Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Saheber Cutlet

আজও ইন্ডাস্ট্রিতে একজন পরিচালক অন্য পরিচালকের জন্য গল্প লেখেন না: অঞ্জন দত্ত

সাক্ষাৎকারের প্রথমেই জানিয়ে দিলেন, “আমি আজ কাউকে জ্ঞান দিতে আসিনি। আমি জ্ঞান-দা অঞ্জন নই। যাহা বলিব, মজার ছলে বলিব।"

অঞ্জন দত্ত।

অঞ্জন দত্ত।

স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০২০ ১৬:২৬
Share: Save:

সাক্ষাৎকারের প্রথমেই জানিয়ে দিলেন, “আমি আজ কাউকে জ্ঞান দিতে আসিনি। আমি জ্ঞান-দা অঞ্জন নই। যাহা বলিব, মজার ছলে বলিব। এই লকডাউনে নির্মল আনন্দের প্রয়োজন। সেই আনন্দের উপহার দিতে চাই আমার ছবি ‘সাহেবের কাটলেট’-এ।"


গুন্ডা বাংলা ছবিতে গান গাইছে।

কমেডিয়ায়ন গানের ছন্দে মিলিয়ে মিলিয়ে তার জবাব দিচ্ছে।

নায়িকা কথায় গান গাইছে।

দর্শকের হয়তো মনে পড়বে ‘সাউন্ড অফ মিউজিকের কথা’!

বাংলা ছবিতে প্রথম অপেরা। গান গাইছেন অভিনেতারা। নীল দত্ত গানের ক্লাসও নিচ্ছেন আবার রেকর্ডিংও হচ্ছে।

ছবির নাম 'সাহেবের কাটলেট'।

নতুন ছবি সম্পর্কে বলতে গিয়ে সব পরিচালকেরাই বলেন ‘এরকম ছবি আগে হয়নি… ’

অঞ্জন: এত বছর ইন্ডাস্ট্রিতে থেকে আমার বানিয়ে কিছু বলার দরকার পড়ে না। আর আমি তো বলছি, ‘সাহেবের কাটলেট’ ‘গুপী গায়েন বাঘা বায়েন’ থেকে ‘গল্প হলেও সত্যি’- র রেফরেন্সে তৈরি। তবে এর নির্মাণে ভিন্নতা আছে। এই যে সারাক্ষণ থ্রিলার, ব্যোমকেশ, অন্য গোয়েন্দার ভিড়, এর বাইরে এই ছবি। সম্পর্কের টানাপড়েন, নায়ক-নায়িকাকে বুঝল না, বাংলা ছবির এই জায়গা থেকে বেরিয়ে এসছে ‘সাহেবের কাটলেট’।

কী রকম?

অঞ্জন: ছবির একটা দৃশ্যে উকিল এসছে ঝামেলা মেটাতে। উকিলের নাম ‘কানা উকিল’। এই চরিত্র করছে কাঞ্চন, যে কিছুতেই বাংলা বলে না। ভুল ইংরিজিতে কথা বলে যায়। সে গুড মর্নিং বলার আগে ‘সেলিব্রেশন’ বলে। নায়িকার যেমন ‘স’ –এর দোষ। সেইখানে গিয়ে পড়ে অর্জুন চক্রবর্তী, আমার ছবির রুচিশীল এক নায়ক। ও পুরনো বাড়ি বিক্রি করতে যায়। সেই বাড়ির ভাড়াটেরা সব ওই রকম। এটা করতে গিয়ে মারামারি, গান, ঝগড়া হতে হতে শ্রেণি বিভাজন ভেঙে যায়। বিশেষ করে রান্নার মধ্যে দিয়ে সব বিভাজন মুছে যায়। সংসার এক হয়ে যায়।

কী বলতে চায় আপনার ছবি?

অঞ্জন: আসলে এই পৃথিবী যত খারাপ হোক, এর মধ্যেই গুন্ডা বদলে যেতে পারে! শহরতলির ‘খেঁদি-র’ সঙ্গে শহুরে আধুনিক ছেলের বন্ধুতা হতে পারে। এটাই নতুনত্ব। কিন্তু ধারাটা কিন্তু এক। সেই ‘সাউন্ড অব মিউজিক’ যে বলছে, বাইরে থেকে আসা গভর্নেস পরিবারের লোক হয়ে গেল। এই পরিবার, এক হয়ে যাওয়া তরুণ মজুমদার থেকে হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়-- সকলের ছবিতেই আছে। এখানে সময়, প্লট আলাদা।

মানে অঞ্জন দত্তের সেই অ্যাংলিসাইজ বাঙালির গল্প নয় এটা?

অঞ্জন: না। আমি নিজেও ধুতি পরে জামাই সেজে ছবিতে ঢুকে পড়েছি। নির্ভেজাল আনন্দের ছবি এটা। যেমন হিন্দির ‘খুবসুরত’। বাঙালির আর কিছু না থাক, কৌতুকবোধ আছে। সেটা ‘সাহবের কাটলেট’- এর বিষয়। ছন্দে কথা বলা যেমন…

পরিচালক আনন্দের উপহার দিতে চান আমার ছবি ‘সাহেবের কাটলেট’-এ

উদাহরণ দিন না…

অঞ্জন: বাড়ি নিয়ে বাড়াবাড়ি/ টাকা নিয়ে কাড়াকাড়ি/ খেতে বসে তাড়াতাড়ি খেও না/ হজমের গোলামাল কেন হয় ভেবে দেখ/ পান খেয়ে পান্তুয়া চেয়ো না।

এই রকম মজার কথা আছে। জমিয়ে পরিবারের সঙ্গে বাঙালি আনন্দ করে এই পুজোয় ছবিটা দেখুক।

মানুষ যাবে ছবি দেখতে?

অঞ্জন: হল খুলতেই হবে। লোকে বাড়ির মধ্যে আটকে। তাই এ বার হলে যাবে। পুজোয় তো প্যান্ডেলে যেতে পারবে না বাঙালি। কিছু না কিছু সে করবেই। বেরিয়ে গিয়ে নিয়ম মেনে নিশ্চয় হলে যাবে। অফিস যেমন যাচ্ছে, রেস্তরাঁয় যেমন যাচ্ছ। উপহারের ক্ষেত্রেও বাঙালি শড়ির বদলে হয়তো বেডকভার দেবে একে অপরকে। আচ্ছা এত কথা বলছি, কোনও মানে হচ্ছে আমার কথার?

অবশ্যই! বলুন না…

অঞ্জন: যা বলছিলাম, হল না খুললে যাঁরা সেখানে কাজ করেন তাঁরা তো আত্মহত্যা করবেন। কিন্তু হলে হই হই করে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করা যাবে না এখন। সব নিয়ম মেনে লোকে যাক। শ্যুটিং করতে যাচ্ছি মানে, যা প্রাণ চায় করতে পারব না আর। শ্যুটের পরে বা আগে কোনও দিন খোঁজ নিয়েছি আমরা, আমারদের টেকনিশিয়ানদের শরীর ঠিক আছে কি না? আজ আমি বাধ্য হচ্ছি খোঁজ নিতে। এটা অতিমারি শিখিয়েছে। একজনের শরীর খারাপ হলে একজনকে খোঁজ নিতে হবে। মানুষ থিতিয়েছে এ বার।

বড় ব্যানারের ছবির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে এই ছবি?

অঞ্জন: বড় বাজেটের ছবি এখন রিলিজ হবে না। ফলে এ বার পুজোয় যে ছবি রিলিজ করছে, তার সব বাজেট মোটামুটি এক। মনে হয় না, খুব টেনশন হবে।

কিন্তু বাংলা ছবির এই লকডাউনে ওটিটি তে তো কদর হল না!

অঞ্জন: বাংলা ছবি ন্যাশনাল ওটিটিতে একদম নীচে। সারা পৃথিবীতে বাঙালি রয়েছে। তেলুগু সিনেমা যেমন জানে, তাদের ছবি সারা পৃথিবীর তেলুগুভাষী মানুষ দেখবেন। বাংলা ছবি সেখানে কী? বাংলা ছবি আঞ্চলিক হয়ে থেকে যাচ্ছে। জাতীয় স্তরে ভাবাই হয়, বাংলা ছবির ভবিষ্যৎ নেই। সাউথ বা হিন্দিতে মনোনিবেশ করাই ভাল! এর জন্য দায়ী বাংলা ইন্ডাস্ট্রি। বাঙালিও হিন্দি ছবি দেখছে। যে কারণে ‘ডাবল ভার্সন’ হচ্ছে।

বাংলা গানের ও এক অবস্থা?

অঞ্জন: নাহ্‌। আমি জানি, বাংলা গান গ্লোব্লালি শুনছে মানুষ। মুম্বইয়ের মিউজিক কোম্পানি জানে বাংলা গানের কদর। আমাকে গান করার জন্য কত বার অনুরোধ করেছে ওরা। আমি সারেগামা-র সঙ্গেই আছি। থাকব। বাংলা অনলাইন প্রোগ্রামের কদর অনেক বেশি। তবে ছবির ক্ষেত্রে বাংলা ওটিটিকেই প্রমাণ করতে হবে আমার দর্শক পৃথিবীময়। তখন ন্যাশনালেও কদর বাড়বে বাংলা ছবির। বাংলা ইন্ডাস্ট্রিকে আত্মশুদ্ধি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

'সাহেবের কাটলেট' ছবির এক দৃশ্য

পুজোয় গান করছেন?

অঞ্জন: রোজ অনলাইনে অনুষ্ঠান আছে। স্টুডিয়ো থেকে লাইভে আসছি আমরা। বাঙালির ট্যালেন্ট আছে কিন্তু। সেই ট্যালেন্ট সামনে আসুক।আচ্ছা বলুন তো, সিনেমা কীসের ওপর দাঁড়িয়ে?

কীসের ওপর?

অঞ্জন: লেখক। লেখক শ্রেণির কদর এখানে এখন সবচেয়ে কম। '৬০-এর দশক ভাবুন তো! কারা ছবির গল্প লিখছেন? তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র। ভাবুন একবার! সব বিশাল মাপের সাহিত্যিক! শুধু উত্তম-সুচিত্রা দেখলে হবে? শুনুন, সব পরিচালক সত্যজিৎ রায় হতে পারবে না। অথচ আমরা সবাই সত্যজিৎ রায় হতে চাইছি। জাপানে কি সবাই কুরোসাওয়া হতে চাইছে? কেন বলুন তো আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে একজন পরিচালক অন্য আর একজনের হয়ে গল্প লেখেন না! কেন? এমন লেখক চাই, যারা পরিচালনা করবে না!

ঋতুপর্ণ ঘোষ থেকে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় কিন্তু লেখক এবং পরিচালক…

অঞ্জন: হ্যাঁ। কিন্তু এ রকম কেন হয় না, প্রতীম লিখল, অন্য কেউ পরিচালনা করল। কেন হবে না? গানে তো হয়। তা হলে?

একটু ভাবতে হবে জানেন, আমি যা বলছি বাস্তব বলছি। আমি চাই না, আমার শ্রেণিশত্রু বাড়ুক। যার একটা করার ক্ষমতা, সে একটাই কাজ করবে। উত্তমকুমার মূলত অভিনয়-ই করেছেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনয় করেছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন, নাটক করেছেন। তার মানে তো এটা নয়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বড় উত্তম কুমার ছোট! যে যার জায়গায় উজ্জ্বল! একটা কাজ করা মানে কেউ ছোট হয় না। সবাইকে সব করতে হবে না! আমরা বলে বেড়াই বাংলা ছবি দেখুন, বাংলা ছবি দেখুন, খারাপ হলেও দেখুন! নাহ্‌ হবে না! আমাদের ভাল ছবি বানিয়ে দিতে হবে দর্শককে। '৮০-র দশকে বাংলা গান শোনাই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আচমকাই সুমন, নচিকেতা, অঞ্জন এসে বাংলা গানের ধারাকে বদলে দিল। আমাদের বুঝতে হবে, দর্শক কেন বাংলা ছবি দেখতে চাইছে না। বাজেট কোনও ফ্যাক্টর নয়। ইন্ডাস্ট্রির সকলের মধ্যেই নিজস্ব ক্ষমতা আছে। সেটাকে ব্যাবহার করার সময় এখন…

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Tollywood Saheber Cutlet Anjan Dutta India
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE