Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

নবদ্বীপে ষষ্ঠীতে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য জামাই-রাজা

বছরের আর পাঁচটা দিন তিনি ধামেশ্বর মহাপ্রভু, ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য। কেবল জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী, অর্থাৎ জামাইষষ্ঠীর দিনে তিনি মহাপ্রভু মন্দিরের সেবাইতদের কাছে জামাতা। ঘরের মেয়ে বিষ্ণুপ্রিয়ার পতি। বিষ্ণুপ্রিয়ার ভাইয়ের উত্তরপুরুষরা ওই মন্দিরের সেবাইত। তাই ভোর থেকে রাত, নিত্যসেবার প্রতি পদে বুঝিয়ে দেওয়া হয়, এ দিন গৃহত্যাগী শ্রীচৈতন্যদেব গোস্বামীদের ‘জামাইরাজা।’ পুজোর মধ্যেই থাকে জামাই-আদর।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ২২ মে ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

বছরের আর পাঁচটা দিন তিনি ধামেশ্বর মহাপ্রভু, ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য। কেবল জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী, অর্থাৎ জামাইষষ্ঠীর দিনে তিনি মহাপ্রভু মন্দিরের সেবাইতদের কাছে জামাতা। ঘরের মেয়ে বিষ্ণুপ্রিয়ার পতি। বিষ্ণুপ্রিয়ার ভাইয়ের উত্তরপুরুষরা ওই মন্দিরের সেবাইত। তাই ভোর থেকে রাত, নিত্যসেবার প্রতি পদে বুঝিয়ে দেওয়া হয়, এ দিন গৃহত্যাগী শ্রীচৈতন্যদেব গোস্বামীদের ‘জামাইরাজা।’ পুজোর মধ্যেই থাকে জামাই-আদর।

নবদ্বীপের মহাপ্রভু মন্দিরে কয়েকশো বছর ধরে চলে আসছে এই রীতি। বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর ভাইয়ের উত্তরপুরুষ, তথা মহাপ্রভুর সেবাইত গোস্বামী পরিবারের প্রবীণ সদস্য লক্ষ্মীনারায়ণ গোস্বামী বলেন, “যতটুকু জানি, ষষ্ঠীদাস গোস্বামীর আমল থেকে জামাইষষ্ঠী পালন শুরু হয়েছিল মহাপ্রভু মন্দিরে। ষষ্ঠীদাস ছিলেন বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর ভাই মাধবাচার্যের অধস্তন তৃতীয় পুরুষ। অর্থাৎ প্রায় ৩৫০ বছর ধরে চলে আসছে এই প্রথা।” আর কোথাও মহাপ্রভুকে এ ভাবে সেবা করা হয় না, দাবি করেন তিনি।

কী ভাবে উদযাপন হয় মহাপ্রভুর জামাইষষ্ঠী? বিষ্ণুপ্রিয়া সমিতির সম্পাদক জয়ন্ত গোস্বামী জানান, ভোর সাড়ে পাঁচটায় মঙ্গলারতি কীর্তনে আর পাঁচদিনের মতোই গাওয়া হয়, ‘‘উঠো উঠো গোরাচাঁদ নিশি পোহাইলো, নদিয়ার লোক সবে জাগিয়া উঠিল...’’। কিন্তু এরপর দিনভর সবই অন্য রকম। শুরু ভোগের পাত্র এবং পদ থেকেই। রুপোর রেকাবিতে মরসুমি ফল, রুপোর বাটিতে ক্ষীর, রুপোর গ্লাসে জল। একটু বেলা গড়াতেই বাল্যভোগ। প্রবীণ মহিলারা মহাপ্রভুকে ষষ্ঠীর ‘বাটা’ দেন। আম, দূর্বা,বাঁশের পাতা, লাল সুতো দিয়ে হাতপাখায় বেঁধে ‘ষাটের’ বাতাস করেন আর ছড়া কাটেন – “জ্যৈষ্ঠ মাসে জামাইষষ্ঠী ষাট ষাট ষাট/ ভাদ্র মাসে চাপড়াষষ্ঠি ষাট ষাট ষাট...।’’ বারোমাসের সব ষষ্ঠীর নাম গাওয়া শেষ হলে ভোগ দেওয়া হয় ফলার। চিড়ে, মুড়কি, দই, আম, কাঠাল এবং নানা মিষ্টি।

অন্য সময়ে মহাপ্রভু।

মহাপ্রভুকে নতুন ধুতি-পাঞ্জাবিতে সাজানো হয় ‘জামাই রাজা’ বেশে। পরানো হয় রজনীগন্ধা, গোলাপের মালা। গায়ে ঢেলে দেওয়া হয় আতর। প্রবীণ লক্ষ্মীনারায়ণ গোস্বামী জানান, যখন দোকানের মিষ্টি সহজে মিলত না, তখন সেবাইত পরিবারের মহিলারা মহাপ্রভুর জন্য এ দিন বিশেষ ছাঁচের মিষ্টি তৈরি করতেন। নারকেল কোরার সঙ্গে ক্ষীর, এলাচ, কাজু, কিসমিস মিশিয়ে গুড়ের পাক করতেন। সেই পাক কাঠের ছাঁচে ফেলে ফুল, নকশা, পাখি, ছোট মন্দির আকারের মিষ্টি গড়তেন।

এরপর মধ্যাহ্ন ভোগ। মহাপ্রভুর জামাইষষ্ঠী বলে কথা। মেনুতে কী থাকে, তা বলার থেকে কী থাকে না বলা সহজ। প্রতিদিনের ভোগে কচু শাক, মোচা, শুক্ত থাকেই। এ দিন তার সঙ্গে থাকে নানা তরকারি, ডাল, ভাজা, থোড়, বেগুনপাতুরি, ছানার রসা (ডালনা), ধোকার ডালনা, লাউ, চালকুমড়ো থাকবেই। পোস্ত দিয়ে যত রকমের পদ সম্ভব সবই থাকে। জয়ন্তবাবু জানান, সময়ের প্রভাব ভোগের পদেও পড়েছে। ‘পনির পসন্দ’-এর মতো আধুনিক পদও ঠাঁই পেয়েছে পুজোর মেনুতে। তবে এ দিনের একটি বিশেষ পদ হল আমক্ষীর। আমের রস ক্ষীরের সঙ্গে মিশিয়ে জ্বাল দিয়ে প্রস্তুত করা হয় ওই বিশেষ পদটি। দেওয়া হয় নানা মশলা, কর্পূর দিয়ে সাজা সুগন্ধি পান।

বিকেল পাঁচটায় উত্থান ভোগ। রুপোর রেকাবিতে ছানা, মিষ্টি দেওয়া হয়। সন্ধ্যায় নাটমন্দিরে বিশেষ পাঠ কীর্তন, আলোকসজ্জার আয়োজন। রাত ৯টায় শয়ন ভোগ। ঘিয়ের লুচি, মালপোয়া আর রাবড়ি। সঙ্গে আবার খিলি করে সাজা সুগন্ধি পান। মহাপ্রভুকে নিজের সন্তানতুল্য মনে করে ‘বাটা’ বা ‘ষাটের’ বাতাস দিতে এদিন প্রচুর স্থানীয় মহিলা ভিড় করেন মহাপ্রভু মন্দিরে।

আরাধ্য দেবতাকে পিতা, মাতা, সন্তান বলে পুজোর রীতি এ দেশে চিরকালের। তবে জামাই বলে দেবতাকে আপন করে নেওয়ার রীতি রয়েছে নবদ্বীপেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE