বুদ্ধ’। বৈষম্যের কারণে অভুক্ত মানুষের ঠিক এই অসহায়তাকেই বার বার ছবিতে ফিরিয়ে আনেন, চিহ্নিত করেন মৃণাল সেন। বলেন, ‘এতটা সময় ধরে... বলতে চাইছি যে physical look of hunger এক, একেবারেই এক, হাজার বছর আগেও যা ছিল, হাজার বছর পরেও তাই। দারিদ্র, অনাহার ইত্যাদির পরিণতি হাজার বছর আগেও যা ছিল, এখনও তা-ই আছে।’

আকালের সন্ধানে-র পরিচালককে প্রায় বাধ্য হয়েই শুটিং বন্ধ করে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। কিন্তু সরে এলে, মুখ ফিরিয়ে নিলেই কি জীবন যাপনের অসঙ্গতি থেকে পালানো যায়? বৈষম্যকে এড়িয়ে চলা কি আত্মপ্রবঞ্চনা নয়? এমন সব নৈতিক প্রশ্নের মুখোমুখি বাঙালি মধ্যবিত্তকে বার বার দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন মৃণাল সেন। ‘খারিজ’-এর অঞ্জন দত্ত শিক্ষিত, সুরুচিপূর্ণ, ভদ্র মধ্যবিত্ত পরিবারের গৃহস্বামী, পালান নামে তাঁর ‘কাজের ছেলে’টির উপর তিনি বা তাঁর স্ত্রী মমতা কখনও কোনও দুর্ব্যবহার বা অত্যাচার করেননি। কিন্তু পালান মারা যাওয়ার পর অঞ্জন যখন বলতে থাকেন, ‘ও আমাদের বাড়ির লোকের মতোই ছিল’, বা ‘কিন্তু আমাদের কী দোষ বলুন? আমরা তো মানে’, কিংবা বাড়িওয়ালার ঘাড়েও দোষ চাপানোর চেষ্টা করেন, ‘ওই রান্নাঘরে যদি একটা ভেন্টিলেটার থাকত না তা হলে হয়তো’; তখন স্পষ্ট হয়ে আসে গৃহস্বামী তাঁর ভদ্রতার আড়ালে পালানের প্রতি তাঁদের যে অনাদর, সেটাকে নির্মমতা বলে স্বীকার করতে পারছেন না। আবার লজ্জাও পাচ্ছেন, মমতাশংকরকে বলছেন, ‘যে ভাবে মারা গেল, সে আমাদের লজ্জা। আর হাজার লোকের হাজারটা প্রশ্ন!’ পালানের মৃত্যুর থেকেও নিজেদের সম্মান বাঁচানোটা বেশি জরুরি হয়ে পড়ে অঞ্জন-মমতার কাছে, দাহের পর পালানের বাবার ‘বাবু চলি...’ বলে নমস্কারে তাঁদের আশঙ্কার ছায়া কেটে যায়, তাঁরা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন।

আমরা যাতে হাঁফ ছাড়তে না পারি, লজ্জাবোধ থেকে কখনও রেহাই না পাই, সে বন্দোবস্তই করে চলেন মৃণাল সেন। ‘একদিন প্রতিদিন’-এ হাসপাতালে প্রতীক্ষারত বেশ কয়েকটা পরিবার, তাঁদের নিরুদ্দেশ মেয়ের খোঁজ করতে এসেছেন। নার্স এসে যখন মেয়েটির মৃত্যুসংবাদ দিয়ে তাকে শনাক্ত করতে বলেন, এক-এক জন করে এগিয়ে আসেন, দেখেন, আর নিজের পরিবারের মেয়ে না হলেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে চলে যান। শেষমেশ পড়ে থাকেন শুধু এক জন, আশিসবাবু, শনাক্ত করতে পারেন এ তাঁর বোনেরই মৃতদেহ। একা অসহায় দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। আমরা লজ্জায় মাথা নামাই।

১৯২৩ সালে জন্মেছিলেন মৃণাল সেন, আজ তাঁর একানব্বই পূর্ণ হল। স্বাধীনতার পর পাঁচ দশক ধরে ক্রমাগত আমাদের বাঁকাচোরা জীবনের ছবি তুলে গিয়েছেন, দুর্লঙ্ঘ্য বৈষম্যের তাড়নায় মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক যেখানে হঠাৎ ঘূর্ণিতে ঢুকে পড়ে; যেখানে মূল্যবোধের সংহতি নেই, ব্যবহারবোধেরও সঙ্গতি নেই; যেখানে মধ্যবিত্ত জীবনের আপাতমসৃণতা ফেটে নারকীয় ক্ষয়, স্বপ্নভঙ্গ, তিক্ততা, কর্কশ অনুভূতিরা বেআব্রু হয়।

শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন বছর কুড়ি আগে: ‘দুর্ভাগ্য, নাকি ভাগ্যই বলব, মৃণাল সেনের, তিনি কোনও দিন বাঙালির দেবকুলে স্থান পাননি।’ পেলে বোধহয় তিনি এ ভাবে চুল ধরে টেনে এনে আমাদের আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিতে পারতেন না!

probondho shiladitya sen
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy