Advertisement
E-Paper

শহরের ভিতরে শহর

ক্যামেরা নিয়ে প্রান্তিক জীবনের খোঁজে পথ হাঁটেন এক পরিচালক। তাঁর কথা লিখছেন শিলাদিত্য সেনলোকটা গায়ে বাড়ির বিজ্ঞাপন ঝুলিয়ে তাইপেই শহরের রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, অথবা দাঁড়িয়ে থাকে। শরীর জুড়ে শহরবাসীদের জন্য বিলাসবহুল আবাসনের হাতছানি। সে নিজে অবশ্য গৃহহীন। ছোট ছোট দুটো ছেলেমেয়ে, তারাও সারা দিন শহরটার পথে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়ায়, বিশেষ করে ছুটে ছুটে যায় সুপারমার্কেট বা মলগুলোয়, যেখানে নানান খাবারের ‘ফ্রি সাম্পল’ মিলবে।

শেষ আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০১

লোকটা গায়ে বাড়ির বিজ্ঞাপন ঝুলিয়ে তাইপেই শহরের রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, অথবা দাঁড়িয়ে থাকে। শরীর জুড়ে শহরবাসীদের জন্য বিলাসবহুল আবাসনের হাতছানি। সে নিজে অবশ্য গৃহহীন। ছোট ছোট দুটো ছেলেমেয়ে, তারাও সারা দিন শহরটার পথে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়ায়, বিশেষ করে ছুটে ছুটে যায় সুপারমার্কেট বা মলগুলোয়, যেখানে নানান খাবারের ‘ফ্রি সাম্পল’ মিলবে। রাতে মাথা গোঁজার ঠাঁই বলতে পরিত্যক্ত বাড়িগুলো, যেগুলো ভেঙে দু’দিন পরেই হাইরাইজ হবে। অথবা কোথাও কোনও একটা নোংরা স্যাঁতসেঁতে ঘর, যার টিনের চালে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো দামামা পেটায়।

সাই মিং-লিয়াং-এর ছবি ‘স্ট্রে ডগস’ (২০১৩)। তাইওয়ানের এই পরিচালক দশ বছর ধরে ক্যামেরা নিয়ে তাড়া করছেন ওই প্রান্তিক মানুষগুলোকে। কী ভাবে বাঁচে তারা, এই প্রশ্নটা বহু দিন ধরে তাঁর মাথায় ঘোরে। চোখের সামনে রাজধানী শহরটা বদলে যাচ্ছে দ্রুত, তবু, চোখধাঁধাঁনো উন্নয়নের আড়ালে এখানে ওখানে নানান অন্ধকার। শহরের ভিতরে আর এক শহর।

জন্মসূত্রে (১৯৫৭) সাই মিং-লিয়াং মালেশিয়ার চিনা। তাইওয়ানে চলে এসেছিলেন নাটক নিয়ে পড়াশোনা করতে। কান-বার্লিন-ভেনিসে লাগাতার পুরস্কার পেয়ে চলেছেন বলে সারা দুনিয়ার ছবি-সমালোচকরা তাঁর সিনেমায় নানা ধরনের মেটাফর আবিষ্কার করছেন। তিনি নিজে অবশ্য বলেন, ‘আমি মনে করি না আমি কখনও বাস্তবতা থেকে সরে এসেছি।’

না, কোনও সমাজবদলের ফতোয়া নিয়ে ছবি করেন না সাই মিং-লিয়াং। তাঁর ছবি নয় কোনও দারিদ্রের দলিল-চিত্রও। তাঁর ছবির বাস্তবতা কোনও বাঁধা সড়কে হাঁটে না, নানান সর্পিল গলিপথে ঘুরে বেড়ায়, আর অস্বস্তিতে ফেলে দেয় তাইপেইবাসীদের। তাঁরা যে ভাবে তাঁদের শহরকে, দেশকে চেনেন, তার বাইরেও একটা তাইপেই আছে, একটা তাইওয়ান আছে। সাই শুধু তাঁদের খেয়াল করিয়ে দেন, জঞ্জালের স্তূপ, এঁদো গলি, ঘুপচি ঘরে বেঁচে থাকা প্রান্তিক মানুষগুলোও, তাঁদের মতোই, মহানাগরিক। তিনি বলেন, ‘মানুষগুলো আমার জীবনযাপনের অংশ, আমার অস্তিত্বের অংশ।’

সেই প্রান্তিক জীবন কিন্তু তার হৃদয়ে মোটেও নিঃস্ব নয়। যেমন ‘আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু স্লিপ অ্যালোন’ (২০০৭) ছবিটা। (উপরে এই ছবির একটি দৃশ্য) বেদম প্রহারে আচ্ছন্ন গৃহহীন এক মানুষকে শুশ্রূষা দিতে এগিয়ে আসে সীমান্ত-পেরনো এক মজুর আর মস্তিষ্ক-অকেজো এক রুগিকে নিরন্তর শুশ্রূষা করে চলে অল্পবয়সি এক মেয়ে। মানুষগুলোর দাঁত-বের-করা জীবনে আশ্চর্য প্রলেপ নিয়ে আসে পুরনো দিনের চিনা গান: ‘শীতের রাতে বসন্তের বাতাস বইছে... যে স্বপ্ন হারিয়ে ফেলেছি তা কি ভুলতে পারি?’

অন্য রকম মানুষও আছে সাইয়ের ‘ভিভ লামর’ (১৯৯৪) বা ‘দ্য রিভার’ ছবিতে। বিশ্বায়নপ্রসূত উন্নয়নের প্রসাদ তাদের কাছে এসে পৌঁছেছে। কিন্তু এই উন্নয়নের সঙ্গে তারা ঠিক মানিয়ে নিতে পারে না, উল্টে এই উন্নয়নের অভিঘাতে তাদের জীবিকার এবং জীবনের অনিশ্চয়তা বেড়ে চলে। নব্বইয়ের দশকে তাইওয়ানের অর্থনীতির আকস্মিক উল্লম্ফনে কেমন দিশেহারা তখনকার তরুণ নাগরিকরা, দেখেছিলেন সাই। ক্রমশ তাদের একটা অংশ লেখাপড়া থেকে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে, উচ্চশিক্ষার বদলে ভিডিয়ো বা কম্পিউটারের বাজারে বুঁদ হয়ে গিয়েছে। বিচ্ছিন্নতা আর খণ্ডতার এক অদ্ভুত জগৎ তাদের, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের, সম্পর্কের স্বাভাবিক গতি সেখানে হঠাৎ ঘূর্ণিতে ঢুকে পড়ে। যুক্তিহীন বিশৃঙ্খল এক হযবরল জীবন উঠে আসে সাইয়ের ছবিতে। নানা দিক থেকে দেখা সেই জীবনের কথা বলে তাঁর ‘দ্য হোল’ (১৯৯৮) কিংবা ‘দ্য ওয়েওয়ার্ড ক্লাউড’ (২০০৫)। এ বার কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে আছে সাই মিং-লিয়াংয়ের রেট্রোস্পেকটিভ।

সাইয়ের ছবি বার বার মনে করিয়ে দেয় নিজের সম্পর্কে তাঁর স্পষ্ট মন্তব্য: ‘আমি ছবি শুরুই করি বাস্তবানুগ ইমেজ দিয়ে, যা একেবারেই আমার অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া।’ সাইয়ের ছবির মূল উপজীব্য এই বাস্তব অভিজ্ঞতা, যে বস্তুটির বড়ই অভাব অধিকাংশ হালফিল বাংলা ছবিতে।

shiladitya sen film
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy