কবি হিসেবেই লেখালিখির সফর শুরু হয়েছিল তাঁর। সেখান থেকে শুরু বাংলা ছবির গল্প ও চিত্রনাট্য লেখার কাজ। তাঁর লেখা ‘নষ্টনীড়’, ‘উত্তরণ’, ‘লজ্জা’র মতো সিরিজ়ে উঠে আসে মেয়েদের লড়াইয়ের কথা। তাঁর পড়াশোনা ও গবেষণার কেন্দ্রেও রয়েছেন মহিলারা। সমাজে মহিলাদের লড়াই থেকে রাজনীতি— আনন্দবাজার ডট কম-এর সঙ্গে অকপট সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায়।
প্রশ্ন: কবিতা লেখা থেকে ছবি ও সিরিজ়ের জন্য লেখা। এই পথবদলের নেপথ্যটা কেমন ছিল?
সম্রাজ্ঞী: কবিতা দিয়েই মূলত শুরু লেখালিখি। ছবির জন্য লিখব, কখনও ভাবিনি। এমনকি, গদ্য লেখার কথাও ভাবিনি। ২০১০-এ প্রথম লেখা কবিতার বই প্রকাশিত হয়। আমি তখন একটা চাকরিও করি। সেই চাকরি করতে করতেই ‘মুখার্জিদার বৌ’ ছবির জন্য লেখার সুযোগ। সেখান থেকেই শিবুদার (শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়) সঙ্গে যোগাযোগ। তিনটি ছবিতে লেখার চুক্তি হয়। সফর শুরু সেখান থেকেই।
প্রশ্ন: মেয়েদের কথা উঠে আসে আপনার লেখা ছবিতে। এই ভাবনাও কি নেপথ্যে ছিল?
সম্রাজ্ঞী: আমি যে খুব ভেবেচিন্তে ছবির জন্য লিখতে শুরু করেছিলাম, তা নয়। এটা ঠিক, লিঙ্গসাম্য নিয়ে পড়াশোনা, ভাবনাচিন্তা বরাবরই ছিল। তাই সচেতন ভাবে না হলেও, কোথাও গিয়ে মনে হয়েছিল, মেয়েদের এই গল্পগুলো বলতে চাই। আসলে যে গল্পগুলো বলা হয় না, সেগুলোই বলতে চেয়েছিলাম। তবে ক্রমশ দেখলাম, আমি মেয়েদের গল্পই বলে ফেলছি। তবে ‘দিওয়ার’ বা ‘শোলে’র মতো ছবি দেখলে কি আমরা বলি ‘পুরুষকেন্দ্রিক ছবি’? কিন্তু পোস্টারে কোনও মহিলার মুখ থাকলেই আমরা বলি, ‘মহিলাকেন্দ্রিক ছবি’। আমি মেয়েদের যাপনটা ভাল বুঝি। কিন্তু একই সঙ্গে ছেলেদের গল্পও আমার বলার আছে।
প্রশ্ন: কিন্তু মহিলাকেন্দ্রিক ছবি কি বক্স অফিস সাফল্য আনতে পারে আজও?
সম্রাজ্ঞী: আমি মহিলাদের যে গল্প বলেছি, সেই কাজগুলো সফল হয়েছে। তাই আমি মনে করি, অবশ্যই সফল হয়। শুধু সমালোচক মহল নয়, বাণিজ্যিক ভাবেও সফল হয়েছে সেগুলো। ‘মুখার্জিদার বৌ’ কিন্তু বিপুল সফল ছিল। তার পরের ছবিগুলোতে আমি সংলাপ লিখেছিলাম। যেমন ‘ব্রহ্মা জানে’, ‘ফাটাফাটি’ এই ছবিগুলোও বক্স অফিসে সফল। একমাত্র ‘বৌদি ক্যান্টিন’ বক্স অফিসে সফল হয়নি। তবে ওটিটি-তে এই ছবি আসার পরে অসম্ভব ভাল প্রতিক্রিয়া পেয়েছিলাম আমরা। তা ছাড়া ‘নষ্টনীড়’ বা ‘লজ্জা’ তো রয়েছেই।
প্রশ্ন: আপনি জেন্ডার স্টাডি়জ় নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। শহরে নারী উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা হয়। গ্রাম বা শহরতলিতে মহিলাদের অবস্থান কেমন বলে মনে হয়?
সম্রাজ্ঞী: শহরে আলোচনা হয় ঠিকই। কিন্তু শহরের অবস্থাটা ‘প্যাকেজিং’-এর মতো। শহরে হেনস্থা, গার্হস্থ্য হিংসা, ভেদাভেদ সবটাই রয়েছে। কিন্তু একটা ভদ্রতার মোড়কে রয়েছে। তাই দুম করে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো যাবে না। গ্রামে হয়তো সেই রাখঢাকটা নেই। আর শহরতলি বা মফস্সলে বরং আমি শহরের থেকে এগিয়ে থাকা পরিবার দেখেছি। চারপাশের নানা টুকরো ঘটনা দেখেই ‘নষ্টনীড়’ লেখা। কিন্তু ‘লজ্জা’র বিষয়, অর্থাৎ ‘মৌখিক হেনস্থা’ এখন আমার গবেষণার বিষয়। ‘লজ্জায়’ যা যা দেখানো হয়েছে, সব ক’টিই প্রায় বাস্তবে মহিলাদের সঙ্গে কথা বলেই জেনেছি।
প্রশ্ন: মৌখিক হেনস্থাও যে হেনস্থার মধ্যে পড়ে, তা ‘লজ্জা’ সিরিজ়টি ভাবিয়েছে। কিন্তু আইন মেনে এর সমাধান কী?
সম্রাজ্ঞী: যেমন এক মহিলা গান গাইছেন, তাঁকে বেশ্যা বলে দেওয়া হচ্ছে। এটাও মৌখিক হেনস্থা। ‘লজ্জা’ সিরিজ়ে চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে আমরা গালিগালাজের ব্যবহার রেখেছিলাম। তবে মৌখিক হেনস্থা কিন্তু গালিগালাজ ছাড়াও হতে পারে। শারীরিক আঘাত থাকলে প্রমাণ থাকে। কিন্তু মানসিক ভাবে আঘাত পেলে, তা প্রমাণ করা মুশকিল।
প্রশ্ন: তা হলে?
সম্রাজ্ঞী: একটু আইন ঘাঁটলে দেখা যাবে, ‘ইন্ডিয়ান পেনাল কোড’-এ ছিল বা ‘ভারতীয় ন্যায় সংহিতা’-তেও আছে, আচরণ বা নির্দিষ্ট কিছু কথাকেও হেনস্থা বলা হয়। মেয়েদের এই আইনগুলো জেনে রাখা উচিত। এ ছাড়া মেয়েদের সবার আগে আর্থিক ভাবে স্বনির্ভর হওয়া উচিত। অবশ্য আর্থিক ভাবে স্বনির্ভর মানুষকেও হেনস্থার শিকার হতে দেখেছি। সেটা আসলে মানুষের প্রকৃতি, যা শৈশব থেকে তৈরি করা হয়। শৈশব থেকেই বলা হয়, ‘শ্বশুরবাড়ি গেলে হাড়ে হাড়ে টের পাবি’। যেন শ্বশুরবাড়ি মানেই জেলখানা। শাস্তি দেওয়া হয়।
প্রশ্ন: কিন্তু শারীরিক ভাবে সব হেনস্থারও কি সমাধান হয়?
সম্রাজ্ঞী: একেবারেই না। একটি সমীক্ষাতেও দেখা গিয়েছিল, বহু মহিলারা মনে করেন, স্বামী তো একটু গায়ে হাত তুলতেই পারেন।
প্রশ্ন: এর নেপথ্যে মহিলাদের মানসিকতা ঠিক কেমন?
সম্রাজ্ঞী: এটা একটা ভয়াবহ ব্যাপার। আমি নিজেই ভাবছি, আমি প্রহারযোগ্য। আমাকে মারা যায়। মারার অধিকার আমিই দিয়েছি। অনেকে আবার ভাবেন, বাবা-মা ভালবাসেন বলে মারধর করছেন, বরও ভালবাসেন বলেই মারছেন। এখানে বাবা-মাকে বুঝতে হবে, বাচ্চা যেন মারধরকে ভালবাসার প্রকাশ ভেবে না ফেলে।
আরও পড়ুন:
প্রশ্ন: বৈবাহিক ধর্ষণও এর মধ্যে একটা বিষয়। বিয়ের পরেও সম্মতির প্রয়োজন, এই উপলব্ধি কি আদৌ তৈরি হয়েছে?
সম্রাজ্ঞী: এই বিষয় নিয়ে তো কেউ কথাই বলে না। আমাদের চারপাশে নানা বিষয়ে আড্ডা হয়। কিন্তু এই বিষয়টা থাকেই না। দাম্পত্যেও যে ধর্ষণ হতে পারে, সেই ধারণাই নেই অনেকের।
প্রশ্ন: মহিলাদের আজও চেহারার গড়ন, বিয়ের সিদ্ধান্ত, যে কোনও বিষয় নিয়েই বার বার লজ্জায় ফেলা হয়। তাই না?
সম্রাজ্ঞী: হ্যাঁ, আমি কম বয়সে বিয়ে করেছিলাম। সবাই ভেবেছিল, এমন পড়ুয়া মেয়ে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করে নিল মানে সব শেষ! আবার কেউ দেরিতে বিয়ে করলে তাঁকেও বাঁকা চোখে দেখা হচ্ছে। বিশেষ করে একটু বেশি বয়সে বিয়ে করলে তো তাঁকে কটুকথায় ভরিয়ে দেওয়া হয়। কয়েক জন প্রবীণ তারকার বিয়ে, সম্পর্ক নিয়ে আমরা এমন দৃষ্টান্ত দেখেছি। মানুষ নিজের প্রত্যাশার বাইরে কিছু দেখলে কটাক্ষ করবেই। এর মধ্যে কিছু মানুষ অস্বাভাবিক আনন্দ পায়। কাউকে খোঁচা দেওয়ার কিছু না পাওয়া গেলে তাঁর পোশাক নিয়েই কাটাছেঁড়া শুরু হয়।
প্রশ্ন: পোশাকের প্রসঙ্গে সমাজমাধ্যম এখন সরগরম। হাতকাটা পোশাক পরা নিয়ে তরজা চলছে। এর আগে শাড়ির আঁচল নিয়েও বিতর্ক হয়েছে। এখানেও কাঠগড়ায় মহিলারাই।
সম্রাজ্ঞী: আগে এমন কোনও বিষয় দেখলেই প্রতিক্রিয়া দিতাম, সমাজমাধ্যমে লিখতাম। এখন মনে করি, আমি কথা বলব না এই বিষয়ে। তবে আমি মানি, হাতকাটা পোশাকের কথা যিনি বলেছেন, না ভেবেই বলেছেন। কেউ নিজে অপছন্দ করতেই পারেন। কিন্তু পরা উচিত কি না, সেই রায় কেউ দিতে পারে না। তবে আমি এখন এই বিষয়গুলো এড়িয়ে যাই। শাড়ির আঁচলের ক্ষেত্রেও একই কথা বলব। তবে একজন বর্ষীয়ান অভিনেত্রীকে যে ভাষায় ট্রোল করা হয়েছে, আমি সেটাও সমর্থন করি না। প্রতিবাদের ভাষা হওয়া উচিত ছিল, ‘এড়িয়ে যাও’।
প্রশ্ন: ঋতুস্রাব নিয়েও বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এখনও এই নিয়ে ছুতমার্গ রয়ে গিয়েছে। কী বলবেন?
সম্রাজ্ঞী: ‘প্যাডম্যান’, ‘ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মটি’র মতো ছবির পরেও এমন ছুতমার্গ রয়ে গিয়েছে। অত্যন্ত দুঃখজনক! আসলে একটা সময়ে স্যানিটারি ন্যাপকিন ছিল না। মহিলারা কাপড় ব্যবহার করতেন। উঠে কাজ করাই কঠিন ছিল মহিলাদের পক্ষে। তাই ঠাকুরপুজো হোক বা রান্নাঘরের কাজ, সব কিছু থেকেই বিরত রাখা হত মহিলাদের। এই ভাবেই ভাবি আমি। কিন্তু একটা সময়ের পরে সমাজে সব কিছুকেই পুরুষতন্ত্রের আওতায় এনে নিয়ম বানিয়ে দেওয়া হয়। আজ তো কোনও অসুবিধাই নেই। আজ তো সমস্ত রকমের স্যানিটারি ন্যাপকিন ইত্যাদি পাওয়াই যায়। এই স্বাভাবিক বিষয়টাকে স্বাভাবিক ভাবে নিতে শিখতে হবে।
প্রশ্ন: কর্মক্ষেত্রে পুরুষতন্ত্রের মুখে মহিলাদের আজও পড়তে হয়। আপনার এমন অভিজ্ঞতা হয়নি?
সম্রাজ্ঞী: আমি যেখানে পড়াতাম, সেখানে পুরুষ শিক্ষকের সংখ্যাই বেশি ছিল। তখন পিওন বা গ্রুপ-ডি কর্মীরা এসে আমাকে বলতেন, ‘স্যররা বলেছেন, এটা করতে হবে’। আমার পুরুষ সহকর্মীদের চালক দেখতাম গাড়ির দরজা খুলে দিতেন। আমার ক্ষেত্রে সেটা করতেন না। এই সূক্ষ্ম ভেদাভেদ তো ছিলই। আর এখনও লক্ষ করেছি, মহিলাদের থেকে একটু নমনীয় আচরণই প্রত্যাশা করা হয়। আমি ব্যক্তিগত সম্পর্কে যতটা নমনীয়, পেশার জগতে ঠিক তার উল্টো।
প্রশ্ন: কোনও মহিলার একাধিক সম্পর্ক বা বিয়ে থাকলে, তাঁকে নানা কটূক্তি করা হয়। ইন্ডাস্ট্রিতেই রয়েছে এমন দৃষ্টান্ত। কিন্তু পুরুষদের ক্ষেত্রে বিচার সম্পূর্ণ আলাদা।
সম্রাজ্ঞী: আমরা এমন একটা দিনকালের কথা বলছি, যেখানে প্রায় অধিকাংশ মানুষেরই একাধিক সম্পর্ক। আমরা যে ইন্ডাস্ট্রিতে রয়েছি, সেখানে বহু মানুষের গোপন সম্পর্ক রয়েছে। জনসমক্ষে একটা সুখী সংসার রয়েছে হয়তো। কিন্তু গোপনে আরও সম্পর্ক রয়েছে। এটাই আমার কাছে দ্বিচারিতা। এর চেয়ে যাঁরা প্রত্যেকটা সম্পর্ককে স্বীকৃতি দিতে পেরেছেন, তাঁদের বেশি সম্মান করি। তাঁদের সাহস আছে, তাই বলতে পেরেছেন, একটা সম্পর্ক ভাঙার পরে আর একটা সম্পর্কে তাঁরা জড়িয়েছেন। আর নারী-পুরুষের দ্বিচারিতাও আসে যৌনতার প্রসঙ্গকে কেন্দ্র করে। পুরুষের যৌনতাকে উদ্যাপন করা হয়। মহিলার একাধিক সম্পর্ক হলে সেখানেও সেই যৌনতার প্রসঙ্গ উঠে আসে। তাই তাঁদের আরও বেশি করে কটাক্ষ করা হয়। বিয়ে, সম্পর্ক এগুলো খুবই ব্যক্তিগত।
প্রশ্ন: পরকীয়া, বহুগামিতা থেকে আজকের যুগের জেন জ়িদের মধ্যে সিচুয়েশনশিপ, বেঞ্চিং। সম্পর্কের এখন অসংখ্য নাম। আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
সম্রাজ্ঞী: গল্প লেখার জন্য এই নতুন নামগুলো শিখেছি। আমার মনে হয় সম্পর্কে জটিলতা কমেছে। অনেক বেশি স্বচ্ছ এখন। কোনটা স্থায়ী সম্পর্ক আর কোনটা সিচুয়েশনশিপ, এই পার্থক্য আজকের প্রজন্ম জানে। আগে থেকেই যদি কেউ জানেন, এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নেই, তা হলে প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনাই কমে যায়। কিন্তু আমি নিজে অনুভব করতে পারব না এই সম্পর্কগুলো আসল কেমন। কারণ, আমি সব সময়ে যে কোনও সম্পর্কে প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাসী। প্রেম, পরকীয়ার প্রশ্ন নয়। সম্পর্ক মানেই দায়িত্ব রয়েছে বলে মনে করি। নতুন প্রজন্ম আসলে সৎ। ওরা বলেই দিচ্ছে, ‘আমার তোকে ভাল লাগে। কিন্তু তোর সঙ্গে থাকতে পারব না।’ তবে এর ফলে মনের উপর চাপ পড়ছে কি না, সেটা আমার জানা নেই।
প্রশ্ন: পুরুষদের অধিকার নিয়েও আজ কথা হচ্ছে।
সম্রাজ্ঞী: হ্যাঁ। তার কারণ সব কিছুরই উল্টো দিক রয়েছে। ১০০টা ‘মিটু’র মধ্যে ২০টা ঘটনা মিথ্যা হতে পারে। সেটা না মেনে নিলে পক্ষপাতিত্ব করা হবে। নারীবাদ সেটা শেখায় না। নারীবাদ ঔদার্যের কথা বলে, সাম্যের কথা বলে। তাই পুরুষেরা হেনস্থার শিকার হলে সেটাও দেখা উচিত। কিন্তু এটাও ঠিক, যুগের পর যুগ ধরে মহিলারা বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। ‘মেট্রো ইন দিনো’-তে একটি দৃশ্যে পঙ্কজ ত্রিপাঠীর উপর রেগে তাঁর পোশাক খুলে নিয়ে চলে যাচ্ছেন কঙ্কনা সেনশর্মা। হাস্যকর ভাবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু আমার দৃশ্যটি দেখে রাগ হচ্ছিল। লিঙ্গটা যদি উল্টে যেত তা হলে কিন্তু হেনস্থার প্রসঙ্গ উঠত!
প্রশ্ন: একটু অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক। কবি বা লেখিকা বলতেই মানুষের চোখে গুরুগম্ভীর একটা ছবি ভেসে ওঠে। কিন্তু নুসরত জাহানের সঙ্গে ‘অর্ডার ছাড়া বর্ডার’-এ আপনিও রিলে নাচলেন।
সম্রাজ্ঞী: (হাসি) ওটা সত্যিই সবার খুব অদ্ভুত লেগেছে। সবাই অবাক হয়েছেন। সমালোচনা করেননি কেউ। হ্যাঁ, এক সময়ে কবি হিসেবে আড়ষ্টতা ছিল। তবে বয়স যত বাড়ছে বুঝছি, অশ্লীল (যদিও সেটা আপেক্ষিক) কিছু করব না। কিন্তু জীবন তো একটাই! (আবার হাসি) এমনিতেও আমি আমার চেনা পরিসরে খুবই হাসিখুশি।
প্রশ্ন: আপনার স্বামী অরূপ চক্রবর্তী একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। এ দিকে আপনারও বিভিন্ন বিষয় মতামত রয়েছে, যা অনেক সময়ে শাসকদলেরও বিরোধিতা করে। তাই না?
সম্রাজ্ঞী: আমাদের দু’জনেরই প্রচুর মতামত রয়েছে। এই ভাবেই আমরা থাকতে ভালবাসি। শুরুর দিকে অসুবিধা হত। এখন বোঝাপড়া খুব ভাল হয়ে গিয়েছে। ওর জগতে আমি বিনা নিমন্ত্রণে শুধু স্ত্রী হিসেবে চলে যাই না। আমরা দু’জনেই স্বতন্ত্র। আমাদের মতান্তরও হয়। তাতে আমাদের একসঙ্গে থাকায় কোনও অসুবিধা হয় না।
প্রশ্ন: শাসকদলের নেতার স্ত্রী হয়ে তো কটাক্ষও শুনতে হয়েছে?
সম্রাজ্ঞী: হ্যাঁ। আগে প্রতিক্রিয়া দিতাম। সমাজমাধ্যমে লিখতাম। কেউ বলেছে, ভিন্ন মত থাকলেও কেন বিয়ে করে আছেন? কেউ বলেছে, নিশ্চয়ই আপনি কোনও সুবিধা পেয়েছেন! কিন্তু আমি কোনও সুবিধাই নিইনি। চাইলে নিতে পারতাম, কিন্তু সজ্ঞানে সেটা নিইনি। কেউ আবার বলেছেন, আপনারা দু’জনেই আসলে একই মতে বিশ্বাসী। উপরে উল্টোটা দেখাচ্ছেন। আগে এগুলো বললে লিখে ফেলতাম সমাজমাধ্যমে। এখন আর সেটা করি না। এখন আমাদের দু’জনের জগতের মানুষগুলো, আমরা যেমন, তেমন ভাবেই আমাদের গ্রহণ করে নিয়েছেন।
প্রশ্ন: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলাপ রয়েছে?
সম্রাজ্ঞী: আমার বাবা কলকাতা পুরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমার বিয়েতেও এসেছিলেন ২০১২ সালে। সেই ছবি অবশ্য আমি কখনওই কোথাও দিইনি। অনেক ছোট বয়সে বিয়ে হয়েছিল। তাই বাবার জগতের লোকজনই এসেছিলেন। অন্য দলের রাজনীতিবিদেরাও এসেছিলেন। বিয়ের আগেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কয়েক বার কথা হয়েছিল। তবে আমার বিয়েতেই ওঁর সঙ্গে শেষ দেখা।
প্রশ্ন: আপনি কখনও রাজনীতিতে যোগ দেবেন?
সম্রাজ্ঞী: একটা সময়ে স্কুলের শেষের দিকে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম নিয়ে খুব সক্রিয় হয়ে গিয়েছিলাম। তখন মনে হয়েছিল, রাজনীতি আমার আগ্রহের জায়গা। কিন্তু এখন বুঝি, আমি ভীষণ ভাবে রাজনৈতিক মানুষ। কিন্তু আমি দলীয় রাজনীতিতে নেই। এখনও পর্যন্ত তা-ই মনে হয়। পরে কী হবে, জানি না। কারণ, কোনও কিছুই খুব পরিকল্পিত ভাবে হয়নি আমার জীবনে। আর রাজনীতি মানেই একটি প্রতিষ্ঠানের অংশ হয়ে চলা। আমি তো চাকরিতেই সেটা করতে পারিনি! আমার ফ্রিল্যান্সার হয়েই বাঁচা উচিত। (হাসি)
প্রশ্ন: আচ্ছা, ছবিতে লেখার ক্ষেত্রে কখনও নিজের পছন্দের সঙ্গে সমঝোতা করতে হয়নি আপনাকে?
সম্রাজ্ঞী: শুরুতে অসুবিধা হত। পরে বুঝেছি, আমি যে ভাবে গল্পটা বলতে চাইছি, তা নিজের মতো করে কিছুটা তো বলতে পারছি। ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে তো কোনও গল্প বলছি না। আর যাঁরা বদলে দিতে বলছেন, তাঁরাও অভিজ্ঞ। বরং ওঁদের থেকে শিখেছি এবং তাতে আমার ভালই হয়েছে!