শৈশবে দেখা সরস্বতী আজ আমার চোখে অনেকটাই বদলে গিয়েছে। প্রথম সরস্বতীকে চেনা হাতেখড়ির সময়ে। তখন সরস্বতী আমার চোখে সাকার। বিদ্যার দেবী। ৩ বছর বয়সে যে সরস্বতীপ্রতিমার সামনে হাতেখড়ি দিয়েছিলাম, তাকে কখনও বিসর্জন দিতে পারিনি। সেই সরস্বতীকেই আজও পুজো করি।
বাড়ি বদল হয়েছে। সময় গিয়েছে। সরস্বতীপ্রতিমাটি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল। সেই প্রতিমা ফের জোড়া লাগিয়ে প্রতি বছর পুজো করে আসছি। প্রথম দিনে সেই প্রতিমার যেমন চেহারা ছিল, তেমনই রাখার চেষ্টা করেছি। এই হল সাকারের গল্প।
ক্রমশ সেই সরস্বতী আমার বন্ধু হয়ে উঠেছে। জীবনের নানা বিপদ-আপদে তাকে পাশে পেয়েছি। ক্রমশ এই সরস্বতী আমার জীবনে নিরাকার হয়ে উঠেছে। একবার দিল্লিতে গিয়ে এক বন্ধুর মারফত একটি স্তোত্র পাই— ‘জয় জয় হে ভগবতী সুর ভারতী।’ সেই কথায় আমি সুর দিই, গানটি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ওই গানের একটি পঙ্ক্তি আমাকে ভীষণ ভাবে আকর্ষণ করেছিল। গানের শেষে একটি পঙ্ক্তি ছিল— ‘মতিরাস্তাং নো তব পদকমলে, অয়ি কুণ্ঠাবিষহারিণী।’ এই কথাটি আমাকে বিশেষ ভাবে ভাবিয়েছিল। জীবনে যে কোনও সংশয় দূর করার জন্য সরস্বতী রয়েছেন। সরস্বতী সাদা। সরস্বতী বলতে তাই বুঝি সত্য ও সোজা পথ, যেখানে কোনও সংশয় থাকবে না।
কী ভাবে সত্য খুঁজে নিতে হয়, সরস্বতীর বাহন হাঁসও তা জানে। জলমেশানো দুধের থেকে দুধ কী ভাবে আলাদা করতে হয় সে জানে। অর্থাৎ, ভেজালটা বাদ দিয়ে সত্যটাকে বেছে নিতে জানে সে। সংশয় থাকলে সরস্বতীর সাধনা সম্ভব নয়। আত্মবিশ্বাস দরকার, সোজা পথ দরকার।
আর একটা বিষয় আমাকে খুব ভাবিয়েছে। সমস্ত দেবদেবীর পুজো একটা সময়ে পর পর হয়। কিন্তু সরস্বতীপুজোর সময়কালটাও সকলের চেয়ে আলাদা। মজা করেই বলতাম, হয়তো সরস্বতীকে পরিবার থেকে আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সত্যিই তো, সরস্বতী খুব একা। ওঁর কোনও পরিবার নেই। তিনি একাকিনী, বীণা বাজানোই তাঁর সাধনা। এত বছরের জীবনে বুঝেছি, সরস্বতীর মতো সৎ ও সহজ থাকা খুব কঠিন।
মা দুর্গা অসুর বধ করেন। সেটাকে তো আমরা ‘হত্যা’ বলি না। কারণ, এই বধের পিছনে রয়েছে সৎ উদ্দেশ্য। দুর্গা তাই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ত্রিশূল বিঁধিয়ে দেন অসুরের বুকে। এই আত্মবিশ্বাস আসে সরস্বতীর থেকেই। এই ভাবেই এখন আমার কাছে সরস্বতী নিরাকার। রোজকার জীবনে যখন পিয়ানো বাজাই, তখন আমি সরস্বতীর মুখ এমনিই দেখতে পাই। ওঁর দেওয়া আত্মবিশ্বাসেই আমি বাকি অনুষ্ঠানটা করে নিতে পারি। এককথায় বলতে হলে— সরস্বতীপ্রতিমা সাকার। পিয়ানো যখন বাজছে, তখন সেটা আকার। আর গান হয়ে উঠলে, সেটা তখন নিরাকার।
একটা প্রচলিত কথা রয়েছে— ‘রূপে লক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী’। আসলে মানুষ বহিরঙ্গটা দেখতেই পছন্দ করে। মার্কণ্ডেয় পুরাণ ঘাঁটলে দেখা যায়, চণ্ডী আসলে কালী, সরস্বতী ও লক্ষ্মীর মিলিত রূপ। এঁদের মধ্যে কোনও তফাত নেই। এঁরা সকলেই আলো। আলোর তো আলাদা কোনও রূপগুণ নেই।
আরও পড়ুন:
আরও একটা অদ্ভুত বিষয় রয়েছে। মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য আজও কত লড়াই করতে হয়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায়, রানি রাসমণির কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। অথচ আমাদের ধর্মে বিদ্যার মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের জন্য পূজিত হন একজন দেবী। আবার ধনসম্পদের বিষয়ের দেবী লক্ষ্মী।
সব শেষে রবীন্দ্রনাথের কথাতেই ফিরতে হয়। তিনি তো সরাসরি সরস্বতীকে নিয়ে লিখেছেন ‘অয়ি বাণী বীণাপাণি, করুণাময়ী’। তবে তা ছাড়াও আরও বেশ কিছু গান রয়েছে, যেগুলি আমাদের সরস্বতীর কথাই মনে করিয়ে দেয়, যেমন— ‘মধুর ধ্বনি বাজে, হৃদয় কমল বনমাঝে’, ‘কমলবনের মধুপরাজি’।