মনোবিদ এবং দার্শনিকদের সংজ্ঞা অনুযায়ী, শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হল শিশুর সার্বিক বিকাশ ঘটানো। তা কেবলমাত্র পুঁথিগত বিদ্যা দিয়ে সম্ভব নয়, তার জন্য শরীরচর্চা যেমন দরকার, তেমনই প্রয়োজন সামাজিক এবং মানসিক বিকাশের। মনে রাখা দরকার যে, শুধুমাত্র অঙ্কের ফর্মুলা, কিংবা নিউটনের তিনটি সূত্র শিখলেই পণ্ডিত হওয়া যায় না। পুঁথিগত জ্ঞানার্জনের বাইরেও দৈনন্দিন জীবনের দিনগত সমস্যা সমাধানের উপায় বার করে ‘জীবন’ নামক যাত্রাপথে নিজেকে সাফল্যের সঙ্গে চালিত করতে পারাটাই সাফল্য।
তবে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের জন্য একটা নির্দিষ্ট শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকাটা অন্যতম এবং অপরিহার্য শর্ত। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শিক্ষার্থীর জীবনে একটা ‘ট্রানজিট পিরিয়ড’। উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ভর্তির পরেই নিজের লক্ষ্য স্থির রেখে পড়াশোনা করা প্রয়োজন। প্রত্যেক বাবা-মা এবং অভিভাবকবৃন্দের মনে রাখা প্রয়োজন শিক্ষার্থীর মেধা, চাহিদা এবং পছন্দের কথা মাথায় রেখেই উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের বিভিন্ন পাঠ্য বিষয় নির্বাচন করা উচিত। প্রত্যেক শিক্ষার্থীই যেন নিজ নিজ চাহিদা, মেধা এবং প্রত্যাশা অনুযায়ী নিজের জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করে এবং সে ভাবেই তার লক্ষ্যপূরণের পথে নিজেকে চালিত করে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই ভবিষ্যতের পথ সব সময় মসৃণ হয় না, আবার সময়ও সব সময় অনুকূল হয় না। জীবনের চলার পথে অনেক বাধাবিঘ্ন আসে, দুঃসময় আসে। আবার অনেক সময় না চাইতেও কিছু অনাকাঙ্ক্ষি ঘটনা ঘটে যায়। সেই সব বাধা বিপত্তি কাটিয়ে নিজের লক্ষ্যে অটল থাকতে পারলেই জীবনে সাফল্য আসবে।
আরও পড়ুন:
শিক্ষা প্রসঙ্গে নেতাজির একটা বিশেষ উক্তি আমাদের ভীষণ ভাবে গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত। তিনি বলেছিলেন, ‘‘লোকের ভুল ধারণা ভাঙতে হবে। শুধু বিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্র হলেই পুরুষার্থ লাভ হয়, অন্য বিষয়ে প্রশংসা লাভের মূল্য নেই—এই ছিল এতদিনকার ধারণা। কিন্তু কার্যত দেখা যাচ্ছে, জীবনসংগ্রামে মানুষ জয়লাভ করে, শুধু বিদ্যালয়ে প্রথম স্থান অধিকার করে নয়, সবদিক থেকে মানুষ হয়ে। তাই শুধু লেখাপড়ায় প্রথম না হয়ে, জীবনক্ষেত্রে প্রথম হওয়ার শিক্ষা আমাদের লাভ করতে হবে।’’ বাস্তবে, আমাদের মধ্যে বোধ হয় হাতেগোনা গুটিকতক নেতাজির এই উক্তিকে পাথেয় করেছি। আজকের দিনেও বেশির ভাগ বাবা মায়ের কাছে সন্তানের ভাল রেজাল্ট এবং ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারিং-বিজনেস ম্যানেজমেন্ট এর মত পেশাগত কোর্স ছাড়া অন্য কোনও সাধারণ কোর্সের খুব বেশি গুরুত্ব তেমন নেই। আসলে আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল, পড়াশোনাকে মানুষ হওয়ার মাধ্যম না ভেবে সবসময় চাকরি পাওয়ার মাধ্যম ভাবি। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ‘সার্বিক বিকাশ’, যা কেবলমাত্র পুঁথিগত বিদ্যা দিয়ে সম্ভব নয়। পাশাপাশি এটাও স্মরণ করাতে চাই যে, মোটা মাইনের চাকরি পাওয়াতেই কিন্তু শিক্ষালাভের সাফল্য নয়। পার্থিব এবং মানসিক সুখ অর্জনের মধ্যে সামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থান বজায় রেখে মানুষ হয়ে ওঠাতেই শিক্ষার আসল সাফল্য।
সুতরাং বাবা-মা থেকে শুরু করে শিক্ষকসমাজ সকলেরই এই বাস্তব উপলব্ধির অত্যন্ত প্রয়োজন যে, পুঁথিগত শিক্ষা কখনওই শিক্ষা সম্পূর্ণ করে না। প্রতিটি শিশুর মনে সমগ্র জগৎ এবং জীবন ছাড়াও জীবনের মূল্যবোধ সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র আঁকতে সাহায্য করাটাই প্রকৃত শিক্ষা।
সকল উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলছি, পরীক্ষায় ভাল ফল করাটাই কিন্তু সাফল্য নয়, পাশাপাশি মানুষ হিসাবে কর্তব্যপরায়ণ, সৎ এবং চরিত্রবান হওয়াটাও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। আমি প্রত্যাশা রাখি যে, ছাত্রজীবনের গুরুত্বপূর্ণ এই পরীক্ষায় ভাল ফল করার পাশাপাশি জীবন নামক যুদ্ধেও তোমরা সবাই জয়ী হয়ে ওঠো। তোমাদের সবার জন্য উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের পক্ষ থেকে আন্তরিক শুভেচ্ছা রইল।
(লেখক উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতি)