Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে

এখন বড়দিনের ছুটি। কিন্তু স্কুল খুললে কী হবে? পেশোয়ারের ঘটনার পর আতঙ্কিত অভিভাবকেরা। লিখছেন রেশমি বাগচিএখন বড়দিনের ছুটি। কিন্তু স্কুল খুললে কী হবে? পেশোয়ারের ঘটনার পর আতঙ্কিত অভিভাবকেরা।

শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০১
Share: Save:

প্রতিদিনের মতো সেদিনও এসেছিল ওরা। বইখাতা, একরাশ আনন্দ, খুনসুটি, টিচারের পড়ার মাঝে আনমনে বাইরে তাকানো, নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব... কিন্তু বেলা গড়াতেই সব শেষ।

চারদিকে মৃত্যুর নিস্তব্ধতা। বাইরে বুঝি ড্রিল হচ্ছে, ভেবেছিল কচি মুখখানা। শব্দের তীব্রতা বাড়তেই ছুটে বাইরে এসেছিল করিডরে। একবারও কি খারাপ লাগেনি জঙ্গিদের? প্রশ্ন শোকসন্তপ্ত বাবার। যে হাত ধরে স্কুলে গিয়েছিল সে, আজ সেই হাত চিরদিনের মতো ছেড়ে দিল। অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা, এই ঘটনা জেনে বহু ক্ষণ রিঅ্যাক্ট করতে পারেননি। নিজে মা তিনি, বুঝতে পারছেন কী সাঙ্ঘাতিক কষ্টের মধ্যে দিন যাপন করছেন ওই বাবা-মায়েরা। “ওঁরা তো বেঁচে থেকেও মরে গেলেন,” বলছেন তিনি। তাঁর দুই সন্তান বাড়ির বাইরে গেলেই, সারাক্ষণ এক আতঙ্ক, চিন্তা গ্রাস করে থাকে। এই ঘটনা তাঁকে এতটাই বিহ্বল করেছে, নিজের মনেই তাই প্রশ্ন করছেন, কী ভাবে বেঁচে আছি? পেশোয়ারের ওই স্কুলের প্রতিটি মায়ের মতো ঋতুপর্ণাও চান তাঁর সন্তানকে আগলে রাখতে সব বিপদ আপদ থেকে।

অভিনেত্রী রচনা, চিন্তিত সেই সব বাচ্চাকে নিয়ে যারা চোখের সামনে এই হত্যালীলা দেখেছে। এইটুকু বয়সে যা অভিজ্ঞতা হল, কী করে সুস্থ জীবন পাবে ওরা? প্রশ্ন রচনার। যেহেতু এখন নেটে সব কিছুই খুব সহজে দেখতে পাওয়া যায়, তাই রচনার মনে হয়, এই ভয়ঙ্কর ছবি, কান্না, কফিনবন্দি ছোটদের দেহ, যে কমবয়সিরা দেখবে, তাদের মনে এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।

এ কোন সকাল রাতের চেয়েও অন্ধকার? কান পাতলেই স্বজনহারাদের আর্তনাদ। “শুকিয়ে গেছে চোখের জল, মায়ের মনের আগুন জ্বলছে। কী দোষ করেছিল ওরা? আর্মির ছেলেমেয়ে বলেই এত কষ্ট পেতে হল? বাচ্চাদের স্কুলে পাঠিয়ে, ভরসা ভগবান,” বলছেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। অসম্ভব রাগ হয়েছে, কষ্ট হয়েছে। নিজের কথা উগড়ে দিয়েছেন টুইট করে, ব্লগ লিখে। কিন্তু কিছুতেই মনের গভীরে কুরে কুরে চলা ব্যথাটা কমাতে পারছেন না। আজ এই দিনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে তাঁর, “নিরাপত্তা চাই।” কিন্তু কে দেবে নিরাপত্তা? যে পড়ুয়ারা আজ বুলেট জর্জরিত হয়ে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে, ওরাও তো নিরাপত্তা চেয়েছিল। ওদের অনেকে বাঁচার জন্য প্রাণপণ ডেস্কের নীচে লুকিয়েছিল। প্রসেনজিতের নিজের সন্তান হোক বা তার বয়সি বাচ্চারা, এই হিংসার বাতাবরণেই বড় হচ্ছে সকলে। আক্ষেপ তাঁর। বললেন, “এই পৃথিবী এত রূঢ় কেন? আমরা কি দায় এড়াতে পারি?”

কতটা মর্মান্তিক ঘটনা, তা বলার অপেক্ষা রাখে না, কিন্তু আপনার সহনাগরিক, তিনিও কি এতটাই ব্যথিত? “পেশোয়ারে যা ঘটেছে, তাতে আমাদের এত মাথাব্যথা কেন?” ঠিক এই মন্তব্যই এক সহনাগরিকের কাছে শুনেছেন শিল্পী রূপঙ্কর? জীবন থেমে থাকে না। এই ঘটনার পরের দিন তাঁর অনুষ্ঠান ছিল। শো করেছেন, দর্শক গান শুনে নেচেছেন। তার মাঝে পেশোয়ারের নিষ্পাপ শিশুদের এই পরিণতি নিয়ে কেউ কি আদৌ ভেবেছেন? নিজের মনেই প্রশ্ন করেন রূপঙ্কর। “যতক্ষণ না আমার বাচ্চার গায়ে আঁচ লাগছে, ততক্ষণ কি আমাদের কোনও হেলদোল আছে? এই স্বার্থপরতা আমাদের কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে? ”

সামনে বড়দিন, নিউ ইয়ার। শপিং মলে ঢোকার সময় চেকিং হলেই আশঙ্কা হয়, তবে কি পুলিশের কাছে কোনও হামলার খবর আছে? লেখিকা সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, প্রতি মুহূর্তে এই আতঙ্ক নিয়েই আসলে বেঁচে আছি আমরা। সঙ্গীতা নিজের সন্তানকে লক্ষ করেছেন। জীবনের নির্যাস ওরা অল্প বয়সেই বুঝে ফেলেছে। মানুষ কত নৃশংস তার মর্মার্থ বোঝে ওরা। এই পরিস্থিতিতে একজন চিকিৎসক যতটাই সাহসী, ততটাই অসহায়, বলছেন হৃদরোগবিশেষজ্ঞ কুনাল সরকার।

“এত বাচ্চার প্রাণ যখন বিপন্ন, তখন একজন চিকিৎসকের কাছে এই যুদ্ধ অত্যন্ত কঠিন। যখন সেই চিকিৎসক দেখেন, একের পর এক নিথর দেহ কফিনবন্দি হয়ে যাচ্ছে, ডেথ সার্টিফিকেটও তিনিই লিখেছেন... তখন দায়িত্ব পালনই তাঁর প্রধান কর্তব্য”, বলছেন কুনাল সরকার।

কলকাতার স্কুলগুলোও এই ঘটনার পর চিন্তিত। তাঁরা চান সব পড়ুয়াদের নিরাপত্তা দিতে।

মডার্ন হাই স্কুলের প্রিন্সিপাল, দেবী কর বলছেন, “নিরাপত্তা জরুরি। কিন্তু তাই বলে, ওদের স্বাভাবিক জীবন যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।” নৃত্যশিল্পী ডোনা গঙ্গোপাধ্যায় এমন এক সমাজের স্বপ্ন দেখেন, যেখানে তার সন্তান বেঁচে থাকবে নির্ভয়ে। এই ঘটনা তিনি চান সকলেই ভুলে যাক। ডোনা মনে করেন, সমাজে এই ধরনের নৃশংস মানুষের কোনও প্রয়োজন নেই। ১৬/১২-র ঘটনা খুব সহজে হয়ত মুছে যাবে না। কিন্তু এ সবের মাঝেও ভাল ভাবে বাঁচতে হবে, এমনটাই মনে করছেন ডোনা।

পাকিস্তানের এক টেলিভিশন অ্যাঙ্কর ঘটনার পরের দিন এক অনুষ্ঠানের মাঝে আবেগাপ্লুত হয়ে, কান্নায় ভেঙে পড়েন। গোটা দুনিয়া দেখেছে সেই ছবি। নিউজ অ্যাঙ্করদের কখনও আবেগ প্রকাশ করতে নেই, জানি। কিন্তু কখনও কখনও পেশাদারিত্ব হার মানে আবেগের কাছে। সেদিন পাক চ্যানেলের ওই অ্যাঙ্করের মোমবাতি হাতে চোখের জল, দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে প্রতিবাদের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল শোকস্তব্ধ মানুষের কাছে। আমাদের সকলের কাছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

reshmi bagchi peshawar guardians
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE