Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

৩টি ধোঁয়াশা, ৩টি আন্দাজ, ৩টি ধাঁধা

সমস্ত বেআইনি অস্ত্র যুদ্ধকালীন সক্রিয়তায় বের করে না ফেললে কোনও ‘জাতীয় তদন্ত সংস্থা’র সাধ্য আছে এই সন্ত্রাসের শিকড় উপড়ানোর? আরও অজস্র ছোট বড় বোমা-কারখানা তাজা বোমা বানিয়েই চলেছে। সেগুলো আমাদের বাড়িঘরে যে-কোনও মুহূর্তে ফাটবে।গাঁধীজির জন্মদিনে, ২ অক্টোবর, খাগড়াগড়ের এক বাড়িতে বোমা বানাতে-বানাতে বোমা যদি না ফেটে যেত, তা হলে এখনও সেই বোমার কারখানায় সেই বোমা বানানো চলতেই থাকত। খাগড়াগড়ের এই দুর্ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব নিয়েছে ‘জাতীয় তদন্ত সংস্থা’। সংস্থাটি তৈরি হয়েছিল মুম্বই-অন্তর্ঘাতের পর। এমন জাতীয় বিপদের কথা মাথায় রেখে। সে কারণেই একটি ‘জাতীয় সংস্থা’।

এলেন, দেখলেন। মুর্শিদাবাদের থানারপাড়ায় এনআইএ’র প্রতিনিধিরা। ১৫ অক্টোবর

এলেন, দেখলেন। মুর্শিদাবাদের থানারপাড়ায় এনআইএ’র প্রতিনিধিরা। ১৫ অক্টোবর

দেবেশ রায়
শেষ আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০১
Share: Save:

গাঁধীজির জন্মদিনে, ২ অক্টোবর, খাগড়াগড়ের এক বাড়িতে বোমা বানাতে-বানাতে বোমা যদি না ফেটে যেত, তা হলে এখনও সেই বোমার কারখানায় সেই বোমা বানানো চলতেই থাকত।

খাগড়াগড়ের এই দুর্ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব নিয়েছে ‘জাতীয় তদন্ত সংস্থা’। সংস্থাটি তৈরি হয়েছিল মুম্বই-অন্তর্ঘাতের পর। এমন জাতীয় বিপদের কথা মাথায় রেখে। সে কারণেই একটি ‘জাতীয় সংস্থা’। আইনশৃঙ্খলার নির্দিষ্ট সাংবিধানিক দায়িত্বের বাইরে। সম্প্রতি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল, ‘জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনী’র মহানির্দেশক জয়ন্তনারায়ণ চৌধুরী, ‘জাতীয় তদন্ত এজেন্সি’র মহানির্দেশক শরদ কুমার ও কেন্দ্রীয় সরকারের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিষয়ক বিশেষ সচিব প্রকাশ মিশ্র দিল্লি থেকে এসে হেলিকপ্টারে আধ ঘণ্টার জন্য খাগড়াগড়ে গিয়ে কলকাতায় ফিরে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সওয়া ঘণ্টার বৈঠক সেরে দিল্লি ফিরে যান।

পরিস্থিতি ও ঘটনাচক্র বিচার করলে এ কথা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার নেতৃত্বে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ওই সওয়া ঘণ্টার বৈঠকটাই ছিল এই সফরের লক্ষ্য, এবং সেই লক্ষ্যটা গোপন করার জন্যই তিনটি ধোঁয়াশা ছড়ানো হয়েছিল।

প্রথম ধোঁয়াশা: খাগড়াগড় যাওয়া। উপদেষ্টার ঘটনাস্থলে যাওয়াটা নিরর্থক। তাঁর কোনও কাজের হুকুম দেওয়ার অধিকারই নেই, তিনি শুধুই পরামর্শ দিতে পারেন। এই ধরনের পদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যই তাই। দৈনন্দিন কাজের সঙ্গে যুক্ত নন আর ঘাড়ের ওপর এসে পড়া কোনও ঘটনা নিয়ে এক্ষুনি মাথা খাটাতে হবে এমন দায়মুক্ত বিশেষজ্ঞের সাহায্য সরকারের দরকার হয়। তিনি যে-পরামর্শ দেন, তা সরকার না-ও মানতে পারেন। সুতরাং, খাগড়াগড়ে উপদেষ্টা গিয়ে কী দেখবেন বা কী জানবেন? যদি সত্যি তাঁর তেমন কিছু দেখার বা জানার থাকে, তা হলে তিনি এত সংগঠিত ও বিজ্ঞাপিত সফর না করে একা-একা এসেই ঘুরে যেতে পারতেন।

দ্বিতীয় ধোঁয়াশা: এই কথাটা রটিয়ে রাখা যে, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকটা সবচেয়ে অনিশ্চিত। তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখেছি, সব কাগজে খবরটা এমন ভাবে দেওয়া যে, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকটা পাকা হয়নি। তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক চেয়েছেন কি না সেটাও স্পষ্ট নয়। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে উপদেষ্টা কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত মুখ্যমন্ত্রীকে জানালেন। সে সিদ্ধান্ত হচ্ছে, খাগড়াগড় বিস্ফোরণ ও তৎসংক্রান্ত ঘটনা রাজ্যের ক্ষমতায় তদন্ত হওয়া সম্ভব নয় এবং এর সঙ্গে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান, সম্ভবত নেপালও যুক্ত। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকারকে অনেক তথ্য জানিয়েছেন।

তৃতীয় ধোঁয়াশা: বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ ভারতীয় রাজ্য হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সমর্থন ও সাহায্য ছাড়া এ তদন্তের রাজ্যসীমায় ভিতরের কাজটুকু করা যাবে না, তাই অফিসারদের নিয়ে একটা যুক্ত কমিটি করা হবে। কিন্তু সেই কমিটিতে পশ্চিমবঙ্গ ও কলকাতা পুলিশের কোন আধিকারিকরা থাকবেন, সেটা বাছাই করবে কেন্দ্রীয় সরকার অর্থাৎ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।

যেন, এমন একটি বোঝাপড়া এই বৈঠকের ফলেই সম্ভব হল। যেন, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক না হলে ও মুখ্যমন্ত্রীর সহযোগিতা না পেলে এমন বোঝাপড়া হতেই পারত না। আর, যেন সে বোঝাপড়া এমনই সৌহার্দ্যমাখা যে মুখ্যমন্ত্রীর আরও কেন্দ্রীয় বাহিনী চাওয়া দিল্লিওয়ালারা বন্ধুর মতোই শুনলেন ও রাজ্যের গোয়েন্দা দফতর উন্নয়নের দিল্লি প্রস্তাবও মুখ্যমন্ত্রী বন্ধুর মতোই জানলেন ও রাজ্যে ‘জাতীয় তদন্ত সংস্থা’র বাড়িঘর তৈরির কথাও উঠল। এ সবই কাগজের খবর। আমাদের মতো যারা কাগজ পড়েই খবর জানি, তারা তো এই সব খবর থেকেই খবরের পেছনের খবর আন্দাজ করতে চাই।

তেমন একটি আন্দাজ সব ধোঁয়া সরিয়ে বেরিয়ে এসেছে। কোনও অবস্থাতেই এই বোঝাপড়া এই সওয়া ঘণ্টার বৈঠকের ফল নয়। নিশ্চয়ই এই বোঝাপড়া খাগড়াগড়ের তিরিশ মিনিটে উপদেষ্টার মগজে খেলেনি। এটা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সুচিন্তিত প্রস্তাব, আগেই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে এসেছে ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁদের সম্মতি জানিয়েছেন।

দ্বিতীয় আন্দাজ, এই সব ধোঁয়া সরিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এটাকে প্রস্তাব হিসেবে দেননি, দিয়েছেন চরম প্রস্তাব হিসেবে। রাজ্য সরকার মানে মুখ্যমন্ত্রী যদি এই প্রস্তাবে সম্মত না হতেন, তা হলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক আরও কঠিন ব্যবস্থা নিতেন। সেই ব্যবস্থা এড়ানোর জন্য মুখ্যমন্ত্রীর এই প্রস্তাবে রাজি হওয়া ছাড়া কোনও উপায় ছিল না।

তৃতীয় আন্দাজ, এই প্রস্তাব দেওয়ার জন্যই উপদেষ্টার নেতৃত্বে এই সফর। একমাত্র উপদেষ্টাই মন্ত্রী না-হয়েও মন্ত্রীর মর্যাদাসম্পন্ন ও মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সরকারি বৈঠকের অধিকারী। এর বিকল্প ছিল, কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রীকে দিল্লিতে ডেকে পাঠিয়ে কথাগুলি বলতে পারতেন। তাতে সম্মুখযুদ্ধের যে-পরিসর তৈরি হত, তা এই মুহূর্তে কেন্দ্রীয় সরকার চাইছে না। এ সবই আন্দাজ।

তিন ধোঁয়াশা ও তিন আন্দাজ থেকে কিছু ধাঁধাও তৈরি হচ্ছে।

প্রথম ধাঁধা: দেশের একমাত্র নিরাপত্তা উপদেষ্টা নাকি খাগড়াগড় বিস্ফোরণের বাড়িটির আনাচকানাচ দেখার মিনিট তিরিশের মধ্যেই জিজ্ঞেস করেছিলেন, বোমা যারা বানাত, তাদের দু’টি বাচ্চাকে কি কোনও সময় বোমা বানানোর কারখানা-ঘরে যেতে দেওয়া হত? তাঁর প্রশ্নটিই খবরে পড়েছি, প্রশ্নটি কাকে করেছেন, সে কথা খবরে নেই, তিনি কী জবাব পেয়েছেন তা-ও খবরে নেই। বোমাওয়ালাদের বাড়ির ভিতরের চলাফেরার রোজকার খবর দেওয়ার মতো কেউ কি নিরাপত্তা-উপদেষ্টার আশপাশে ছিলেন, না থাকা সম্ভব? তাঁকে কম্যান্ডোরা যেমন ঘিরে রেখেছিলেন ও ওই বাড়ির চার দিকের সব বাড়ির ছাদে কম্যান্ডোরা যেমন বন্দুক তাক করে ছিলেন, তাতে এটা একমাত্র তাঁর স্বগতোক্তিই হতে পারে। এবং এমন প্রশ্নের দুটো উদ্দেশ্য থাকতে পারে। এক, তিনি বুঝতে চাইছিলেন, বোমাওয়ালারা কতটাই নিরাপদ ভাবতেন নিজেদের। দুই, তাঁরা কতটাই পাড়ার লোক হয়ে গিয়েছিলেন।

ধাঁধাটা ঠিক এইখানেই। খাগড়াগড় কি গ্রাম না শহর? খবর পড়ে মনে হয়েছে গ্রাম। যদি গ্রামই হয়, তা হলে গ্রামের লোকের অজ্ঞাতে গ্রামের কোনও বাড়ির হাঁস বা মুরগি ডিমও পাড়ে না। গ্রামের সঙ্গে যাঁদের সামান্য সম্পর্ক আছে, তাঁরাও জানেন, গ্রামে একটা বাড়িতে বোমার কারখানা চলছে, এটা গ্রামের লোকের অজানা থাকা অসম্ভবের চাইতেও অসম্ভব।

এক বার ধাঁধা লেগে গেলে ধাঁধা লাগতেই থাকবে। দুই নম্বর ধাঁধাটা হল: তা হলে কি বোমা-বন্দুক, আরও নানারকম অস্ত্র তৈরি হওয়াটা গ্রামে এখন প্রায় কুটির শিল্পের পর্যায়ে গেছে? গ্রামের গৃহস্থ মানুষের কিছুটা নিজস্ব প্রতিরোধ রাখতেই হয় চুরি-ডাকাতি ঠেকাতে। বর্শা, লাঠি, ছোরা, পাইপ, লোহার ডান্ডা, এগুলো বরাবরের ঘরোয়া অস্ত্র। সেখানে কালক্রমে পাইপগান গোছের আগ্নেয়াস্ত্রও এসে গিয়েছিল। খুব আওয়াজ হয় বা ধোঁয়া হয় এমন পটকাও ব্যবহৃত হত। এখন হয়তো সত্যিকারের বোমা ব্যবহৃত হচ্ছে।

ধাঁধা লেগে গেলে ছাড়ানো মুশকিল। এই দুই নম্বর ধাঁধার সুতো ধরেই তিন নম্বর ধাঁধাটা লেগে গেল। যে দিন দেশের সবচেয়ে উঁচু নিরাপত্তা-কর্তারা কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে দিল্লি-কলকাতা-খাগড়াগড়-বর্ধমান-কলকাতা-দিল্লি করতে আসছেন ও কাগজে-টিভিতে তাঁদের আসার আগাম খবর রাজ্যের আনাচেকানাচে পৌঁছে গেছে, সেই দিনই বীরভূমের পাড়ুই থানার মাখড়া গ্রামে তৃণমূল-বিজেপি সশস্ত্র সংঘর্ষে তিন জন মারা গেলেন ও জেলার অতিরিক্ত সুপারিনটেন্ডেন্ট অব পুলিশের মতো বড় অফিসার তিরিশ জন সেপাই নিয়ে ধানখেতে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হলেন। তেমন বাধ্যতার কারণ ছিল। চার দিন আগেই ওই থানারই চৌমণ্ডলপুরে গোপন অস্ত্র তল্লাশি করতে গিয়ে পাড়ুই থানার ওসি আহত হয়েছেন। খাগড়াগড় সফর ও মাখড়ার ঘটনার মাত্র দু’দিন আগে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ভাঙড়ে দিনদুপুরে দল পাকিয়ে গুলি করে দু’জনকে মেরে ফেলা হল যাঁর প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য নেতৃত্বে, তিনিই রাতে বসে থানায় এফআইআর-এ কার কার নাম থাকতে হবে তা ডিকটেশন দিলেন।

কে দায়ী, কে দায়ী নয়, এ সব নিয়ে আজকাল কোনও ধাঁধা হয় না। সবাই সব জানে। ধাঁধাটা এইখানে যে, দেশের উচ্চতম নিরাপত্তা-কর্তারা বললেন, পশ্চিম বাংলা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের ওপর বসে আছে। সেই আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস কি চৌমণ্ডলপুর-মাখড়া-ভাঙড়ের রাজ্য-সন্ত্রাস থেকে বিচ্ছিন্ন? খাগড়াগড়ের মতো অজস্র বোমা-কারখানাই কি রাজ্যের ও বাংলাদেশের সন্ত্রাসকে ঘরে-বাইরে অস্ত্র সরবরাহ করছে না? সমস্ত বেআইনি অস্ত্র যুদ্ধকালীন সক্রিয়তায় বের করে না ফেললে কোনও ‘জাতীয় তদন্ত সংস্থা’র সাধ্য আছে এই সন্ত্রাসের শিকড় উপড়ানোর? উপড়ানো তো দূরের কথা, শিকড় খোঁজারও সাধ্যি নেই। খাগড়াগড়ের মতো আরও অজস্র ছোট-বড় বোমা-কারখানা তাজা বোমা বানিয়েই চলেছে। বোমা ফেটে গিয়ে তাদের ঠিকানা এখনও কাগজে-টিভিতে আসেনি। সেগুলো ফাটা বোমা নয় যে দামোদরের চরে ফাটানো যাবে, সেগুলো আমাদের বাড়িঘরে যে-কোনও মুহূর্তে ফাটবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

debesh roy khagraghah
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE