দেখতে দেখতে আমার পুজোর ২২ বছর! সময় যে কোথা দিয়ে কেটে গেল। আমার পুজোর হাতেখড়ি রানি মুখোপাধ্যায়ের বাড়ির পুজো দিয়ে। অনেকগুলো বছর শশধর মুখোপাধ্যায়ের বাড়ির পুজোর আমি সহ-সভাপতি। একবার আমার মেয়ে সম্ভবী খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তখন আমার স্ত্রী ইরা চট্টোপাধ্যায়, মা দুর্গার কাছে মানত করেছিলেন, মেয়েকে সুস্থ করে দিলে পুজো করবেন। সেই আমার নিজের পুজো শুরু।
মু্ম্বইয়ে জুহু স্কিমে প্রথমে আমাদের ছোট্ট পুজো শুরু। আমি, ইরা আর সম্ভবী— তিন জনের দেবী আরাধনা। মায়ের আশীর্বাদে সেই পুজোই ক্রমে সর্বজনীন! আমার স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এই পুজোর দায়িত্ব নেয়। খুব বড় বড় তারকা নিজে থেকে আমার পুজোয় যোগ দেন। যেমন, রোশন পরিবার। রাজেশ রোশন, রাকেশ রোশন, হৃতিক রোশন এবং ওঁদের পুরো পরিবার প্রথম বছরের পুজো থেকেই আমাদের পাশে। রাজেশ আর রাকেশের মা ইরা রোশন বাঙালি। আমরা পুজো শুরু করতেই দেখি, উনি চুপ করে এসে বসে পুজো দেখছেন। কোথায়, কী প্রয়োজন— নিজে থেকে বলছেন। খুব ভাল লেগেছিল ওঁর এই আচরণ।
সেই শুরু। প্রতি বছর রোশনরা আমাদের পুজোর অন্যতম সদস্য। রাকেশ আমাদের পুজোয় সঙ্কল্প করে ‘কহো না পেয়ার হ্যায়’-এর শুটিং শুরু করেছিল। সে ছবির সাফল্যের কথা সকলের জানা। তার পর থেকে হৃতিককে আর পিছনে ফিরে দেখতে হয়নি। ওঁদের তাই অন্ধবিশ্বাস আমাদের দেবীর উপরে। রাজেশের স্ত্রী দেবীর কাপড়, গয়না দেন। এক বছর ‘কাইট’ ছবির শুটিং করেছিলেন বাইরে। সে বছর রাজেশ, রাকেশ, হৃতিক আসতে পারেননি। সে কী আফসোস তাঁদের! বারে বারে ফোন করে জানাচ্ছেন, ওঁদের খুব মনখারাপ। মিস্ করছেন আমাদের পুজো। শুধু ওই এক বছর ওঁরা পুজোয় অনুপস্থিত।
বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের পুজোয় সপরিবার রাকেশ রোশন। ছবি: সংগৃহীত।
আমার পুজোর ভোগ খাওয়ার জন্য ওঁদের আগ্রহ দেখলে আপনারা অবাক হয়ে যাবেন।
আসলে আমাদের ভোগেও বৈচিত্র আনার চেষ্টা করি। খিচুড়ি, লাবড়া, সব্জির পোলাও, আলুর দম, বেগুনি, পাঁপড়, চাটনি— এ সব ভোগে থাকে। চাটনিতেও কত বৈচিত্র! কোনও দিন টম্যাটো তো কোনও দিন আম। এই ভোগ কিন্তু আমার মুসলিম ভাই-বোনেরাও খান। আমি জাতি বা ধর্মভেদ মানি না। আমার দুর্গা মা-ও চান, ওঁর পুজোয় যেন সর্বধর্মসমন্বয় ঘটে। অনেকেই হয়তো জানেন না, আগেকার গ্রামের পুজোয় সব ধর্মের মানুষ এক হয়ে দেবীর আরাধনা করতেন। আমি এই ধারা ধরে রাখার চেষ্টা করেছি।
প্রতি বছর কলকাতা থেকে ঠাকুর এসে মায়ের ভোগ রান্না করেন। ঢাকিও আসেন শহর থেকে। আমার শহর থেকে মৃৎশিল্পী অমিত পাল আসেন। সঙ্গে করে আনেন কলকাতার মাটি। সেই মাটি দিয়ে আমার দেবী প্রতিমা তৈরির দায় তাঁর। একচালার, ডাকের সাজের বড় প্রতিমা গড়ে দেন প্রতি বছর। এ বছর যেমন দেবী উচ্চতায় ১২ফুট! আমার পুজো ছাড়াও গায়ক অভিজিৎ ভট্টাচার্য, রানি মুখোপাধ্যায়দের পুজোর মূর্তি গড়েন অমিত।
কে আসেননি আমার পুজোয়। আগে তো আরও বড় করে পুজো করতাম। ২০১৯ পর্যন্ত জুহু স্কিমে বড় মাঠে পুজো হত। দেবীর সেই সময়ের উচ্চতা সাড়ে ১৫ ফুট। ৪০ জন লোক দেবীকে বয়ে আনতেন, আবার বিসর্জন দিতে নিয়ে যেতেন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত হাজার হাজার দর্শনার্থী! অভিষেক ছাড়া বচ্চন পরিবারের সকলে এসেছেন আমার পুজোয়। বিদ্যা বালন, জ্যাকি শ্রফ, অনুপম খের, কুমার শানু, অভিজিৎ ভট্টাচার্য— মুম্বইয়ের তাবড় তারকা আমার পুজোয়! পুজোয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন থাকে। নৃত্যশিল্পী সুধা চন্দ্রন নিজের ইচ্ছায় আমার পুজোয় অনুষ্ঠান করে গিয়েছেন। গত বছর যেমন এসেছিলেন বিরজু মহারাজের ছাত্রীরা। কয়েক বছর ধরে পুজোয় খ্যাতনামীদের সম্মানিতও করছি। যেমন, এ বছর ইচ্ছে আছে উত্তমকুমারকে মরণোত্তর সম্মান দেব। গত বছর মহম্মদ রফিকে দিয়েছিলাম। ওঁর ১০০ বছর উপলক্ষে।
পুজোয় খ্যাতনামীদের সম্মানিতও করেন বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
তার মধ্যেও কি ওঠাপড়া ছিল না? দেখুন না, ২০২০-তে আচমকা অতিমারি। বিশ্ব স্তব্ধ। আমার পুজো কিন্তু বন্ধ হয়নি! ইরা বলেছিল, প্রাণ থাকতে আমাদের পুজো বন্ধ হবে না। প্রতিমা তৈরি হয়নি। কিন্তু সাড়ম্বরে ঘটপুজো করেছি। পরের বছরেই আবার ছোট করে প্রতিমাপুজো। ধীরে ধীরে দেবী নিজের শক্তিতে আবার আগের উচ্চতায়। এ বছর যদিও ওই বড় মাঠটা পাইনি। বদলে পুজো হবে জুহু স্কিমের মিলেনিয়াম ক্লাবে। পুজো সর্বজনীন। নিয়ম-নিষ্ঠায় কোনও ফাঁক নেই। বোধন থেকে বিসর্জন— সবটাই নিখুঁত ভাবে পালন করে জুহু স্কিম সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটি। এই সংস্থার নামে প্রথম বছর থেকে সঙ্কল্প হয়। তত্ত্বাবধানে আমি।
প্রত্যেক দিন নিজে দাঁড়িয়ে সব কাজ করাই।
কাছের মানুষেরা জানতে চান, এই বয়সেও এত পরিশ্রম করি কী করে? আমি বলি, সবটাই মায়ের ইচ্ছে। উনি করিয়ে নেন। যদিও উপোস একটা দিন করি। অষ্টমীতে, ধুতি-পাঞ্জাবি পরে বাড়ির সকলকে নিয়ে অঞ্জলি দেব। আগে তো প্রত্যেক দিন রকমারি ধুতি-পাঞ্জাবিতে সাজতাম। তখন বয়সটাও কম ছিল।
এই দেখুন, কথায় কথায় পুরনো দিনের কথা চোখের সামনে ভিড় জমাল। তখন মুম্বইয়ে নতুন। প্রযোজক-পরিচালকদের আগাম বলে রাখতাম, পুজোর আগে সব কাজ শেষ করে ফেলুন। পুজোয় কিছুতেই এখানে থাকব না। কলকাতায় একবার গঙ্গার ঘাটে ভাসান দেখতে গিয়েছি। লোকে চিনতে পেরে ঘিরে ধরল আমায়। তাদের ভিড়ে, গরমে ঘেমেনেয়ে প্রায় দমবন্ধ হওয়ার অবস্থা। সে দিন উপস্থিত পুলিশকর্তারা আমায় বাঁচিয়েছিলেন।
আর একটা মজার গল্প বলি। তখনও আমি পর্দার নায়ক নই। মঞ্চে অভিনয় করছি। একবার দশমীতে বন্ধুদের সঙ্গে সিদ্ধি খেয়েছি। তার পর ভরপেট মিষ্টি। ব্যস, নেশায় চুর। হাসছি তো হাসছিই! আবার কান্না শুরু হলে থামছেই না। কী বিপদে পড়েছিলাম! ঘোর কাটতে তিন দিন লেগেছিল। কম বয়সে কত কিছু করেছি!
বাবা বিশ্বজিতের পুজোয় ছেলে প্রসেনজিৎ ঢাক বাজাচ্ছেন। ছবি: সংগৃহীত।
বয়স বেড়েছে। নিজেকে সংযত করেছি। কত দায়িত্ব! পুজোয় কত আমন্ত্রিত আসেন। ছেলে, বৌমা— ওরাও যে বছর পারে আসে। বুম্বা, মানে আপনাদের প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় একবছর ওর একটা পুজোর ছবির মুক্তি ঘটিয়েছিল এখানে। সে বার অর্পিতা, নাতি মিশুককে (তৃষাণজিৎ) নিয়ে এসেছিল। ওকে ছাড়াও অর্পিতা এসেছে পুজোয়। ভোগ খেয়ে গিয়েছে। পরিবেশন করেছে নিজের হাতে। খুব লক্ষ্মী মেয়ে। বুম্বারও দোষ নেই। প্রত্যেক পুজোর ওর ছবি মুক্তি পায়। বেচারা প্রচার করবে না আমার পুজোয় আসবে?
এত আনন্দ, এত আয়োজন, নবমীর রাত পোহালেই শেষ! ওই দিনটা এলেই মনখারাপ। এক বছর সারা দিন পরিশ্রম করে মায়ের পায়ের কাছে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম!
ঘুম ভাঙল কাকের ডাকে। দেখি আকাশ রাঙা হচ্ছে। দেবীর দিকে তাকিয়ে দেখি, তিনি যেন একদৃষ্টে আমায় দেখছেন। মাকে দেখতে দেখতে বুকের মধ্যে বিদায়ের সুর, নবমী নিশি যে ভোর হয়ে গেল! আমার উমা এ বার আমায় ছেড়ে নিজের বাড়ি ফিরবে।