Advertisement
E-Paper

মা হয়ে ওঠার ঝড়ঝাপটায় আয়না ধরল ‘ডিয়ার মা’

অনিরুদ্ধের ছবিতে বরাবরই কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থেকেছে সম্পর্ক এবং তার সূক্ষ্ম মনস্তত্ত্ব। এ ছবিও একই পথে হাঁটে। একই সুতোয় সমাজ আর তার মানসিকতাকেও গল্পে বুনেছেন পরিচালক এবং কাহিনিকার।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৮ জুলাই ২০২৫ ২০:৩৭
কেমন হল ‘ডিয়ার মা’?

কেমন হল ‘ডিয়ার মা’? ছবি: সংগৃহীত।

‘মা হওয়া কি মুখের কথা?’

এখনও মা-মাসি-কাকিমা কিংবা ঠাকুরমা-দিদিমাদের মুখে ঘুরেফিরে আসে কথাটা। এবং তাঁরা যে খুব একটা ভুল বলেন, তা নয় বোধহয়। কারণ, মাতৃত্ব শুধু শারীরিক পরিবর্তন তো নয়। বরং তার চেয়েও অনেকটাই বেশি মাত্রায় মনের দিক থেকে বদলে যাওয়া। নাড়ির টান বা রক্তের সম্পর্ক তার সংজ্ঞা নয়। বরং বুকের ভিতর থেকে অনুভব করতে পারা এক আত্মিক বন্ধন। কারও মেয়ে বা কারও স্ত্রী থেকে কারও মা হয়ে ওঠাটা তাই একেবারে ভিন্ন একটা সফর। কেউ দশ মাস-দশ দিন গর্ভে ধারণ করে একটা ছোট্ট প্রাণকে। কেউ হাঁটে আইভিএফ বা ‘সারোগেশন’-এর পথে। নানা কারণে অনেকে নিজে জন্ম না দিলেও দত্তক নেয় অনাথ কোনও শিশুকে। মাতৃত্ব, সে যে পথেই আসুক, দু’হাতে আগলে সন্তানকে বড় করতে করতে আমূল পাল্টে যায় মা-ও। সুখ-দুঃখ, ভাল-মন্দ, ভাল থাকা, হাজার ঝড়ঝাপটা পেরিয়েও সে বরাবরের মতো বাঁধা পড়ে যায় স্নেহের বাঁধনে। অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরীর নতুন ছবি ‘ডিয়ার মা’ সেই সফরটাকেই ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছেন এক মা ও তার দত্তক কন্যার জীবনযাপন ও টানাপড়েনের পথ ধরে। আর শুধু তা-ই নয়, আলো ফেলেছেন ছুটন্ত কেরিয়ারের প্রভাবে বদলে যাওয়া দাম্পত্য, সংসার কিংবা সম্পর্কের সমীকরণ, সমাজ ও তার মানসিকতা, অ্যাডপশন ও তাকে ঘিরে তৈরি হওয়া নানা মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা— সব দিকেই।

ছবির শুরুতে দেখা যায়, একটি স্টার্টআপ-এর কোফাউন্ডার, সদাব্যস্ত বৃন্দা মিত্র (জয়া আহসান) থানায় গিয়েছেন তাঁর কিশোরী মেয়ে সোহিনী ওরফে ঝিমলির (নন্দিকা দাস) নিখোঁজ হওয়ার ডায়েরি লেখাতে। সঙ্গে পিতৃপ্রতিম কলেজ-শিক্ষক সোমেশ (ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়)। সেখানেই ইনস্পেক্টর অসিতাভ নন্দীর (শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়) সঙ্গে কথোপকথনে, বৃন্দার ভাবনায়, ফ্ল্যাশব্যাকের হাত ধরে একটু একটু করে দর্শকের জানা হয়ে যায় বৃন্দা ও ঝিমলির গল্প।

বৃন্দা ও তাঁর প্রয়াত স্বামী অর্ক মিত্র (চন্দন রায় সান্যাল) দু’জনেরই ছিল দুরন্ত কেরিয়ার। তাঁদের প্রেমের বিয়েতে বছর যত গড়াতে থাকে, অর্কর মনে ততই জাঁকিয়ে বসে বাবা হওয়ার ইচ্ছে। এ দিকে, বৃন্দা তাতে আমল দিতে নারাজ। কারণ, এক দিকে যেমন কেরিয়ারে কোনও রকম আপস করতে তিনি রাজি নন, তেমনই মা হওয়ার, সন্তানকে বড় করার দায়দায়িত্ব নিতে মনের দিক থেকেও সায় ছিল না তাঁর। এ নিয়ে নিত্য অশান্তি, কাউন্সেলিং পেরিয়ে শেষমেশ বৃন্দা আর অর্ক হাঁটেন দত্তক নেওয়ার পথে। তাঁদের জীবনে আসে একরত্তি কন্যা। বাবা, মা এবং পরিবারের দীর্ঘ দিনের কর্মসহায়িকা নির্মলার (অনুভা ফতেপুরিয়া) যত্নে একটু একটু করে বড় হতে থাকে ছোট্ট ঝিমলি (অহনা)। মায়ের ব্যস্ততা, রিসার্চে-মিটিংয়ে আঁটোসাঁটো জীবনের উল্টো পিঠে বাবার আদর-প্রশ্রয়, একসঙ্গে কাটানো সময় আঁকড়েই বাঁচতে শেখে সে। এ দিকে, মেয়ে যে তাঁকে চিনতে শিখছে না, ঝিমলির সঙ্গে তাঁর যে কোনও বন্ধন গড়ে উঠছে না, হাজার ডেডলাইনের ফাঁকে এ ভাবনাটাও একটু একটু করে কুরে কুরে খেতে থাকে বৃন্দাকে। তাই আচমকা এক সকালে মেয়ের সঙ্গে খেলতে খেলতে অর্ক না ফেরার দেশে পাড়ি দিলে দু’হাত বাড়িয়ে ঝিমলিকে কাছে টেনে নিতে চান বৃন্দাও। কিন্তু ততদিনে বেশ খানিকটা দেরি হয়ে গিয়েছে। ছোট্ট ঝিমলির জানা হয়ে গিয়েছে, তার আসল মা অন্য কেউ। তাই অর্কর না থাকা আর বৃন্দার ব্যস্ততা কখন যেন একরত্তি মেয়েটাকে সরিয়ে দিয়েছে অনেকটা দূরে। মেয়েকে আঁকড়ে বাঁচতে চাওয়া বৃন্দা তবু নিজের মতো করে চেষ্টা করতে থাকেন। তাঁকে যথাসাধ্য সাহায্য করে যান নির্মলাও।

ঝিমলি যে তার আসল মা অহনা নায়ারের (পদ্মপ্রিয়া) সঙ্গে এক সুতোয় জুড়ে গিয়েছে, তা বেরিয়ে আসে তার নিখোঁজ-রহস্যের পুলিশি তদন্তে। তখনই জানা যায়, এ বিষয়টা জেনেও পুলিশের কাছে তা গোপন করেছিলেন বৃন্দা। আরও অনেক কিছু কি লুকিয়ে যাচ্ছেন তিনি? কোথায় গেল ঝিমলি? সত্যিই কি পালিতা মাকে ছেড়ে আসল মায়ের কাছেই চলে গিয়েছে সে? এ সবের উত্তর রাখা আছে অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী এবং শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের কাহিনি-চিত্রনাট্যে।

ছবির দৃশ্য।

ছবির দৃশ্য।

আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখা এক কেরিয়ারিস্ট মেয়ে থেকে দাম্পত্যের চেনা ছকের বাইরে হাঁটতে চাওয়া স্ত্রী কিংবা দত্তক সন্তানকে সহজ ভাবে ভালবাসতে না পারা থেকে মেয়েকে আঁকড়ে বাঁচতে চাওয়া এক একলা মা— জয়া যেন নিজেকেই ছাপিয়ে গিয়েছেন এক ভূমিকা থেকে অন্য ভূমিকায়। বাবা হতে চাওয়া থেকে বাবা হয়ে ওঠার সফরে ভাল লাগে চন্দনকেও। গৃহসহায়িকা থেকে পরিবারের অভিভাবক হয়ে ওঠা নির্মলাকে যত্নে গড়েন অনুভা। পুচকে ঝিমলির চরিত্রে মিষ্টি পুতুলের মতো লাগে ছোট্ট অহনাকে। কিশোরী ঝিমলির মানসিক টানাপড়েন, তার ক্ষতবিক্ষত মনটাকে জীবন্ত করে তোলে নন্দিকাও। ঝিমলির আসল মায়ের চরিত্রে পদ্মপ্রিয়া কিংবা তার স্বামী সাগরের ভূমিকায় সায়ন মুন্সী সংক্ষিপ্ত উপস্থিতিতেও চোখ টানেন। তুখোড় পুলিশ ইনস্পেক্টর তথা ভয়ানক সংসারী স্বামী এবং বাবা অসিতাভ হিসেবে শাশ্বত যে সেই একই রকম দুরন্ত, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তদন্তের দক্ষতা থেকে চোখা রসিকতা, সবেতেই সমান তালে দর্শককে মুগ্ধ করে ছাড়েন।

অনিরুদ্ধের ছবিতে বরাবরই কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থেকেছে সম্পর্ক এবং তার সূক্ষ্ম মনস্তত্ত্ব। এ ছবিও একই পথে হাঁটে। আর তাই বোধহয় অর্ক-বৃন্দা কিংবা বৃন্দা-ঝিমলির প্রতিটা মুহূর্ত, তাঁদের টানাপড়েনগুলো এত চেনা ঠেকে। একই সুতোয় সমাজ আর তার মানসিকতাকেও গল্পে বুনেছেন পরিচালক এবং কাহিনিকার। এক দিকে, আধুনিকমনস্কতার আয়না হয়ে উঠে আসে অর্ক-বৃন্দার দাম্পত্যের রসায়ন কিংবা মা হওয়ার হৃদয়-নিংড়ানো অনুভূতি যে তাঁর আসছে না, এ কথা নিজের স্যরকে বৃন্দার সহজ ভাবে বলতে পারার মুহূর্তগুলো। তারই বিপ্রতীপে বৃন্দার নিখোঁজ হওয়ার নেপথ্যে প্রেম বা বয়ফ্রেন্ড রয়েছে, এমনটা অনুমান করা পুলিশকর্মীও এই সমাজের মানসিকতাকেই হাটখোলা করে দেন।

তবে দুয়েকটা জায়গা একটু খাপছাড়া ঠেকে বটে। যেমন, ফ্ল্যাশব্যাকেই বার বার উঠে এসেছে ছোট্টবেলা থেকেই ঝিমলিকে তাড়া করে বেড়াত অজানা ভয়। মা-কে ঘিরে মানসিক টানাপড়েনও ধরা পড়েছিল বেশ ছোট বয়সেই। দাম্পত্যের সমস্যায় যে বৃন্দা মনোবিদের কাছে যান, সে মেয়ের এই সমস্যাগুলো নিয়ে মনোবিদের কাছে গেল না কেন? আর গিয়ে থাকলে সে বিষয়টা গল্পে প্রাধান্য পেল না কেন? তা ছাড়া, কেরিয়ারিস্ট বৃন্দা যখন মেয়ের ছোটবেলাতেই অনুভব করলেন যে সন্তান দূরে সরে যাচ্ছে, তবে তিনি ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালান্সকে গুরুত্ব দিতে চাইলেন না কেন? যে আধুনিক সমাজের গল্প এ ছবির কেন্দ্রে, সে সমাজ তো এই ভারসাম্য রক্ষার প্রয়োজনীয়তা টের পেয়েছে বেশ কিছুকাল আগেই। এই বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা ছবিতে থাকলে মন্দ হত না।

তবে অনিরুদ্ধের অন্য ছবিগুলোর মতো ‘ডিয়ার মা’-এরও সম্পদ হয়ে থাকবে তার গানগুলো। আর থাকবে ছবি শেষ হওয়ার পরেও মাথায় ঘুরপাক খাওয়া একটা ভাবনা— একেবারে কাছের মানুষকেও কেন বলা জরুরি যে তার জন্য কতটা ভালবাসা বয়ে বেড়াচ্ছেন আপনি!

Film Review Dear Maa Jaya Ahsan Aniruddha Roy Chowdhury
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy