Advertisement
E-Paper

সংসদীয় কমিটি আর্সেনিকের হাঁড়িটি ভাঙলেন

মাটির নীচে জল, সেই জলে আর্সেনিক। দেশ জুড়েই এই বিপদ, পশ্চিমবঙ্গে বিশেষ করে। কিন্তু সচেতনতা? প্রতিরোধের আয়োজন? দূর অস্ত্।এই প্রথম মৌচাকে ঢিল পড়ল, যদিও অনেক দেরিতে। ৩২ বছর আগে পড়লে অনেক মানুষের জীবন বাঁচত! ষোড়শ লোকসভার জলসম্পদ, নদী উন্নয়ন এবং গঙ্গা পুনরুজ্জীবন মন্ত্রকের কমিটি অব এস্টিমেটস তাদের প্রথম রিপোর্টে (২০১৪-১৫) স্বীকার করে নিল, পানীয় জলের সঙ্গে ওঠা আর্সেনিকের মারাত্মক বিষে এ দেশে মৃতের সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়েছে।

দেবদূত ঘোষঠাকুর

শেষ আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০০
‘পরিবর্তন’-এর দুরাশায়। রাজ্যের আর্সেনিক আক্রান্তদের অবস্থান। কলকাতা, জানুয়ারি ’১১। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।

‘পরিবর্তন’-এর দুরাশায়। রাজ্যের আর্সেনিক আক্রান্তদের অবস্থান। কলকাতা, জানুয়ারি ’১১। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।

এই প্রথম মৌচাকে ঢিল পড়ল, যদিও অনেক দেরিতে। ৩২ বছর আগে পড়লে অনেক মানুষের জীবন বাঁচত! ষোড়শ লোকসভার জলসম্পদ, নদী উন্নয়ন এবং গঙ্গা পুনরুজ্জীবন মন্ত্রকের কমিটি অব এস্টিমেটস তাদের প্রথম রিপোর্টে (২০১৪-১৫) স্বীকার করে নিল, পানীয় জলের সঙ্গে ওঠা আর্সেনিকের মারাত্মক বিষে এ দেশে মৃতের সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়েছে। আরও দুই থেকে তিন লাখ মানুষ আর্সেনিক দূষণ জনিত মারাত্মক অসুখে ভুগছেন।

গত তিন দশকে আর্সেনিক দূষণ নিয়ে নানা সরকারি কমিটি ও টাস্ক ফোর্স নানা রিপোর্ট দিলেও, এ দূষণ যে ব্যাপক হারে মানুষের মৃত্যু ঘটাচ্ছে, সেটা এ যাবত্‌ যথেষ্ট গুরুত্ব পায়নি। লোকসভার ওই কমিটি সম্ভবত দেশের প্রথম কোনও সরকারি কমিটি, যারা আর্সেনিকের মারণক্ষমতা খোলাখুলি স্বীকার করে নিল।

প্রাক্তন মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী ও বিজেপি সাংসদ মুরলীমনোহর জোশীর নেতৃত্বাধীন সংসদীয় কমিটি লিখেছে, গত তিন দশকে ১২ রাজ্যের ৯৬টি জেলায় ভূগর্ভস্থ জলে এই দূষণের উপস্থিতি লক্ষ করা গিয়েছে। এবং, ‘মানুষের সঙ্গে এই দূষণের প্রভাব পড়েছে গবাদি পশু ও কৃষি পণ্যের উপরেও। দূষিত হচ্ছে মাটিও। লক্ষাধিক লোকের মৃত্যু হয়েছে, আরও দুই থেকে তিন লক্ষ লোক আর্সেনিক দূষণ সংক্রান্ত ব্যধিতে আক্রান্ত।’ কমিটির উপলব্ধি, আর্সেনিক দূষণ নিয়ন্ত্রণে এবং দূষণজনিত ব্যাধিতে আক্রান্তদের জন্য প্রায় কিছুই করা হয়নি, বরং দূষণকে কী ভাবে চাপা দিয়ে রাখা যায় তার চেষ্টা চলেছে।

ভারতে পানীয় জলে বিপজ্জনক মাত্রার আর্সেনিক দূষণ ধরা পড়েছিল চন্ডীগড়ে, ১৯৭৬ সালে। কিন্তু এই দূষণ থেকে মানুষের শরীরে কী মারাত্মক রোগ দানা বাঁধে সেটা জানা যায় ১৯৮২ সালে পশ্চিমবঙ্গে, উত্তর ২৪ পরগনা জেলায়। আর তার আট বছরের মধ্যে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল, শুধু উত্তর ২৪ পরগনা নয়, মাটির তলার ওই দূষণ ছড়িয়েছে মালদহ থেকে শুরু করে মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, দক্ষিণ ২৪ পরগনাতেও। ওই সময়েই জানা গেল, এই দূষণের ফলে চামড়ার ক্যানসার থেকে শুরু করে নানা ধরনের রোগ হচ্ছে। মৃত্যু পর্যন্ত। এর পর কলকাতা সহ পশ্চিমবঙ্গের আরও তিন জেলায় পানীয় জলে বিপজ্জনক মাত্রায় আর্সেনিকের উপস্থিতি ধরা পড়েছে, দূষণ ছড়িয়েছে বিহার, উত্তরপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, অসম সহ কয়েকটি রাজ্যে। আশির দশকে এই দূষণের ভয়াবহতা অনুধাবনের পরেও গত তিন দশকে কেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকগুলির মধ্যে সমন্বয় গড়ে ওঠেনি, প্রশ্ন তুলে কমিটি বলেছে: ‘কেন আর্সেনিক নিয়ে কোনও নীতি তৈরি হল না এত দিনেও?’

২০১২’র তৈরি ‘জাতীয় জল নীতি’তে আর্সেনিক দূষণের উল্লেখ না থাকায় কমিটি বিস্মিত। ‘ভারতে ভূগর্ভে আর্সেনিক দূষণ রোধ’ নিয়ে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হাইড্রোলজি এবং সেন্ট্রাল গ্রাউন্ডওয়াটার বোর্ড ২০১০-এ কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সুপারিশ জমা দিয়েছিল। সে ব্যাপারে কেন্দ্র কোনও ব্যবস্থা নিয়েছে, এমন কোনও তথ্য আমলাদের কাছ থেকে কমিটি পায়নি। অন্য সমস্যাও আছে। ‘দেশে আর্সেনিক দূষণের ঠিক চিত্রটা যে কী, আর কোথা থেকেই বা এই দূষণ এল, বিভিন্ন সরকারি সংস্থার দেওয়া পরস্পরবিরোধী তথ্যের জন্য তা বোঝাই যাচ্ছে না। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তথ্য অসম্পূর্ণ। জনস্বাস্থ্য, কৃষির মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ঠিক তথ্যভাণ্ডার গড়ে তোলা জরুরি।’ দীর্ঘদিন ধরে বিপজ্জনক মাত্রার আর্সেনিক মানুষের শরীরে গেলে তার প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, সেটা জানা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক ওই রোগীদের সম্পর্কে তথ্যভাণ্ডার তৈরি করেনি। রোগ কোথায় কখন কী ভাবে হানা দিচ্ছে, কী ভাবে চিকিত্‌সা হচ্ছে, কত রোগীর মৃত্যু হচ্ছে, সে ব্যাপারে কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডার তৈরির জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রকের অধীনে সেন্ট্রাল ব্যুরো অব হেল্থ ইন্টেলিজেন্স বলে একটি সংস্থা রয়েছে। তার কাছে আর্সেনিক দূষণ জনিত রোগ নিয়ে কোনও তথ্য নেই। যোজনা কমিশনের এক কমিটি আর্সেনিক মোকাবিলা ও পীড়িতদের চিকিত্‌সার জন্য দেশব্যাপী এক কর্মসূচি গ্রহণের সুপারিশ করেছিল। আজও সে কর্মসূচির রূপরেখাই তৈরি হয়নি।

আর্সেনিকের সহনমাত্রা ঠিক করা নিয়েও কমিটির কঠোর সমালোচনা আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) যখন পানীয় জলে আর্সেনিকের সহনমাত্রা লিটার-প্রতি ০.০১ মিলিমিটারে বেঁধে দিয়েছে, তখন ব্যুরো অব ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ডস কী ভাবে এ দেশে সহনমাত্রা ০.০৫ মিলিগ্রাম ঠিক করল? কমিটির সাফ কথা: ‘মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা যাবে না। অবিলম্বে পানীয় জলে আর্সেনিকের সহনমাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ মতো প্রতি লিটারে ০.০১ লিটার করা হোক।’

যাঁরা এ দেশে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে আর্সেনিক দূষণ নিয়ে কাজকর্ম করছেন, আর্সেনিক পীড়িত এলাকায় ঘুরেছেন, বিপজ্জনক মাত্রার আর্সেনিকযুক্ত জল মানুষকে নিয়মিত খেতে দেখেছেন, আর্সেনিকোসিস-এর রোগীদের বিনা চিকিত্‌সায় মরতে দেখেছেন, একের পর এক পরিবারকে একঘরে হতে দেখেছেন, তাঁদের মনের কথাটি বলেছে সংসদীয় কমিটি।

এই প্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের ছবিটা গভীর উদ্বেগ জাগায়। দেশে আর্সেনিক দূষণজনিত মৃত্যুর প্রথম নথিভুক্ত ঘটনাটি ঘটেছে পশ্চিমবঙ্গেই। কোনও এলাকায় আর্সেনিকোসিস আক্রান্ত মানুষের ঘনত্ব এ রাজ্যেই সর্বাধিক। মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া আর উত্তর ২৪ পরগনার আর্সেনিক আক্রান্ত এলাকার জীবনযাত্রা একটুও বদলায়নি। রাজ্যে প্রথম আর্সেনিকোসিসের রোগী ধরা পড়ে ১৯৮২’তে, আর্সেনিক দূষণে আক্রান্তদের সম্পর্কে, এমনকি মৃত্যুর সংখ্যা নিয়েও পুরো তথ্য আজও নেই। কোথায় কোথায় রোগীরা চিকিত্‌সা পেতে পারেন, নেই সে তথ্যও।

যাঁরা আর্সেনিক দূষণ নিয়ে কাজ করেন তাঁরা বার বার আর্সেনিকের সহনমাত্রা প্রতি লিটার জলে ০.০১ মিলিগ্রাম করার দাবি জানিয়েছেন। সে দাবি নাকচ হয়েছে বার বারই। রাজ্যের জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের হিসেবে রাজ্যের ৯টি জেলা (কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রকের রিপোর্ট অনুযায়ী কিন্তু ১২টি) আর্সেনিক-প্রবণ, তবু সহনমাত্রা লিটার-প্রতি ০.০৫ মিলিগ্রামেই বেঁধে রেখেছে রাজ্য সরকার। সরকার বদলেছে, কিন্তু বামফ্রন্টের সহনমাত্রা তৃণমূল আমলেও অপরিবর্তিত।

সহনমাত্রা বাড়িয়ে রাখলে আর্সেনিকের ভয়াবহতার চিত্রটাও অনেকটা লঘু হয়ে যায়। কারণ, যে সব নলকূপ থেকে প্রতি লিটার জলে ০.০১ থেকে ০.০৪৯ মিলিগ্রাম আর্সেনিক ওঠে সেগুলিকে হিসেবের বাইরে রাখা যায়। কত নলকূপ দূষিত জল তুলছে তার সংখ্যাও কমিয়ে রাখা যায়। যাঁরা সে জল পান করছেন, তাঁদের ধর্তব্যের বাইরে রাখা যায়।

সংসদীয় কমিটির সদস্যদের মধ্যে তিন জন পশ্চিমবঙ্গের সাংসদ। দু’জন শাসক দলের। এক জন সিপিএমের। কেউই ‘আর্সেনিক-পীড়িত’ এলাকার প্রতিনিধি নন। কমিটির সদস্য রাজ্যের শাসক দলের দুই সাংসদের কাছে বিনীত নিবেদন, আর্সেনিক নীতি নিয়ে আপনারা কেন্দ্রীয় সরকারকে তুলোধুনা করেছেন ঠিকই, কিন্তু আয়নায় এ বার নিজেদের রাজ্যের মুখটা দেখুন। রাজ্যের আর্সেনিক পীড়িত মানুষগুলি কিন্তু আপনাদের মুখের দিকেই তাকিয়ে রয়েছেন।

post editorial debdut ghoshthakur arsenic
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy