Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Sushant Singh Rajput

‘প্রায়ই ভাবতাম, ১৪ তলা থেকে ঝাঁপ দিলে কেমন হয়’

‘শুধু বলিউড নয়, টলিউডের বহু নবাগত বা ‘আউট সাইডার’দেরও কী ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় জানা দরকার।’

ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত।

ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত।

ভাস্বর চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৯ জুন ২০২০ ১৪:০৫
Share: Save:

সুশান্ত সিংহ রাজপুত প্রচুর কথার জন্ম দিলেন। প্রচুর মত, প্রচুর অভিজ্ঞতা। সঙ্গে প্রচুর মানুষের ভাল লাগা মন্দ লাগার আখ্যান। যা অনেকেই অনেক বার প্রকাশ্যে আনতে চেয়েও আনতে পারেননি। এ সব কথা কি সবার সামনে খুলে ধরার মতো? ঘর ভর্তি লোকের সামনে নিজের দুঃখের ঝুলি উপুড় করতেই বা কার ভাল লাগে? বিশেষ করে আমাদের মতো গ্ল্যাম ওয়ার্ল্ডের বাসিন্দা যাঁরা!

তাই, সময় আসুক, তখন না হয়...

এমনটাই মনোভাব ছিল বেশির ভাগের। এবং আমারও। সুশান্ত সিংহ রাজপুত এখানে অনুঘটকের কাজ করেছেন। নিজের কথা বলার আগে কোথা থেকে, কী ভাবে শুরু করব, আদৌ বলব কি না কিছু, এই নিয়ে দ্বিধা ছিলই। যাঁরা আমার সোশ্যাল হ্যান্ডল বিশেষ করে ফেসবুক ফলো করেন তাঁদের বহু জন প্রশ্ন তুলেছিলেন আমার একটি পোস্ট নিয়ে, টিভি অ্যাক্টরস-ফিল্ম অ্যাক্টরস এই বিভাজন নিয়ে মুখ খোলার অপেক্ষা। খুলব?

সে দিন থেকেই তাগিদ অনুভব করেছিলাম, শুধু বলিউড নয়, টলিউডের বহু নবাগত বা ‘আউট সাইডার’দেরও কী ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় জানা দরকার।

প্রথমেই বলি, গত ২২ বছর ধরে যে ভাবে টলিউড ইন্ডাস্ট্রির অংশ হয়ে রয়েছি, আমার কেরিয়ার যে ভাবে এগিয়েছে বা এগোচ্ছে তাতে আমি খুশি। ইন্ডাস্ট্রির প্রচুর মানুষের থেকে না চাইতেই অনেক সাহায্য পেয়েছি। এমন অনেক শুভানুধ্যায়ী আছেন, যাঁরা ডেকে যেমন কাজ দিয়েছেন তেমনি হাতে ধরে শিখিয়েওছেন অনেক কিছু। আবার ভাল করলে প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন। তাঁরাই আমার চলার শক্তি।

ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত।

আরও পড়ুন: সুশান্ত মৃত্যু-রহস্য কিনারায় অবশেষে মহারাষ্ট্র প্রশাসনের নিশানায় যশরাজ ফিল্মস​

কিন্তু এই ২২ বছরে অনেক কিছু দেখলাম, ফেস করলাম।

রবি ওঝা প্রোডাকশনের একটি সিরিয়ালে আমি কাজ করতাম, অন্যতম ইম্পর্ট্যান্ট একটি রোলে। রবিদা নিজে ফোন করে আমায় কাজ দিয়েছিলেন। আমি কাজ শিখতে চিরকাল আগ্রহী তাই মন দিয়ে কাজ করতাম। খুব ভাল লাগছে, গোটা ইউনিট আমায় আপন করে নিয়েছিল। আর সেই ধারাবাহিক আমায় শহরের অভিজাত শ্রেণির অন্দরমহলে খুব সহজে পৌঁছে দিয়েছিল।

তার পর এক দিন সেটে গিয়ে দেখলাম, এক জন অভিনেতা সে দিন থেকে তিনি আমাদের ট্র্যাক পরিচালনা করবেন। বয়স এবং কাজের অভিজ্ঞতায় তিনি সিনিয়র। তাই যতটা সম্ভব সম্মান করা যায় সেটা করেই চলতাম। যা বলতেন তাই-ই শুনতাম, কোনও দিন বলিনি এটা পারব না, করব না।

কিন্তু আস্তে আস্তে দেখলাম, আমার প্রতি ওঁর আচরণ বদলাচ্ছে। কিছু জানতে চাইলে উত্তর দিতেন না। সবার সামনেই উপেক্ষা করা, সিন ক্যামেরাবন্দির আগে আমায় নিয়ে মুচকি হাসা ইত্যাদি ইত্যাদি। এক দিন শুনলাম উনি বলছেন, “এ তো কিছুই পারে না। সব দেখিয়ে দিতে হয়।”

আজ তাঁকে বলি, হতেই পারে তুমি অভিনেতা-পরিচালক! দরকার হলে দেখিয়ে দেবে। আর আমার তখন ইন্ডাস্ট্রিতে মাত্র ৫ বছর হয়েছে। তাই সব জেনে যাব এমন ভাবাটাও অন্যায়।

এ ভাবেই অত্যাচার বাড়তে লাগল। যে কাজটা করতে মুখিয়ে থাকতাম সেখানে ডেট পড়লেই রাতের ঘুম উড়ে যেত। এ সব কথা বাড়িতে বলা যায় না, তাই বলিনি। ও দিকে সেটে কস্টিউম করতেন যিনি তিনিও এক দিন আমায় বললেন, অভিনয়টা ওই দাদার মতো করতে হবে, না হলে কিছুই হবে না।

আমি অবাক! ভাবলাম, আমার এখানে যে অ্যাক্টিং প্যাটার্ন সেটা তো রবি ওঝা নিজেই মান্যতা দিয়েছেন। এবং অনেক বার প্রশংসাও করেছেন অভিনয়ের। তা হলে আমার ভুলটা কোথায় হচ্ছে?

এর পরেই এক দিন সিদ্ধান্ত নিলাম, অনেক হয়েছে আর নয়। কাজটা ছেড়েই দেব। প্রোডাকশনকে জানাবার আগে অমি এক অভিনেত্রী বন্ধু (যে ওই ধারাবাহিকে ছিল) তাকে সবটা বললাম। আর এটাও বললাম যে, আমি রবিদাকে ছাড়ার কারণটাও বলব যাতে, আর কোনও জুনিয়রকে সিনিয়রের হাতে অসম্মানিত হতে না হয়।

পরের দিন সেটে গিয়ে দেখলাম, পরিবেশটাই পাল্টে গেছে। সেই অভিনেতা-পরিচালকের মধুর ব্যবহার দেখে আমি অবাক! বুঝলাম, কথা কানে পৌঁছে গেছে।

আমার সঙ্গে এমনও হয়েছে, আমি খালি পায়ে শট দিচ্ছি। শটের মধ্যে একজন সিনিয়র জুতো সমেত আমার পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে পড়লেন! যাতে আমি শট এনজি করি। আমার সহ্য ক্ষমতা অসীম সেটা ওঁর জানা ছিল না। তাই শটের পর ওঁকেই জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমার অভিনয় ঠিক হচ্ছে তো?

আমি একা নই। এখনও অনেক নতুন অভিনেতা দিনের পর দিন এ ভাবেই অপমানিত হন নামি তারকাদের থেকে। চোখে আঙুল দিয় বোঝানো হয়, তাঁরা ভিড় বাড়ানোর দলে। তাই তাঁদের পাত্তা না দিলেও চলে।

আরও পড়ুন: সুশান্তের মৃত্যু আর বলিউডের ভিতরটা আমি যা জানি​

আরে ভাই পাত্তা দিলে কি তোমার স্টার পাওয়ার কমে যাবে?

কথা প্রসঙ্গে বলি, সুশান্ত সিংহ রাজপুতের আমি বিশাল ভক্ত ছিলাম না। তবে ওঁর ‘ছিছোরে’ ভাল লেগেছিল। সুশান্তকে নিয়ে সবাই এখন অনেক কিছুই বলছেন। ‘ডিপ্রেশন’ শব্দটাও তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে জুড়ে দিচ্ছেন অবলীলায়।

আমি জানি, অবসাদ কাকে বলে। কারণ, আমি এই অবস্থার মধ্যে দিয়ে গেছি। গোটা ২০১৯ আমি অবসাদে ডুবে ছিলাম। রোজ কাজে যেতাম, শট দিতাম, সহকর্মীদের সঙ্গে হাসিঠাট্টায় মাততাম কিন্তু বাড়ি ফিরেই হারিয়ে যেতাম একাকিত্বের অন্ধকারে। সে কী ভয়ানক অবস্থা!

আমি একা একটা অন্ধকার ঘরে বসে থাকতাম। কিছু করতে, কারও সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগত না। প্রায়ই ভাবতাম, ১৪ তলা থেকে ঝাঁপ দিলে কেমন হয়?

এ ভাবে নয় মাস কাটার পর একদিন মনে হল, এত সহজে হেরে যাব! এ ভাবেও জীবন শেষ করে ফেলা সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। তার পরেই মনোবিশ্লেষকের কাছে যাই। ওঁর এবং পরিবারের সাহায্যে এখন অনেক ভাল আছি। নিজের হাতে সাফ করেছি সমস্ত দুঃখ-কষ্ট।

আমার এই যন্ত্রণা কেউ জানে না। কারও সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারিনি।

আজ মনে হয় খুব খারাপদের পাশাপাশি কুণালদা, ভাস্করদা, পীযূষদা, দেবদূত ঘোষ-দার মতো বড় মাপের অভিনেতাদের পেয়েছিলাম। যাঁরা একধারে বন্ধু হয়ে ভুল ধরিয়ে দিতেন। দাদার মতো করে আগলাতেন। ভাল অভিনয় করলে ফোন করে প্রশংসা করতে একটুও কুণ্ঠাবোধ করতেন না।

এঁরা ছিলেন বলেই আমি ২২ বছর ধরে ইন্ডাস্ট্রিতে টিকে গেলাম।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE