হঠাৎ ঠিক করেছিলাম— কলকাতা নয়, দেশের বাড়িতেও নয়। অন্য কোথাও, অন্য কোনওখানে। এ বছরের পুজোয় অসম আমাকে টানল। ষষ্ঠীর দিন বাবাকে নিয়ে মেঘালয়ে পৌঁছোলাম। পা রেখে মনটা একটু দমে গিয়েছিল। ওখানে কোনও পুজো নেই! অফিস, স্কুল—সব খোলা! পথের দু’ধারে পিঠে ব্যাগ নিয়ে পড়ুয়ারা।
আমরা এগিয়ে গেলাম শিলংয়ের পথে। রাস্তার দু’দিকে সদ্যপ্রয়াত জ়ুবিন গার্গের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি। দেখতে দেখতে মনে হল, আমি ওঁর গান খুব ভালবাসি। শিল্পীই কি এ বছর তাঁর রাজ্যে আমাকে টেনে নিয়ে এলেন?
মেঘালয়ে পুজো নেই, মানে শোরগোলও নেই। নিরিবিলি পরিবেশে বাতাসে অল্প শিরশিরানি। ঋতুবদলের প্রথম অনুভূতি এখানেই টের পেলাম। তার পর যত এগিয়েছি তত ছবিটা বদলে গিয়েছে। শিলং, চেরাপুঞ্জি, কাজিরাঙা, গুয়াহাটি— যেন ‘মিনি কলকাতা’! একা গুয়াহাটিতেই হাজারের বেশি পুজো হয়। বাকি জায়গার পুজোর হিসাব এ বার আপনারা করে নিন। এরই মধ্যে চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টির বিরাম নেই। ঝিরঝির শব্দে অনবরত ঝরছেই!
শহরে ফিরতেই মন চনমনে। পায়ে পায়ে প্যান্ডেল। একশো আটটা প্রদীপ জ্বালিয়ে অষ্টমীর সন্ধিপুজোর আয়োজন। সঙ্গে চণ্ডীপাঠ, অঞ্জলির মন্ত্রও আছে। আট থেকে আশি ‘মেখলা সুন্দরী’! কী সুন্দর যে দেখাচ্ছে তাঁদের। ছেলেরা পাজামা, পাঞ্জাবি বা ক্যাজ়ুয়াল পোশাকে ছিমছাম। নিরামিষ, আমিষ— দু’ধরনের খাবার খেয়েছি। স্বাদে, রান্নার ধাঁচে বাঙালিয়ানা ভরপুর। ভাতের সঙ্গে দু’রকমের ডাল, শাকভাজা, তরকারি, পাঁপড় আর এক বাটি চালের পায়েস। বিশ্বাস করুন, পরম উপাদেয়।
কাজিরাঙার জঙ্গলে গন্ডারের মুখোমুখি ভাস্বর চট্টোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
এত কিছু মধ্যেও জ়ুবিনের অভাব সকলের মনে। রাস্তায় রাস্তায় তাঁর ছবি। মণ্ডপে তাঁর গান বাজছে। অসমবাসী তাঁদের ভূমিপুত্রকে হারানোর শোক ভুলতে পারছেন না কিছুতেই। ফলে, পুজোয় যেন প্রাণের সাড়া নেই। কেবলই নিয়মরক্ষার তাগিদ! দেবী দুর্গার মুখের আদলে কিন্তু বাঙালিয়ানা নেই! বরং এখানকার প্রতিমা অসমিয়াদের মতো দেখতে।
পুজো দেখার পাশাপাশি কাজিরাঙা জঙ্গল, জ়ুবিনের সমাধিস্থলেও গিয়েছিলাম। চোখের সামনে একদল গন্ডারকে দেখে অদ্ভুত আনন্দ পেলাম। অসমের গন্ডার তো বিখ্যাত। আর সমাধিস্থল যেন অনুরাগীদের তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। রোজ শয়ে শয়ে লোক আসছেন। প্রত্যেকের হাতে একটি করে গাছের চারা। তাঁরা বৃক্ষরোপন করছেন প্রয়াত গায়কের নামে! জ়ুবিনকে অমর করার দায়িত্ব যেন গোটা অসমের।