দৃশ্যটা কিছুতেই ভুলতে পারছি না! স্ত্রী হাঁটু গেড়ে মৃত স্বামীকে আঁকড়ে ধরে বসে। নেপথ্যে কাশ্মীরের চোখজুড়ানো দৃশ্যপট। এত সুন্দর একটা জায়গায় নির্বিচারে এ ভাবে কিছু পর্যটক খুন হয়ে গেলেন! ছায়াছবিতে যেমন হয়। পহেলগাঁও সন্ত্রাসবাদীদের হাতে আবার রক্তাক্ত। কেন জানি ঘটনার সঙ্গে একটি সূত্র খুঁজে পাচ্ছি। সামনেই হিন্দুদের অমরনাথ যাত্রা। এই সময় অনেকে অমরনাথে তীর্থ করতে যান। তাঁদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া হল। এ বছর তাঁরা আর হয়তো যাবেন না। এ কথার পর প্রশ্ন উঠতে পারে, তা হলে কি হিন্দুদের প্রত্যেক ধর্মোৎসবের আগে কাশ্মীর এ ভাবেই রক্তাক্ত হয়? আমার বক্তব্য, কোনও না কোনও ভাবে টার্গেট হিন্দুরা হয়ে যাচ্ছেন। কাশ্মীরি হিন্দু পণ্ডিতেরা একই ভাবে অত্যাচারিত হয়েছিলেন, এখনও হচ্ছেন। খুবই দুঃখজনক।
মঙ্গলবারের ঘটনা দেখতে দেখতে মনে পড়ে যাচ্ছিল ২০০১ সালের অপর্ণা সেনের ছবি ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আইয়ার’-এর কথা। আমি সেই ছবির অংশ ছিলাম। ওখানেও পরিচালক দেখিয়েছিলেন, পোশাক খুলিয়ে হিন্দু না মুসলিম— পরীক্ষা করছিল সন্ত্রাসবাদীরা। এটাই ঘটে ওখানে। ধরুন, আপনি হিন্দু ব্রাহ্মণ। কিন্তু আপনার পৈতে নেই। প্রাণ বাঁচাতে সেই মুহূর্তে নিজেকে মুসলিম বলে দাবি করলেন। পোশাক না খুললে তো প্রমাণ করা যাবে না, আপনি সত্যি না মিথ্যা! এটাই বাস্তব। এ ভাবেই হিন্দু আর মুসলিমের মধ্যে পার্থক্য করে ওরা।
মনে পড়ছে ধারাবাহিক ‘ঝনক’-এর শুটিংয়ের কথা কথা। মাত্র দু’বছর আগে লীনা গঙ্গোপাধ্যায়-শৈবাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের টিমের সঙ্গে কাশ্মীরে শুটিং করেছি। তখনও ভূস্বর্গ জুড়ে কী শান্তি! শুটিংয়ের ফাঁকে সকলকে নিজের জন্মভূমি ঘুরিয়ে দেখিয়েছি। জিনিসপত্র কেনাকাটা, খাওয়াদাওয়া— নিশ্চিন্ত মনে করিয়েছি। দু’বছরের মধ্যে সবটা বদলে গেল! এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে তহসিলে চাকুরিরত জনৈক যুবকের কথা। অফিসে ঢুকে ৩৪ বছরের ওই যুবককে খুঁজে বার করে হত্যা করেছিল সন্ত্রাসবাদীরা। একে ‘টার্গেট কিলিং’ বলে। হিন্দু, হিন্দু ব্রাহ্মণদের বেছে বেছে এ ভাবেই খুন করা হয়। যখনই এলাকাবাসী বা দেশের অন্যেরা মনে করেন কাশ্মীরে আবার শান্তি ফিরে এসেছে, তখনই সন্ত্রাস ঘটানো হয়।
আরও পড়ুন:
এখনও আততায়ীদের খুঁজে বার করা হচ্ছে না। এখনও কড়া হাতে মোকাবিলা করা হচ্ছে না। খুঁজে বার করে এমন একটা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক, যা দেখে বাকিরা ভয় পাবেন। সৌদি আরবে যে ভাবে প্রকাশ্যে শাস্তি দেওয়া হয়। না হলে এরা বারে বারে ফিরে আসবে। তখন আর শুধু কাশ্মীর নয়, সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে। সারা দেশ এদের আক্রমণে যখন-তখন রক্তাক্ত হবে।
যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এই রক্তপাত। ছোট থেকে কলেজে পড়া অবধি এটাই দেখে এসেছি। আগে সংবাদমাধ্যম ডিজিটাল হয়নি। হাতে হাতে মোবাইল ছিল না। সমাজমাধ্যমে ঘটনার ঝলক ছড়িয়ে পড়ত না। ফলে, ঘটনা ঘটলেও সবটা জানা যেত না। তখনও দেখেছি এখনও জানি, যাঁরা প্রকৃত কাশ্মীরি, তাঁরা কিন্তু সন্ত্রাস চান না। মঙ্গলবারের নিন্দনীয় ঘটনার পর তাঁরা প্রতিবাদ মিছিল বার করেছেন। সাধারণ মানুষেরা চান না, এ ভাবে অকারণে রক্তপাত হোক। ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাক। পর্যটকেরা কাশ্মীরে আসা বন্ধ হয়ে যাক। অর্থনীতির দিক থেকে আবার পিছিয়ে পড়বে রাজ্য। আবারও শুটিং বন্ধ হয়ে যাবে এখানে। হিন্দুদের ধরে ধরে এই হত্যা এটাই প্রমাণ করে দিল— দেশ ধর্মগন্ধী হয়ে উঠেছে।