Advertisement
E-Paper

ঠাকুমা-দিদিমার গল্প না কি পডকাস্ট, অ্যানিমেশন! ছোটদের জন্য কোনটা ভাল, কী বললেন ‘গল্পদিদা’ সুদেষ্ণা?

বর্তমান সময়ের নিরিখে ছোটদের পড়াশোনা কেমন হওয়া প্রয়োজন, তাদের বড় হওয়ার সহজপাঠে কোন বিষয় গুলি নজর না দিলেই নয়— সব মিলিয়ে নিজের মতামত প্রকাশ করলেন গোখলে মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষিকা সুদেষ্ণা মৈত্র।

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৮:৫৭
শিশুদের গল্প শোনাতে মত্ত ‘গল্প দিদা’।

শিশুদের গল্প শোনাতে মত্ত ‘গল্প দিদা’। নিজস্ব চিত্র।

কখনও তিনি ‘গল্প দিদা’, কখনও ‘বানান ঠাকুমা’। ছোটদের নিয়েই কাটে তাঁর সারাদিন। ঝুলিতে থাকে রূপকথা, পুরাণ, ভূতের গল্পের মতো আরও কত কী!

প্রযুক্তি নির্ভরতার যুগে ছোটদের পড়াশোনা কেমন হওয়া প্রয়োজন, বেড়ে ওঠার সহজপাঠে কোন বিষয়গুলি নজর না দিলেই নয়—সে সব মিলিয়ে নিজের কথা জানালেন গোখলে মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলের বাংলার প্রাক্তন শিক্ষিকা সুদেষ্ণা মৈত্র।

প্রশ্ন: ছোটবেলার দিদিমা, ঠাকুমার কাছে গল্প শুনে বড় হওয়া, আজকাল অবশ্য বাচ্চারা গল্প শোনে দৃশ্য-শ্রাব্য মাধ্যমে। এই পরিবর্তন দেখেছেন আপনিও। কী ভাবছেন এ বিষয়ে?

সুদেষ্ণা: গল্প যে মাধ্যমেই শুনুক, কী গল্প শুনছে সেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কী ধরনের ছবি দেখছে, সেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ছোটরা মোবাইলে ভিডিয়ো চালিয়ে গল্প শুনছে আজকাল। শুনুক। কিন্তু তারই পাশাপাশি ওরা যাতে বয়স অনুযায়ী গল্পের বই পড়তে পারে, সে দিকে নজর দিতে হবে। পড়তে হবে উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার রায়। সত্যজিৎ রায়, চার্লি চ্যাপলিনের ছোটদের সিনেমা দেখার অভ্যাস করলে বোধ এবং কল্পনা তৈরি হবে ধীরে ধীরে। ওরা ভাবতে শিখবে।

প্রশ্ন: নতুন প্রজন্মের সংস্কৃতি থেকে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে বাংলা, বিশেষত শহরের শিশুদের পড়াশোনা ইংরেজিমুখী। বাংলা গল্পের কী হবে এর পর?

সুদেষ্ণা: আসলে অভিভাবকদের মধ্যেই একটা ধারণা তৈরি হয়ে গিয়েছে, ইংরেজিমাধ্যমে পড়লে একটা চাকরি পাওয়া যাবেই। কিন্তু বাংলা পড়েও কি ভাল চাকরি পাওয়া যায় না? আবার ইংরেজি বা বাংলামাধ্যমটা বিষয় নয়। স্কুলগুলিরও উচিত, ছোটদের সাহিত্যকে তুলে ধরা। ছোট বয়সে যদি মাতৃভাষা রপ্ত করা না যায়, তা হলে কোনও ভাষার প্রতিই দখল তৈরি হয় না। তাই মাতৃভাষার উপর জোর দিতেই হবে। বই প্রকাশনীর সংস্থাগুলি যদি ছোট ছোট গল্প নিয়ে সাপ্তাহিক বই প্রকাশ করে, তা হলে ওদের ভাষার প্রতি সাধারণ ভাবেই দখল তৈরি হবে।

প্রশ্ন: ভাষার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি জড়িয়ে থাকে বানান। খুব ছোট থেকেই বাংলা বানান-এর উপর জোর দিতে কোন বিষয়গুলি নজর দেওয়া প্রয়োজন?

সুদেষ্ণা:কোনও শিশু যখন ছোট্ট ছোট্ট কোনও বানান শিখছে তখন যদি তাদের লেখার পাশাপাশি ছবি আঁকতে দেওয়া হয়, তা হলে ভাল হয়। যেমন ধরা যাক ‘একটা গাড়ি চলছে’ এই লেখাটার সঙ্গে যদি ওরা গাড়ির ছবি আঁকে এবং পাশে লিখে দেয়, তা হলে মনের মধ্যেই গেঁথে যাবে শব্দটি। আবার, বাংলা বর্ণমালায় স, শ, ষ, র, ড়, ন, ণ, জ, য, ইত্যাদির সঙ্গে ই-কার ঈ-কারের লড়াই, উ-কার ঊ-কার এর তফাত বোঝা— খুবই জটিল। তাই শুরুটা একটু অন্য ভাবে করা যেতে পারে। প্রথমেই ছোটোদের কাছে ভাষার আগ্রহ তৈরি করতে হবে। সে জন্য ছোটোদের বাংলা গান, কবিতা , ছড়া, গল্প শোনানো প্রয়োজন।

সুদেষ্ণা মৈত্র।

সুদেষ্ণা মৈত্র। নিজস্ব চিত্র।

প্রশ্ন: স্কুলে পড়া একটি শিশুর একাধিক বিষয়ের একাধিক গৃহশিক্ষকআদৌ কি তার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে?

সুদেষ্ণা: এটা নির্ভর করছে ওই শিশুর বয়স, গ্রহণ ক্ষমতা এবং প্রয়োজনীয়তার উপর। যদি কোনও পড়ুয়া ওই পদ্ধতিতে পড়াশোনায় অভ্যস্ত হয় তা হলে অসুবিধার কিছু নেই। তবে আমার মনে হয়, স্কুলেই যদি পাঠ্যপুস্তক খুঁটিয়ে পড়ানো হয়, তা হলে আর আলাদা আলদা প্রশিক্ষকের প্রয়োজন হবে না। স্কুলের শিক্ষকদের এই ক্ষেত্রে একটু বেশিই দায়িত্ব থাকে।

প্রশ্ন: আজকের প্রজন্ম অনেক বেশি প্রযুক্তি নির্ভর, পাঠ্যবই না কম্পিউটারের স্ক্রিনকোন দিকটা বেশি নজর দিতে হবে?

সুদেষ্ণা: প্রযুক্তির কল্যাণে এখন বাচ্চারা অ্যাপের সাহায্যে পড়াশোনা করছে, আমি মনে করি, এতে কল্পনা শক্তি ক্রমশ কমছে। পলাশির যুদ্ধ, একটি ভিডিয়ো দেখে ইতিহাস জানার চেয়ে গল্পের মতো শুনে নিলে তা মনে গেঁথে যায়। সে ইতিহাস আর ভোলা যায় না। আগামী দিনে হয়তো কৃত্রিম মেধা অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। কিন্তু আমার মনে হয় সহজ-সরল পাঠ্যপুস্তকই পড়াশোনার জন্য শ্রেয়।

প্রশ্ন: আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে আর্থিক সুবিধাযুক্ত এবং সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মধ্যে ফারাক বাড়ছে, এর ফল কতটা মারাত্মক হতে পারে বলে মনে করেন?

সুদেষ্ণা: ফারাক তো সৃষ্টি করি আমরা, বড়রা! শিশুরা তো আর্থিক স্বচ্ছলতার বিষয়টি বোঝে না। তবে প্রযুক্তি নির্ভর পড়াশোনার ফলে আর্থিক ভাবে পিছিয়ে প়ড়া শিশুদের খানিকটা সমস্যা হবে। সে ক্ষেত্রে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। স্কুলের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে বলে আমি মনে করি। ‘টিচিং-লার্নিং মেটিরিয়ালস’ ব্যবহার করে গল্পের মতো করে পড়ানোর উপর নজর দেওয়া।

প্রশ্ন: দুদশক আগের একটি শিশু সঙ্গে বর্তমান একটি শিশুর অনেকখানি পার্থক্য। এ নিয়ে অনেকেই হা-হুতাশ করেন। সত্যিই কি আগের সব কিছু ভাল ছিল?

সুদেষ্ণা: না, আমার মনে হয় পরিবর্তনটাও ভাল। এখন অনেক কিছুই বদলাচ্ছে, বর্তমানে শিশুরা খুব বুদ্ধিসম্পন্ন। যুগের সঙ্গে তাল না মেলালে পিছিয়ে পড়বে। অতীতেও ভাল ছিল, এখনও ভাল হচ্ছে। আমাদের চিন্তাভাবনাও একটু উন্মুক্ত হওয়া দরকার।

প্রশ্ন: আপনি শিক্ষকতার পেশায় কী ভাবে এলেন?

সুদেষ্ণা: আমি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক। স্নাতকোত্তর পড়েছি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তারপর বিএড করি। প্রথমে একেবারে ছোটদের পড়াতাম— ‘কিন্ডার গার্টেন’-এ। তারপর অনেক জায়গায় চাকরি করে অবসর নিই গোখলে মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল থেকে।

প্রশ্ন: আপানি ছোটদের কাছে গল্প দিদাএবং বানান ঠাকুমাহলেন কী ভাবে?

সুদেষ্ণা: স্কুলের অবসরের পর আমার ছোটদের নিয়ে কাজ করার খুব ইচ্ছে ছিল। আমি নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে বাচ্চাদের গল্প শোনাতে শুরু করি, মজার ছলে বাংলা বানান শেখাতে শুরু করি। মছলন্দপুরের একটি জায়গায় আমার আসর বসে গল্প ও বানানের, সেখানেই একটি মেয়ে রয়েছে লক্ষ্মী নামে। সেই প্রথম আমায় ‘বানান ঠাকুমা’র বলে ডাকে, ভারী মনে লেগেছিল। ছোটদের জন্যই আমি। আর ওরাই আমায় বানিয়েছে ওদের ‘গল্প দিদা’।

Podcast
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy