(বাঁ দিকে, উপর থেকে) জোজো, রূপঙ্কর বাগচী, লোপামুদ্রা মিত্র। সিধু, সমদীপ্তা মুখোপাধ্যায়, দীপান্বিতা আচার্য (ডান দিকে, উপর থেকে)। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
আরজি কর-কাণ্ডে উত্তাল শহর। এ দিকে পুজোর বাকি নেই বেশি দিন। এই পুজোর দিকে সারা বছর তাকিয়ে বসে থাকেন সঙ্গীতশিল্পীরা। এক সময়ে পুজোর গানের অ্যালবামের জন্য মুখিয়ে থাকতেন সঙ্গীতপ্রেমীরা। পুজোর আগে পোশাক বিপণির পাশাপাশি ভিড় জমত কলকাতার রেকর্ডের দোকানগুলিতে। বেশ কয়েক বছর হয়েছে চিরকালের জন্য ঝাঁপ বন্ধ হয়েছে বহু দোকানের। তার পর থেকে সঙ্গীতশিল্পীদের রোজগারের মূল উৎস মঞ্চের অনুষ্ঠান। সামনে সারিতে থাকা প্রধান শিল্পীরাই শুধু নন, পুজো উপলক্ষে মঞ্চের অনুষ্ঠানের আশায় থাকেন যন্ত্রশিল্পীরাও। এমনকি মঞ্চসজ্জা বা শব্দ আয়োজকদের সারা বছরের রোজগারের বড় অংশ আসে পুজোর অনুষ্ঠান থেকেই। এ বছর সেই রোজগারের জায়গাতেই পড়ছে কোপ।
বাতিল হচ্ছে একের পর এক অনুষ্ঠান। পুজো হলেও মনোরঞ্জনে মন নেই বড় অংশের মানুষের। মঞ্চে গায়িকা জোজোর অনুষ্ঠান দেখতে মুহূর্তে ভিড় জমে। শহর থেকে শহরতলি, পুজোয় তাঁর অনুষ্ঠান বাঙালির কাছে বিশেষ আকর্ষণ। আরজি-কর কাণ্ডের বিচারের দাবিতে সরব হয়েছিলেন তিনিও। কিন্তু সব সময় শিল্পীদের রোজগারের উপরেই কেন কোপ পড়বে? আনন্দবাজার অনলাইনের কাছে প্রশ্ন তোলেন জোজো। তিনি বলেন, “কিছু হলেই, প্রথমে কেন শিল্পীদের উপরে কোপ পড়ে? মানুষ মনে করেন, এটা শুধুই মনোরঞ্জনের জায়গা। একজন শিল্পী হয়তো এক লক্ষ টাকা পারিশ্রমিক নিচ্ছেন। কিন্তু তিনি এটা একার জন্য নিচ্ছেন না। গোটা সেটআপের জন্য নিচ্ছেন।”
শিল্পীদের অনুষ্ঠান ঘিরে আরও অনেকের রোজগার চলে বলে দাবি জোজোর। তাঁর জবাব, “শিল্পীর সঙ্গে যন্ত্রশিল্পীরাও থাকেন। সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার থাকেন। এ ছাড়া সেই অনুষ্ঠানের মঞ্চ যাঁরা সাজান অথবা সেখানে যে হকাররা স্টল দেন, তাঁদেরও আয়ের জোগান হয় এই অনুষ্ঠানগুলো থেকে। কিন্তু মানুষ অদ্ভুত ভাবে গানবাজনাটাই আগে বন্ধ করে দিতে বলেন। অথচ, এই শিল্পীরাই যে কোনও দুর্যোগে সবার আগে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাঁরাই কিন্তু অনুষ্ঠান করে টাকা তুলে দেন।”
ইতিহাস ঘেঁটে দেখলেও বোঝা যায়, শিল্প কী ভাবে প্রতিবাদের মাধ্যম হয়ে উঠেছে। কখনও গান গেয়ে, কখনও বা শিল্পীর তুলিতে প্রতিবাদের ভাষা ফুটে উঠেছে। অনুষ্ঠানের মঞ্চকেও তেমনই প্রতিবাদের একটি শক্তিশালী মাধ্যম বলে মনে করেন জোজো। তাঁর কথায়, “যেখানে ১৫ হাজার মানুষ গান শুনতে আসেন, সেখানে আমি নিজের বক্তব্য তুলে ধরতে পারি। মঞ্চটাই তো আমার সবচেয়ে বড় প্রতিবাদের জায়গা। আর গানবাজনা শুনলেই প্রতিবাদের জোর কমে যাবে, এটা ভুল ধারণা।”
তবে প্রতিবাদের শহরে এই পরিস্থিতি কিছুটা মেনে নিয়েছেন রূপঙ্কর বাগচী। যে ভাবে অনুষ্ঠান একের পর এক বাতিল হচ্ছে, তা দেখে অতিমারি পর্বের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে গায়কের। তিনি বলেন, “আমাদের পেশাটাই এমন। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মধ্যে তো আমাদের কাজটা আসে না। অর্থাৎ, আমরা কাজ না করলে, মানুষের চলবে না, এমন নয়। তাই এই পেশায় থাকতে গেলে এই ঝুঁকিটা থাকবেই। মহামারি বা দুর্যোগের সময়ে এই পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের এমন সমস্যার মুখোমুখি হতেই হবে।”
শহরের অস্থির পরিস্থিতির জন্য একাধিক কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছে রূপঙ্করেরও। গায়কের স্বীকারোক্তি, “খারাপ লাগছে কাজ হারাচ্ছি বলে। আমি তো একা নই। আমার সঙ্গে যন্ত্রশিল্পীরাও রয়েছেন। বাদ্যযন্ত্র যাঁরা বয়ে নিয়ে যান মঞ্চ পর্যন্ত, তাঁদেরও পারিশ্রমিক দিতে হয়। প্রত্যেকের উপর প্রভাব পড়েছে। সময়টা স্থির না হলে এটা ঠিক হবে না।”
শহর তথা রাজ্যের পরিস্থিতি খারাপ হলেও, সমগ্র বিনোদন জগতে এর প্রভাব পড়েছে বলেছে মনে করছেন না রূপঙ্কর। সঙ্গীতশিল্পীরাই শুধু সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন। গায়কের কথায়, “ছোট পর্দার অভিনেতারা তো নিয়মিত কাজ করছেন। ছবির শুটিংও তো বন্ধ হয়নি। আমরা যে হেতু ‘স্টুডিয়ো বেসড’ ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করতে পারিনি, তাই এই ভোগান্তি আমাদের হবে। সঙ্গীতশিল্পী গান রেকর্ড করবেন স্টুডিয়োতে এবং সেই গানের অ্যালবাম বাজারে বিক্রি হবে, এমন তো হয় না। তাই আমরা অপেক্ষা করে থাকি, কবে অনুষ্ঠান হবে। কবে আমাদের কেউ গান গাইতে ডাকবে। তাই আমাদের মেনে নিতেই হবে। আমি তো জোর করে কাউকে বলতে পারব না, অনুষ্ঠান করতেই হবে।”
এই পরিস্থিতি নিয়ে লোপামুদ্রা মিত্র বলেছেন, “মানুষ বুঝতে পারছেন না, এটা একটা পেশা। এখান থেকে বহু মানুষের পেট চলে। সঙ্গীত জগতের বহু শিল্পী নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এটা মানুষের বোঝা দরকার। আমরা বছর তিরিশের বেশি গান গাইছি। তাই আমাদের উপরে হয়তো সরাসরি প্রভাব পড়ছে না। কিন্তু আমার সঙ্গে যে যন্ত্রশিল্পীরা আছেন, তাঁরা কিন্তু বেশ চিন্তিত। ওঁদের বয়স কম। জীবনে লক্ষ্য আছে। ওঁদের অর্থ রোজগারের অন্য কোনও জায়গা নেই। আমার গানের সংসারেও ১৮-১৯ জনের রোজগারের কথা আমাকে মাথায় রাখতে হয়। তাই এটা খুবই আশঙ্কার বিষয়। আমাদের মন ভাল নেই ঠিকই। কিন্তু, পেট তো চালাতে হবে। বাজারে ইলিশ মাছ বিক্রি হচ্ছে। মাদক দ্রব্যের বিক্রিতেও কোনও প্রভাব নেই। কিন্তু, সব কিছুর প্রভাব সঙ্গীতশিল্পীদের রুজিরুটিতেই পড়ে।”
তথাকথিত ‘সেলেব্রিটি’ তকমা নেই। তবে দীপান্বিতা আচার্যের লোকগানের জনপ্রিয়তা রয়েছে বাংলার শ্রোতাদের মধ্যে। পুজোর সময়ে প্রতি বছরই একাধিক অনুষ্ঠান থাকে তাঁর। কিন্তু চলতি বছরের পুজোয় গোটা ব্যান্ড নিয়ে একটি অনুষ্ঠানও নেই দীপান্বিতার। অনুষ্ঠানের আয়োজকেরা বাতিল করেছেন দু’টি অনুষ্ঠান। তিনি বলেন, “আয়োজকের নিশ্চিত করে জানাতে পারছেন না, অনুষ্ঠান হচ্ছে কি না। আসলে ওঁরাও ধন্দে রয়েছেন। অনুষ্ঠানগুলি নির্ভর করে স্পনসরের উপরে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির জন্য স্পনসরের অভাব রয়েছে। তবে এই পরিস্থিতিতে এটা মেনে নিয়েছি। প্রতিবাদটাও দরকার। যদিও এর সমাধান সময়সাপেক্ষ। কিন্তু, বহু শিল্পীর রোজগারের বড় অংশ আসে পুজোর অনুষ্ঠান থেকে। আমাদের ব্যান্ডের কোনও অনুষ্ঠান নেই এ বার পুজো। একা কিছু কাজ করছি।”
অতিমারির সময়েও সবার আগে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল গানের অনুষ্ঠান। সব কিছু স্বাভাবিক হতে শুরু করে ধীরে ধীরে। কিন্তু সবার শেষে স্বাভাবিক হয় গানের অনুষ্ঠানের জগৎ। গায়ক সিধু বলছেন, “প্রত্যেকে নিজের কাজ করছেন। তা হলে সঙ্গীতশিল্পীরা কাজ করলে অসুবিধা কোথায়? অতিমারির সময়েও দেখা গিয়েছিল, সবার আগে বাতিল হল একের পর এক গানের অনুষ্ঠান। আবার সবার শেষে ছন্দে ফিরল সঙ্গীত জগৎ। বাস-ট্রাম চলেছে। অথচ প্রেক্ষাগৃহগুলি বন্ধ রাখা হয়েছিল।”
এই উত্তাল পরিস্থিতিতে সমাজমাধ্যমে গানের অনুষ্ঠান সংক্রান্ত কিছু পোস্ট করলেই ট্রোলিং-এর মুখে পড়তে হচ্ছে শিল্পীদের। সেই বিষয়টি অবশ্য গুরুত্ব দিতে চাইছেন না সিধু। তাঁর স্পষ্ট জবাব, “আসলে সমাজমাধ্যমে মন্তব্য করে দেওয়া খুব সহজ। আমি আমার কাজ করব। আবার প্রতিবাদও করব নিজের মতো করে। আর ট্রোলিং একটু হজমও করে নিতে হবে। অথবা ট্রোলড হতে পারি, এমন পোস্ট করব না। আমরা তো এর মধ্যেই অনুষ্ঠান করলাম। কিন্তু, তার কোনও প্রচার করিনি সমাজমাধ্যমে। একটা অনুষ্ঠানের ছবি না হয় সমাজমাধ্যমে না-ই দিলাম।”
সারেগামার মঞ্চ থেকে সঙ্গীত জগতের পরিচিত মুখ সমদীপ্তা মুখোপাধ্যায়। সমাজমাধ্যমে জনপ্রিয়তা থাকলেও রুজিরুটির মূল জায়গা মঞ্চের অনুষ্ঠান। গায়িকা বলেছেন, “আমরাও তো সাধারণ মানুষ। আমরাও চাই, সঠিক বিচার হোক। তবে সবার সঙ্গেই যেন সঠিক বিচার হয়। আসলে মানুষ আমাদের অনুষ্ঠানকে কেবল বিনোদন হিসেবেই দেখছেন। কিন্তু, এটা তো আমাদের কাছে কাজ, রোজগারের মাধ্যম। আমি এবং আমার সঙ্গে যন্ত্রশিল্পীদের উপরেও এর প্রভাব পড়ছে। প্রতিবাদ চলুক। তবে অনুষ্ঠান বন্ধ করে প্রতিবাদ করা বন্ধ হোক। আমরা শিল্পীরা তো এই কাজটা করেই বাঁচি। অন্য কোনও রাস্তা আমাদের নেই।”
বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান বাতিল হয়ে গিয়েছে সমদীপ্তার। তাঁর কথায়, “আমাদের তো এ বার জীবিকায় ফিরতে হবে। মাস গেলে আমাদের ধরাবাঁধা বেতনও নেই। আমাদের সত্যিই সমস্যা হচ্ছে। তাই চাইব, শিল্পীদের উপর যেন আর কোপ না পড়ে।”
শুধু শহরের অনুষ্ঠান নয়। কোপ পড়েছে গ্রামগঞ্জের ‘মাচা’ অনুষ্ঠানেও। পুজোর আয়োজকদেরও মনে পড়ে যাচ্ছে অতিমারির স্মৃতি। একের পরে এক অনুষ্ঠান বাতিল হওয়ায় তাঁদেরও মাথায় হাত পড়েছে। অন্য বছরের মতো শহরের পথেঘাটে চোখে পড়ছে না বিজ্ঞাপনের ব্যানার ও হোর্ডিং। আর্থিক দিক থেকে খানিক থমকে গিয়েছে কল্লোলিনী। কিন্তু তা বলে আরজি-কর কাণ্ড নিয়ে আন্দোলনকে শিল্পীরা সমর্থন করছেন না, তা নয়। তাঁরাও রয়েছেন ন্যায়বিচারের আশায়। কিন্তু নিজেদের পেট বাঁচিয়ে কী ভাবে কাজের স্বাভাবিক ছন্দে তাঁরা ফিরবেন, সেটাই এখন দেখার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy