Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

অন্তর্ধানের পিছল পথে

পাঠ্যবই বলে, ১৯৪৫ সালের ১৮ অগস্ট তাইহোকুতে (এখন তাইপেই) বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মৃত্যু হয়।

‘গুমনামী’ সিনেমার দৃশ্য

‘গুমনামী’ সিনেমার দৃশ্য

সোমেশ ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০১৯ ০০:০৪
Share: Save:

‘মিস্ট্রি’ অব দ্য সেঞ্চুরি!

মিস্ট্রির সাধনাতেই আপাতত মত্ত রহস্যে-রোমাঞ্চে ভরা বাংলা ইন্ডাস্ট্রি। অন্য কিছু চলার জো নেই। ফলে কেউ যদি গত পুজোয় ভাওয়াল সন্ন্যাসীর মিস্ট্রি সল্ভ করে এসে এই পুজোয় নেতাজির অন্তর্ধান নিয়ে পড়েন, অবাক হওয়ার কিছু নেই। বঙ্গজীবনে সবচেয়ে বড় দুই রহস্য বলে কথা!

পাঠ্যবই বলে, ১৯৪৫ সালের ১৮ অগস্ট তাইহোকুতে (এখন তাইপেই) বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মৃত্যু হয়। ‘নেতাজি রিসার্চ বুরো’ এবং তার কর্ণধারেরা— নেতাজির ভ্রাতুষ্পুত্র-বধূ কৃষ্ণা বসু ও তাঁর পুত্র ইতিহাসবিদ সুগত বসুও মনে করেন, এর মধ্যে কোনও রহস্যই নেই।

কিন্তু তা বললে চলবে কেন? রহস্য তো চাই! আর রহস্য যদি না-ই থাকে, তা হলে নেতাজি সংক্রান্ত ফাইল নিয়ে নয়াদিল্লির কর্তাদের এত লুকোছাপা কেন, কেনই বা ষাটের দশক পর্যন্ত তাঁর পরিবারের সদস্যদের উপরে গোয়েন্দা নজরদারি— এ প্রশ্ন তোলার লোকেরও অভাব নেই। তাই গুমনামী বাবা থেকে স্টালিন-যুগে সাইবেরিয়ার বন্দিশিবির গুলাগ— বহু বার নানা জায়গায় নেতাজির ছায়ার উঁকিঝুঁকি!

‘গুমনামী’ ছবির পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায় সেই ছায়াবাজিতেই ভর করেছেন। ভর করতে গেলে পোক্ত খুঁটি লাগে। এ ছবির আসল খুঁটি, দিল্লি-নিবাসী প্রাক্তন সাংবাদিক অনুজ ধর, পরে তাঁর সঙ্গী চন্দ্রচূড় ঘোষ ও তাঁদের ‘মিশন নেতাজি’ সংস্থার গবেষণা। তাঁদের দাবি, সে দিন আদৌ কোনও বিমান দুর্ঘটনাই হয়নি। ফলে তাতে সুভাষের মৃত্যুর প্রশ্নও ওঠে না। তার সপক্ষে বিস্তর তথ্যপ্রমাণও তাঁরা জোগাড় করেছেন।

রহস্যগল্পের রস নিহিত থাকে তার নিক্তিমাপা প্লটের জটে। আবেগ নয়, বরং চুলচেরা তথ্য ও বুদ্ধিদীপ্ত তত্ত্বের আঁকিবুঁকিই তাকে চুম্বক করে তোলে। স্রষ্টা যদি সেই অবজেক্টিভিটি ছেড়ে এক দিকে হেলে পড়েন, তাতে কী দাঁড়ায়, তার নজির ছবিতে থরে-বিথরে ছড়ানো। গোড়া থেকেই ভক্তিরসের উথালপাথাল। দু’একটা ছোট ঝিলিক বাদ দিলে ছবির বেশির ভাগ সংলাপই স্থূল।

‘নেতাজি বলতে তুই কী বুঝিস?’ এই প্রশ্নের উত্তরে যিনি লিখতে পারেন, ‘একটা ছুটির দিন, ল্যাদ, স্টার মুভিজ়...’ ইত্যাদি, তিনিই কী ভাবে একই চরিত্রদের মুখে ন্যাকা সব সংলাপ লেখেন, তিনিই জানেন, আর জানেন নেতাজি! তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কিছু পার্শ্বচরিত্রের কাষ্ঠ অভিনয়। মহাজাতি সদনে তদন্ত কমিশনের দীর্ঘ দৃশ্য একটা বড় সুতো, যা এই ছবিকে বেঁধে রেখেছে। কিন্তু এ ধরনের কোর্টরুম সিকোয়েন্সে কার্যত যে বাঁধুনি লাগে, তা যেন আলগা কোথাও কোথাও।

ছবির নিজের ভাষা থাকে তার দৃশ্যশব্দের মায়ায়। সেই অস্থির যুদ্ধের সময়টাকে ধরতে অনেক কিছু করেছেন সৃজিত এবং তাঁর চিত্রগ্রাহক সৌমিক হালদার। বেশ কিছু দৃষ্টিনন্দন শট, হ্যান্ড হেল্ড, ড্রোন— প্রায় কিছুই বাকি রাখেননি সৌমিক। কিন্তু যে সব ট্রিটমেন্ট রঙের রকমফেরে হয়ে উঠতে পারত জীবন্ত, অতীতের গন্ধ মাখতে গিয়ে তা নিছকই সাদা-কালো ক্লিশেতে আশ্রয় নেয়। তবে তার দায় অবশ্য চিত্রগ্রাহকের নয়।

নেতাজি চরিত্রে অভিনয় করতে পারার সুযোগ যে কোনও অভিনেতার কাছে বড় প্রাপ্তি, আবার চ্যালেঞ্জও। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় কাজটি আদৌ মন্দ করেননি। ক’বার অযথা দুপদুপ করে হাঁটা ছাড়া নিয়ন্ত্রিত তাঁর অভিনয়। কঠিন একটা মেকআপ নিয়ে কাজটা সহজ নয় মোটেই। কিন্তু সোমনাথ কুণ্ডুর করা সেই মেকআপ তেমন তাল মেলাল কই? নাকটা চমৎকার। কিন্তু কুঞ্চনহীন চকচকে কপাল আর পিছন ঘুরলে সিন্থেটিক টাক যদি এ যুগেও চোখে এসে খোঁচা দেয়, সেটা কষ্টের বইকি।

অনির্বাণ ভট্টাচার্য দক্ষ অভিনেতা হিসেবে ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত। তাই তাঁর কাছে প্রত্যাশাও থাকে বেশি। কিন্তু কেন যে মাঝে-মাঝেই তিনি খানিক অতি-অভিনয়ে ছটফটিয়ে উঠলেন, বোঝা দুষ্কর। তা কি চিত্রনাট্যের ফাঁক বা সংলাপের খাপছাড়া ভাবের কারণেই? বরং ছোট্ট পরিসরে ভাল লাগে তনুশ্রী চক্রবর্তীর স্বতঃস্ফূর্ততা। আর ভাল লাগে সোনু নিগমের গলায় ‘সুভাষজি’ গানটিও। বড় কৃতিত্ব অবশ্যই সুরকার ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তের। তবে পতাকার নীচে দাঁড়িয়ে ওই ‘জয় হে জয় হে’ গানটি নেতাজি না ধরলেই রক্ষে হত। জাতীয় সঙ্গীতের সুরে কোনও কিছু শুনলেই যে হলসুদ্ধ দর্শক ধড়মড়িয়ে পর্দা আড়াল করে দাঁড়িয়ে ওঠেন!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE