Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

সূর্য পৃথিবী আপেল আর ওয়েন রুনি

পদার্থবিদ স্টিফেন উইলিয়াম হকিং অঙ্ক কষে বের করেছেন এই বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের জয়ের সম্ভাবনা। সে ভবিষ্যদ্বাণী মিলবে? না কি, তিনিও র‌্যানডমনেস-এর হিসেব রাখতে ভুলে গিয়েছেন? পথিক গুহস্টিফেন উইলিয়াম হকিং যা করেছেন, তাকে নিন্দুকেরা বলবেন জ্যোতিষীগিরি। কত টেম্পারেচারে খেলা হলে, প্লেয়াররা কোন রঙের জার্সি পরলে, কী চুলের রঙের খেলোয়াড় পেনাল্টি মারলে কিংবা কোন দেশের রেফারি মাঠে থাকলে ইংল্যান্ডের জয় বা পরাজয়, তার পূর্বাভাস দিয়েছেন।

শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০১৪ ০০:০২
Share: Save:

স্টিফেন উইলিয়াম হকিং যা করেছেন, তাকে নিন্দুকেরা বলবেন জ্যোতিষীগিরি। কত টেম্পারেচারে খেলা হলে, প্লেয়াররা কোন রঙের জার্সি পরলে, কী চুলের রঙের খেলোয়াড় পেনাল্টি মারলে কিংবা কোন দেশের রেফারি মাঠে থাকলে ইংল্যান্ডের জয় বা পরাজয়, তার পূর্বাভাস দিয়েছেন। এ সব তো গনতকারি! জ্যোতিষ চর্চার আঁতুড়ঘরে জ্যোতির্বিজ্ঞান জন্মেছিল বটে, কিন্তু সে সব আদ্যিকালের ব্যাপার। আজ যে-সব জ্যোতিষী সাইনবোর্ডে ‘সায়েন্টিফিক অ্যাস্ট্রোলজি’-র প্রতিশ্রুতি দিয়ে লোক ঠকান, তাঁরা বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের ব্যঙ্গের পাত্র। বিজ্ঞান আর জ্যোতিষ? ও তো তেল আর জল। জ্যোতিষ বিজ্ঞান হলে বিজ্ঞান বলে যেটা চালু, তা আর যা-ই হোক, বিজ্ঞান নয়।

অবশ্য, হকিং-সমর্থকরা উড়িয়ে দিতে পারেন নিন্দুকদের সমালোচনা। বলতে পারেন, মোটেই জ্যোতিষীগিরি করেননি বিজ্ঞানী। তা করলে তো বলতেন, প্লেয়াররা স্ত্রীর সঙ্গে রাত কাটালে মাঠে যা ফল, বান্ধবীর সঙ্গে থাকলে তার অন্যথা, কারণ স্ত্রী এবং বান্ধবীর রাশিচক্র এক নয়। কিংবা মিল নেই তাদের হস্তরেখায়। আর হ্যাঁ, হকিং তো খেলায় হারজিতের ফোরকাস্ট করেননি। বরং অঙ্ক কষে বের করেছেন জয় বা পরাজয়ের সম্ভাবনা। লাল জার্সিতে যে-কোনও টিমকে যে একটু বেশি ভয়ঙ্কর দেখায় সাদা জার্সির চেয়ে, কিংবা রেফারির বাঁশি যদি থাকে কোনও ইউরোপিয়ানের হাতে, তবে গুরু পাপেও লঘু দণ্ড যে পেতে পারে হকিং-এর দেশের খেলোয়াড়, সে সব কি মিথ্যে? তো সে সব ফ্যাকটর অঙ্কে মিশিয়ে হিসেব কষলে ক্ষতি কী? গণিত কোন দুঃখে হবে জ্যোতিষ? পাছে কেউ তাঁর কাজ গনতকারি বলে নাক সিঁটকোয়, তাই নিজের সাফাই গাইতে কসুর করেননি হকিং নিজেও। বলেছেন, তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী বা পরামর্শ উড়িয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। গত বার সব ম্যাচের রেজাল্ট আগাম বলে শোরগোল ফেলেছিল জার্মানির চিড়িয়াখানার যে অক্টোপাস ‘পল’, তার চেয়ে নিশ্চয়ই বেশি বুদ্ধিমান তিনি।

আলবাত। পশুপাখি কেন, মনুষ্যকুলেও নমস্য হকিং। কারণ, মানুষের যা সেরা আবিষ্কার, সেই বিজ্ঞানের অন্যতম সেরা চর্চাকারী তিনি। আর, শাস্ত্রজ্ঞ হওয়ার দরুন শাস্ত্রের মূলমন্ত্রে ষোলোআনা আস্থা তাঁর। সে মন্ত্রের নির‌্যাস দুই। এক, কার্য-কারণে অটুট সম্পর্ক। কার্য বাঁধা কারণের খুঁটিতে। বাঁধনের দড়িটি আবার বুদ্ধিগ্রাহ্য যুক্তি। অং-বং-ছং বা ম্যাজিক নয়। বিজ্ঞানের দু’নম্বর নির‌্যাস নির্ধারণবাদ। ডিটারমিনিজম। সব কিছু পূর্ব-নির্ধারিত। আজকের পরিস্থিতি যেহেতু গত কালের পরিণাম, আগামিকাল যেহেতু লুকোনো আছে আজকেরই গর্ভে, সেহেতু গতকাল বসে বলে দেওয়া যেত আজকের পরিস্থিতি, বা আজ আগাম বলা যাবে কালকের দশা। গনতকারি? তা বটে, তবে এটা লাগে-তুক-না-লাগে-তাক গোছের ব্যাপার নয়। বরং, ঘটনা পরম্পরা যখন নির্ধারিত, তখন গণিতের সাহায্যে নির্ভুল পূর্বাভাস।

বিজ্ঞানে এ হেন নির্ধারণবাদের জনক হিসেবে খ্যাত এক জন। আইজাক নিউটন। যদিও তাঁর আগে টাইকো ব্রাহে-র মতো কেউ কেউ জ্যোতিষীদের গণনা ভুল প্রমাণ করে বলে দিয়েছেন কোন ধূমকেতু কবে ফের উদয় হবে, তবু ওঁরা পরিচিত নন নির্ধারণবাদের জনক হিসেবে। কেনই বা হবেন? ওঁরা তো আর মহাকর্ষ সূত্র আবিষ্কার করেননি। হাজার হাজার বছরের পুরনো ধারণা বাতিল করে দিয়ে বলতে পারেননি যে, স্বর্গে আর মর্তে আলাদা নিয়ম চালু নেই, সবখানে এক আইন। যে কারণে চাঁদ পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে, ঠিক সে কারণেই গাছের আপেল মাটিতে পড়ে। শুধু কারণ বাতলানো নয়, সেই কারণের ফলে কার্য হবে কতটা— গ্রহ-তারা-উপগ্রহ কে কোথায় কখন থাকবে— তা আগাম বলে দেওয়ার ফরমুলাও আবিষ্কার করেন নিউটন। নির্ধারণবাদের পিতা, আলবাত।

হায় ডিটারমিনিজম! তা আমদানি করতে গিয়ে চরম আস্তিক নিউটন যে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিলেন ঈশ্বরকে। গ্রহ-তারা-উপগ্রহ যদি চলে শুধু মহাকর্ষের অঙ্ক মেনে, তা হলে আর এই বিশ্বে ঈশ্বরের ভূমিকাটা থাকল কোথায়? ব্যাপারটা বোঝালেন ফরাসি বিজ্ঞানী পিয়ের-সিমো লাপ্লা। দু’খণ্ডে লিখলেন বিশ্ববিজ্ঞানের ওপর বিশাল বই। গ্রহ-তারা-উপগ্রহের চলন নিয়ে। সে বই পড়তে দিলেন সম্রাট নেপোলিয়ঁ বোনাপার্তকে। পড়ে তিনি রুষ্ট। প্রশ্ন করলেন, ‘বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নিয়ে কেতাব, অথচ কোথাও ঈশ্বরের প্রসঙ্গ নেই কেন?’ লাপ্লা-র জবাব, ‘রাজন, সে রকম কোনও কল্পনার প্রয়োজন হয়নি।’ এই লাপ্লা পরে এক লেখায় চুম্বকে পেশ করলেন নির্ধারণবাদের দর্শন। কল্পনা করলেন প্রচণ্ড বুদ্ধিমান এক মস্তিষ্ক। যার অঙ্ক কষার দক্ষতা অসীম। সে যদি জানে আজ ব্রহ্মাণ্ডে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা থেকে অতিকায় গ্যালাক্সি কে কোথায় আছে, তবে অঙ্ক কষে সে নির্ভুল বলে দেবে সে-সব কাল কোথায় থাকবে। ভবিষ্যৎ তার সামনে স্পষ্ট হবে অতীতের মতো।

নির্ধারণবাদের ক্ষমতা কি কম! নেপচুন গ্রহ আবিষ্কারের কথাই ধরা যাক। ১৮৪৬ সাল। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মাথা চুলকে মরছেন। ইউরেনাস গ্রহ বাগড়া দিচ্ছে। অঙ্কে তার কক্ষপথ হওয়ার কথা যেমন, বাস্তবে তা হচ্ছে না। গোলমাল কেন? জবাব দিলেন ফরাসি গণিতজ্ঞ আরবাঁ লা ভেরিয়ার। মহাকর্ষের অঙ্ক কষে বললেন, কাছাকাছি অজানা আর এক গ্রহের টানে বদলে যাচ্ছে ইউরেনাসের পথ। একেবারে ঠিক কোথায় সেই গ্রহটি, তাও আগাম বলে দিলেন লে ভেরিয়ার। জার্মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী জোসেফ গাল সঙ্গে সঙ্গে দূরবিন তাক করলেন আকাশের সেইখানে। নির্ভুল পূর্বাভাস। ওইখানে ঘাপটি মেরে এক গ্রহ। নেপচুন। ৩০০ বছর আগে প্রয়াত নিউটন আজও অমর। আমেরিকার স্পেস শাটল হোক কিংবা ভারতের চন্দ্রযান, আজও সব কিছু মহাশূন্যে ছোটে তাঁর আবিষ্কৃত ফরমুলা মেনে। শুধু আগামী বছর নয়, পাঁচশো-হাজার বছর পরেও সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণ পৃথিবীর কোথায় ক’ঘণ্টা ক’মিনিট ক’সেকেন্ড দেখা যাবে, বিজ্ঞানীরা বলে দেন ওই ফরমুলার সাহায্যেই। নির্ধারণবাদ যুগ যুগ জিও!

যদিও...। হ্যাঁ, যদিও গত শতাব্দীর গোড়ায় ঘটেছে এক কাণ্ড। আবিষ্কৃত হয়েছে অণু-পরমাণুর আজব দুনিয়া। যেখানে নির্ধারণবাদ ডাহা ফেল। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা বুড়ো আঙুল দেখায় নিউটনের ফরমুলাকে। কোনও এক মুহূর্তে একটা কণার না আছে নির্দিষ্ট অবস্থান, না আছে নির্দিষ্ট গতিবেগ। তো এমন জিনিসের আবার অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ পরম্পরা কী? আগাম কিছু বলার সুযোগই বা কোথায়? বিজ্ঞানই বুঝি যায় রসাতলে! নতুন আবিষ্কার মানতে নারাজ আলবার্ট আইনস্টাইন। যদিও নিজে নাস্তিক, তবু আপত্তি বোঝাতে ধার করলেন ঈশ্বরের উপমা। বললেন, ঈশ্বর পাশা খেলেন না। মানে, অনির্দিষ্ট ব্যাপার-স্যাপার বাস্তবে অসম্ভব। তা সে যা-ই বলুন আইনস্টাইন, কণাদের রাজ্যে ব্যাপার-স্যাপার কিন্তু অনির্দিষ্টই। তাই আইনস্টাইনের ওই মন্তব্যের প্রতিবাদে নতুন বিজ্ঞানের জনক নিলস বোর বললেন, ‘আপনাকে আর বলে দিতে হবে না ঈশ্বর কী করবেন।’ কণাদের আজব ঘর-গেরস্থালির খবর মেলার পর থেকে বিজ্ঞান দু’ভাগে আলাদা। বড়সড় বস্তুর রাজ্য, যেখানে নির্ধারণবাদ কায়েম। আর অণু-পরমাণু, যেখানে তা বাতিল।

ওই বিভাজন গবেষণার বিষয়, জার্নালে দিস্তা দিস্তা পেপারের উপজীব্য, তবে বিজ্ঞানের পাবলিক ইমেজ কিন্তু আগাপাশতলা ওই নির্ধারণবাদ। ওই প্রেডিকশনের ক্ষমতা। কাল কী ঘটবে? আকাশে গ্রহ-তারার চক্কর যদি আগাম বলা যায়, তবে জুয়াখেলায় হার-জিত বলা যাবে না কেন? ক্যাসিনোতেও তো সেই রুলেট চাকতির চক্কর। তার ফল আগাম বলতে পারলে তো রাতারাতি বড়লোক! শুধু ওই চক্করের হিসেবটা চোখের নিমেষে করে ফেলতে পারলেই হল। ১৯৬০-এর দশকে ওই ভাবনা মাথায় খেলল গুটিকয় তরুণ বিজ্ঞানীর। তাঁরা বানিয়ে ফেললেন একরত্তি কম্পিউটর। নিমেষে গণনার জন্য। লুকিয়ে জুতোর মধ্যে সেই কম্পিউটর নিয়ে কয়েক বন্ধু হানা দিলেন লাস ভেগাস শহরের ক্যাসিনোয়। নাহ্, ক্যাসিনো-মালিকদের ফতুর করে দিয়ে তাঁরা নিজেরা আমির বনতে পারলেন না। পারবেন কী করে? রুলেট চাকতির চক্কর যে গ্রহ-তারার চলনের চেয়ে ঢের বেশি জটিল।

যেমন জটিল রোদ-জল-ঝড়ের পূর্বাভাস। আবহাওয়ার মূলে লুকিয়ে থাকে ডজন ডজন ফ্যাকটর। সব কিছুর সম্মিলিত প্রভাব হিসেব করা যন্ত্রের সাধ্যাতীত। সবচেয়ে ঝামেলা হিসেবের শুরুটা। তখন কোনও এক ফ্যাকটরের একচুল এ দিক-ও দিক মানে পরিণামে পেল্লায় ফারাক। ওই যে বলে, সুন্দরবনে প্রজাপতি ডানা ঝাপটালে সাও পাওলোতে ঝড়। স্টক মার্কেটে ওঠা-নামা আগাম ধরতে চান যে-সব পণ্ডিত, তারাও হিমশিম। ১৯৯৮-এর অগস্টে ওয়াল স্ট্রিটে ধসের কথা ধরা যাক। যার ধাক্কায় সারা পৃথিবীর অর্থনীতি হয়েছিল কুপোকাত। হিসেব বলছে, তেমন বিপর্যয়ের সম্ভাবনা আড়াই কোটিতে এক। মানে, এক লক্ষ বছরে এক বার ঘটতে পারে তা। অপেক্ষা করতে হল না তত কাল। এক দিন বেমক্কা নেমে এল সর্বনাশ। কোনও পণ্ডিত যার পূর্বাভাস দিতে ব্যর্থ। স্টক অ্যানালিস্ট নাসিম তালেব তাই বই লিখেছেন একখানি। ‘ফুল্ড বাই র‌্যানডমনেস: দি হিড্ন রোল অফ চান্স ইন লাইফ অ্যান্ড দি মার্কেটস’। উপজীব্য: সাফল্যে বুদ্ধি বা দক্ষতার ভূমিকা গৌণ। বড় কথা চান্স ফ্যাকটর। কারণ চার দিকে র‌্যানডমনেস। এলোপাথাড়ি কাণ্ডকারখানা।

ঠিক। ইংল্যান্ডের সঙ্গে খেলা যে সব প্রতিপক্ষ দলের, তাদের গোলকিপারদের হঠাৎ ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠার চান্স, সেন্টার-ফরোয়ার্ডদের হঠাৎ ভাল খেলার সম্ভাবনা কি হকিং তাঁর অঙ্কে রেখেছেন? এক বারও ভেবেছেন ওই সব দলের ডিফেন্ডারদের রাফ ট্যাক্ল-এ চোট পেয়ে রুনির মাঠ ছাড়ার সম্ভাবনা? হয়তো ভাবেননি, কারণ ও-সব তো র‌্যানডমনেস। যা কিনা বিজ্ঞানের সিলেবাসের বাইরে। হকিং মনে রাখেননি নিলস বোর-এর সেই সরস মন্তব্য। ‘প্রেডিকশন ইজ ভেরি ডিফিকাল্ট, ইফ ইট’স অ্যাবাউট দি ফিউচার।’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

pathik guha rooney
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE