লিভারপুলের এক ভোরের কথা। এমন ভোর তো প্রতিদিনই আসে। কিন্তু সেই ভোর এবং আরও অনেক ভোরের প্রথম আলোর রোম্যান্টিকতা মিশে গিয়েছিল আর এক ভালবাসার অপরূপ কাব্যে।
২০০৮। মান্নাদা ইংল্যান্ডে এসেছেন অনুষ্ঠান করতে। লন্ডন ও লিভারপুলে গাইবেন কয়েকটা অনুষ্ঠানে। ইচ্ছে ছিল হোটেলে থাকবেন। কিন্তু রজতশুভ্রর অনুরোধ কিছুতেই ফেলতে পারলেন না। রজত থাকে লিভারপুল থেকে মিনিট দশেকের দূরত্বে। পেশায় ডাক্তার। অনেক দিন ধরে ইংল্যান্ডে সেটেলড। চমৎকার গান করে। তবলা শিখেছে রাধাকান্ত নন্দীর কাছে। রজতের অনুরোধ। মান্নাদার পাল্টা যুক্তি—‘‘আরে বাবা! বুঝছ না কেন, প্রফেশনাল শিল্পীদের হোটেলে থাকলেই সুবিধে হয়।’’ শেষ পর্যন্ত মান্নাদা রাজি হলেন রজতের ওখানে গিয়ে থাকতে। সঙ্গে ম্যাডাম সুলোচনা দেবী। —‘‘এত করে বলছে, আর না করতে পারলাম না।’’
রজতের স্ত্রী সুস্মিতা সেদিন একটু ভোর-ভোর উঠেছে। বাড়িতে এমন ভিআইপি অতিথি। হঠাৎ চোখে পড়ল বারান্দায় বসে আছেন ম্যাডাম। ‘‘আন্টি! এত সকালে উঠে পড়েছেন ঘুম থেকে? রাতে ঘুম হয়নি?’’ ম্যাডাম মিষ্টি হেসে বললেন, ‘‘না, না, খুব ভাল ঘুম হয়েছে।’’ সুস্মিতার নজর গেল ম্যাডাম হাত দিয়ে কী যেন একটা করছেন। প্রথমে তো হেসেই উড়িয়ে দিলেন ম্যাডাম—‘‘না, না, ও কিছু না।’’ তারপর একটু চাপাচাপিতে বললেন, ‘‘আগের দিনের নেলপালিশটা তুলছিলাম নখে নতুন রং লাগাব বলে। ও যাতে ঘুম থেকে উঠে দেখতে পায়। জানো তো! এসব ও খুব পছন্দ করে।’’
একটি ছোট্ট ঘটনা। বিস্তারিত ব্যাখ্যা করতে বসলে এর মাধুর্যটুকু হারিয়ে যাবে। তবু এমন ভালবাসায় শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। আর সেই পুরোনো কথাটা নতুন করে মনে পড়ে যায়—একজন পুরুষের সাফল্যের নেপথ্যে নারীর ভূমিকা অনস্বীকার্য।
আর একদিনের ঘটনাও না বলে পারছি না। মান্নাদার বহু অনুষ্ঠানের ছবি ভিডিয়ো রয়েছে রজতের সংগ্রহে। রজত নিজেই এগুলো সংগ্রহ করত। যেমন, মান্নাদা গাইছেন, সঙ্গে রাধাবাবুর সঙ্গত-এর ভিডিয়ো। রেকর্ডের গানের সঙ্গে অনুষ্ঠানের গানের একটু পার্থক্য তো থাকবেই। রেকর্ডিঙের সময় অনেক টেকনোলজিক্যাল বাধা-নিষেধ থাকে। কিন্তু অনুষ্ঠানে অনেক মন খুলে গাওয়া যায়, বাজানো যায়। যখন দু’জনে একটু ফ্রি থাকতেন, রজত চালিয়ে দিত মান্নাদার বিভিন্ন অনুষ্ঠানের গান। যার অধিকাংশই ম্যাডাম আগে শোনেননি। দু’জনেই গান শুনছেন ও ভিডিয়ো দেখছেন। হঠাৎ ম্যাডাম বলে উঠলেন, ‘‘ইউ সিং সো ওয়েল! রিয়েলি ইট ইজ গিফট অব গড।’’ ম্যাডামের চোখে তখন জল। গভীর আবেগে মান্নাদার হাতটা চেপে ধরলেন। মান্নাদার ‘মান্না দে’ হয়ে ওঠার জন্য এই আবেগের কতখানি ভূমিকা ছিল, তা আজ ইতিহাস। শুধু মান্নাদা মন দিয়ে গাইবেন বলে সেই ৫০-এর দশকে অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত স্ত্রী বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি এককথায় ছেড়ে দিয়েছিলেন, ভাবা যায়!
এই যে মান্নাদা ইংল্যান্ডে এসেছেন অনুষ্ঠান করতে, চলে যাওয়ার সময় সেই মানুষটার মহানতার পরিচয় পেলেন সবাই। ওখানে মান্নাদার প্রায় সমস্ত অনুষ্ঠান আয়োজন করত লন্ডনের পারভেজ চৌধুরী। বাংলাদেশের মানুষ ইনি। লিভারপুল এবং লন্ডনের এই অনুষ্ঠানগুলো কিন্তু একদম ব্যক্তিগত উদ্যোগে আয়োজন করেছিল রজতশুভ্র। অনুষ্ঠানগুলো হওয়ার কথা ছিল দু’বছর আগে। সব ব্যবস্থাও হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ মান্নাদার গলায় কী একটা সমস্যা হয়। তাই অনুষ্ঠান বাতিল করা ছাড়া অন্য কোনও উপায় ছিল না। মান্নাদার কানে গিয়েছিল এ জন্য রজতের কিছু আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। হল কী, এ বার রজত যখন মান্নাদাকে পারিশ্রমিক ও অন্য খরচ-খরচা দিতে গেল, মান্নাদা তা কিছুতেই নিতে চাইলেন না। বারবার বলেছেন—‘‘না, না, আমি শুনেছি আগের ক্যানসেল্ড প্রোগ্রামে তোমার অনেক লস হয়েছে। আমাকে কিছু দিতে হবে না। তোমরা আগে নিজেরা সামলে নাও।’’ রজত প্রাণপণে মান্নাদাকে বোঝাল, ‘‘তা কী করে হয়? আপনি প্লেনের টিকিটটাও নিজের টাকায় কিনেছেন। অনুষ্ঠানের সব টিকিট বিক্রি হয়েছে। বিশ্বাস করুন, আমাদের কোনও লোকসান হয়নি।’’
কারও কোনও অসুবিধা হয়নি, আগের বারের বাতিল অনুষ্ঠানের কী ভাবে ক্ষতিপূরণ হয়েছে, তা ছাড়া এটা মান্নাদার প্রাপ্য পারিশ্রমিক—সব কিছু মান্নাদাকে বুঝিয়ে বলা হল। কনভিনসড হওয়ার পরেই তিনি পারিশ্রমিক নিলেন। তাও কোথায়? বিলেতে।
মান্নাদার জীবনের এমন টুকরো টুকরো ঘটনা দেখে-শুনে অবাকই হতে হয়। অবাক হতে হয় গুণী কোনও মানুষের প্রতি মান্নাদার শ্রদ্ধাবোধ দেখে। সঙ্গীতরসিক মন্টু বন্দ্যোপাধ্যায়কে মানুষ চেনেন হারনোমিয়ামের শেষ কথা বলে। সেই একই পরিবারের আর এক গুণী হারমোনিয়াম বাদক দেবকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতায় রজতের বাড়ি এসেছেন মান্নাদা। শরীরটা তখন পুরো সুস্থ নয়। কিছু দিন আগে বাইপাস সার্জারি হয়েছে। গানবাজনার রেওয়াজ আপাতত বন্ধ। মান্নাদা এসেছেন শুনে দেখা করতে এলেন দেবকুমারবাবু। এ কথা-সে কথা, পুরোপুরি গানের আড্ডা চলছে। এর পরে একটু হারমোনিয়াম হবে না, তা কী হয়! দেবকুমারবাবু হারমোনিয়ামে ধরলেন ‘রাগ হেমন্ত’। মান্নাদা মুগ্ধ হয়ে শুনছেন। এক সময় জিগ্যেস করলেন, ‘‘এই অস্থায়ী আপনি কোথায় পেলেন?’’ দেবকুমারবাবু খুব বিনীত ভাবে বললেন, ‘‘এই হেমন্ত রাগ আমাকে শিখিয়েছিলেন বাবা আলাউদ্দিন খান। ‘অস্থায়ী’টা দয়া করে শিখিয়েছেন। কী জানি কতটুকু গাইতে পারলাম! তা ছাড়া আপনার সামনে গাইতে গিয়ে....’’ কথাটা কেড়ে নিয়ে মান্নাদা বললেন, ‘‘ বেড়ে গেয়েছেন আপনি। কিন্তু মুশকিলে ফেলে দিলেন আমাকে। এখন আমার রেওয়াজ করাও বারণ। এই তো চেক আপ করে এলাম। গলা একদম বশে নেই। এই যে আপনারা অনুরোধ করছেন গাইবার জন্য, এমন হারমোনিয়াম শুনে আমারও যে গাইতে ইচ্ছে করছে না, তা নয়।’’
তার পরই ওই একই রাগাশ্রিত গান ‘তুম বিন জীবন’ গাইলেন মান্নাদা। গাইছেন মান্নাদা। কণ্ঠ একেবারে হাতজোড় করে ‘কণ্ঠে’ এসে বসল। গান শেষ হতেই দেবকুমারবাবু কুণ্ঠিত হয়ে বললেন, ‘‘আপনার গান শুনে মনে হচ্ছে কেন যে আপনার সামনে বাজাতে গেলাম!’’ মান্নাদা আরও বিব্রত হয়ে বললেন, ‘‘কী যে বলেন! কী আর গাইলাম আমি! আমি তো সামান্য গাইয়ে।’’
বিলেতের ওই প্রোগ্রামের কথা আবার একটু বলি। মান্নাদা শেষ জীবন পর্যন্ত নিজেকে অ্যাডজাস্ট করতেন। বলতে অসুবিধা নেই, অনেক গুণী শিল্পী সময়ের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারেননি। সময় কিন্তু থেমে থাকেনি, কণ্ঠ থেমে গেছে। মান্নাদার সঙ্গে শুধু ম্যাডাম বিলেত গিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে সেট মিউজিশিয়ানরা যাননি। যাঁরা মান্নাদার সঙ্গে বাজান, যাঁদের সঙ্গে মান্নাদার একটা বোঝাপড়া তৈরি হয়ে আছে। একটা সীমিত বাজেটের ব্যাপার ছিল। মানুষটা যখন মান্নাদা, তখন কোনও সমস্যাই সমস্যা নয়। বিলেতে এই মহাদেশের নানা পেশার অনেক মানুষ সেটল করেছেন, যাদের অনেকের বাজনার হাতটাও খারাপ নয়। বোম্বের ‘কুটুন’কে যখন পাওয়া যাচ্ছে না, তখন হাহুতাশ করে তো লাভ নেই! মান্নাদার সঙ্গে পরামর্শ করে সেখানকার মিউজিশিয়ানদের একটা তালিকা তৈরি করা হল। তবলায় রজতের সঙ্গে ডাকা হল মহম্মদ কাসমকে। এক সময় বোম্বের নামকরা কি-বোর্ড প্লেয়ার সুনীল যাদব তখন ইংল্যান্ডে। মান্নাদা আসছেন শুনে নিজেই বলল, ‘‘ আমি বাজাব।’’ মান্নাদা গ্রিন সিগন্যাল দিলেন। প্যাড-পারকাসনে ওয়ালিয়া। আর ছিল সন্দীপ পোপোটকর। এদের অনেককেই মান্নাদা প্রথম দেখছেন। কুছ পরোয়া নেই। শুরু হল জোর কদমে রিহার্সাল। অনুষ্ঠানের আগে সবাইকে তাঁর গানের সঙ্গে এমন ভাবে তৈরি করে নিলেন যে অনুষ্ঠান শুনে দর্শকরা ভাবলেন এই মিউজিশিয়ানরা বোধহয় বহু দিন ধরে নাগাড়ে মান্নাদার সঙ্গে বাজাচ্ছেন।
বন্ধু মিউজিশিয়ানদের কাছ থেকে শোনা একটা মজার কথা বলি। অধিকাংশ অনুষ্ঠানের আগে মান্নাদা গান ধরে ধরে মিউজিশিয়ানদের সঙ্গে প্র্যাকটিস করতেন। ঠিক তার পরে যখন অনুষ্ঠানে গাইতেন, দেখা যেত প্র্যাকটিস করা একটা গানও মান্নাদা গাইলেন না। ‘গট আপ’টা কিন্তু ঠিক হয়েই যেত। একবার হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এক মিউজিশিয়ানকে জিগ্যেস করলেন, ‘‘কী! কাল মান্নাবাবু কত সময় গাইলেন?’’ মিউজিশিয়ানের উত্তর : ‘‘এই দু’ঘণ্টা।’’ হেমন্তবাবু বললেন, ‘‘চার ঘণ্টা বলো। আগের প্র্যাকটিসের দু’ঘণ্টা বাদ দিলে কেন?’’
একটা বিশেষ অনুষ্ঠানের কথা মনে পড়ে গেল। অসীমা মুখোপাধ্যায়ের গানের দল ‘দক্ষিণায়ন’। সত্তরের দশক। কলামন্দিরে তাদের উদ্যোগে অনুষ্ঠান। বোম্বেতে মান্নাদাকে অনুরোধ করা হল। তিনি গাইতে রাজি হলেন। অনুষ্ঠানের শিল্পী তালিকাটা দেখুন—মান্না-হেমন্ত-বসন্ত এবং উত্তমকুমার। উত্তমকুমার গাইছেন, ‘ছিন্ন পাতায় সাজাও তরণী’, ‘অশ্রুনদীর সুদূর পারে’। মুগ্ধ হয়ে শুনছেন হলভর্তি শ্রোতা এবং সঙ্গীতসম্রাটরা।
কালস্রোতে ভেসে যায় সব, এটা অতি সত্য— একদিন তার পূরণও হয়। বর্তমান সময় চলেছে সেই পূরণের দিকে তাকিয়ে, অস্থির অপেক্ষায়। শুধু দুঃখ হয় এই প্রজন্মের জন্য। ওরা দেখতেই পেল না কত কিছু...
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy