রবীন্দ্রনাথ আর সত্যজিতের গণ্ডি ছাড়িয়ে কি এগোতে পারছে না বাঙালি! নতুন করে এই ভাবনা জাগিয়ে তুললেন দেবজ্যোতি মিশ্র। তাঁর সঙ্গী হলেন আরও দুই বাঙালি শিল্পী— সব্যসাচী মুখোপাধ্যায় এবং শ্রীনন্দাশঙ্কর।
নিতান্তই বাণিজ্যিক প্রয়োজনে দেবজ্যোতি তৈরি করেছেন ‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে...’-র এক নব রূপ। এক সময় রবীন্দ্রসঙ্গীতের যন্ত্রানুষঙ্গে ছিল কড়াকড়ি। এখন আর নেই। সুরস্রষ্টারা নিজেদের ভাবনায় মিলিয়ে নিতে পারেন রবিঠাকুরের গান। সব্যসাচীর নতুন বিবাহসম্ভারের জন্যও তেমনই করলেন তিনি। কাফি রাগের ‘মম চিত্তে...’গানে দেবজ্যোতি ব্যবহার করেছেন কর্নাটকি যন্ত্রানুষঙ্গ ঘটম। এরই সঙ্গে জুড়ে গিয়েছেন উদয়শঙ্করের পৌত্রী শ্রীনন্দাশঙ্কর। আর এরই মাঝখানে রয়ে গেলেন সত্যজিৎ রায়। এক প্রশ্নচিহ্ন হয়ে কি?
আরও পড়ুন:
সোমবার নেটপাড়ায় ছড়িয়ে পড়ে সব্যসাচীর বিপণন ভিডিয়ো। দেবজ্যোতির সেই সুরে অনেকেই খুঁজে পেয়েছেন ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবি ভূতের নাচের আবহ। সেখানেও ব্যবহার হয়েছিল ঘটম, মৃদঙ্গম, কঞ্জিরার মতো বাদ্যযন্ত্র। নৃত্যপরিকল্পনা করেছিলেন উদয়শঙ্করের সঙ্গী শম্ভু ভট্টাচার্য। এ বার সেই জায়গায় এসেছেন উদয়শঙ্করের পৌত্রী শ্রীনন্দা।
সব্যসাচী যে রবীন্দ্রানুরাগী তা আগেই প্রমাণিত হয়েছে। এর আগেও তিনি ব্যবহার করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের গান। এ বার বিয়ের মরসুম শুরুর আগেই নিজের নতুন শিল্পসৃষ্টি তুলে ধরলেন। সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে এই প্রথম নয়, আগেও বহু বার কাজ করেছেন দেবজ্যোতি। রবীন্দ্রনাথ ও বাঙালির কথা সব্যসাচীর ভাবনা-পরিসরে বিস্তৃত। সুরকার জানান, কর্নাটকি সঙ্গীতের প্রতি রবীন্দ্রনাথের ভাললাগা ছিল। সেখানে থেকেই তিনি এই অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। দেবজ্যোতির কথায়, ‘‘মম চিত্তে গানটি বাঙালি ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছে। দক্ষিণী বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারও নতুন নয়। আমার মনে হয় এই গানটা ঘটম, মৃদঙ্গমের মতো বাদ্যযন্ত্র দাবি করে। আমি রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে বহু কাজ করেছি তা ‘চোখের বালি’ হোক কিংবা ‘গানের ওপারে’। এখানেও তেমনই হয়েছে।” দেবজ্যোতির দাবি, সব্যসাচী নতুন আলোয় সবটা দেখতে পারেন। এই ভাবনা সব্যসাচীর, তিনি শুধু রূপায়ণ করেছেন বলে দাবি সুরকারের। তবে এই নবরূপায়ণ কিন্তু কোনও ভাবেই রবীন্দ্রনাথকে ছাপিয়ে যায়নি। তিনি বলেন, “আমরা নতুন আলোয় গানটা দেখতে চেয়েছিলাম। আসলে সব্যসাচীর রবীন্দ্রনাথের প্রতি অসম্ভব শ্রদ্ধা ও সম্মান রয়েছে।’’
ভূতের নাচের সঙ্গীতের সঙ্গে মিল প্রসঙ্গে সুরকার বলেন, ‘‘আমরা এই পৃথিবীতে যে কাজই করি না কেন, তা কোনও না কোনও ভাবে আমাদের পছন্দের শিল্পীদের থেকে পাওয়া অনুপ্রেরণাই। রবীন্দ্রনাথ থেকে উদয়শঙ্কর— এঁদের সকলের মধ্যে দক্ষিণী গানের প্রভাব রয়েছে। আমি বহু বার ‘মম চিত্ত’ গানটিকে ব্যবহার করেছি। কিন্তু এ বার ব্যক্তিগত ভাবে এই মৃদঙ্গম কিংবা ঘটমের ব্যবহারটি ভাল লেগেছে। আমি নিজে তাঁর জীবন, দর্শন ও সঙ্গীতের দ্বারা অনুপ্রাণিত। এটুকু বলতে রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে তাঁর ভীষণ ভাল লাগত।’’
শ্রীনন্দা অবশ্য দাবি করেন, এই কাজের সঙ্গে তিনি যুক্ত হয়েছেন শুধু ফ্যাশনের জন্য। তবে এই নির্মাণ যে গানটিকে নতুন ভাবে দর্শক-শ্রোতার কাছে পৌঁছে দেবে, তা-ও দাবি করেন তিনি।
যদিও এখানেও উস্কে উঠেছে বিতর্ক। দৃশ্যায়নে দেখা যায় সব্যসাচীর তৈরি ‘জুতি’ পরে তাল দিচ্ছেন মডেল। পায়ে তাঁর মল। রীতিমতো ওডিশি নাচের ভঙ্গি করছেন তিনি। নৃত্যশিল্পীরা প্রশ্ন তুলছেন এ ভাবে জুতো পরে, পায়ে ঘুঙুর বা মল বেঁধে নাচের ভঙ্গি করা কি সঙ্গত? তার উত্তরে শ্রীনন্দা বলেন, “এখানে নাচের থেকে বেশি একটি ভাবকে ধরার চেষ্টা করেছি আমি। আমরা যখন সাধারণ অবস্থায় কোনও গানে তাল দিই, তখন কি জুতো খুলে নিই?’’ পাল্টা প্রশ্ন তুলেছেন শিল্পী। এত কিছুর মধ্যে বাঙালির প্রাণটিই খুঁজে নিতে চাইছেন দেবজ্যোতি বা শ্রীনন্দা।