করোনাভাইরাসের চোখরাঙানিতে নাজেহাল বিশ্ববাসী। এখনও অনেকেই কোভিড সংক্রমিত হচ্ছেন, কিছু ক্ষেত্রে কোমর্বিডিটি থাকলে রোগীর মৃত্যুও হচ্ছে। অনেক সময়ে আবার করোনা নেগেটিভ হয়ে গেলেও অনেকেই কিছু সমস্যায় ভুগছেন। কারও শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হচ্ছে, কারও আবার আচমকাই বুক ধড়ফড় করছে। কখনও আবার কোনও কারণ ছাড়াই যেন গায়ে, গাঁটে, পায়ে ব্যথা বেড়ে যাচ্ছে। আর এমন ধরনের সমস্যা নিয়ে কথা বলতে গেলেই উঠে আসছে ‘লং কোভিড’-এর প্রসঙ্গ। কোভিড সেরে যাওয়ার পরেও শরীরে নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে, যার নেপথ্যে রয়েছে করোনাভাইরাসের ভূমিকা বলে মত চিকিৎসকদের।
চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার বলছেন, “লং কোভিড কোনও নির্দিষ্ট রোগ নয়। বরং বলা চলে, এটি হল অনেক ধরনের উপসর্গের সমষ্টি যা কোভিডে আক্রান্ত কোনও ব্যক্তির মধ্যে দেখা দিতে পারে। সাধারণত লং কোভিডের ক্ষেত্রে করোনায় সংক্রমিত হওয়ার তিন মাস থেকে দু’বছরের মধ্যে উপসর্গ দেখা দিতে শুরু করে। এই উপসর্গগুলি প্রকট হওয়ার কোনও নির্দিষ্ট ছক নেই। নেই কোনও নির্দিষ্ট ধরন। প্রত্যেক রোগীর ক্ষেত্রে তাই তা আলাদা ভাবে দেখা যাচ্ছে, যা সাধারণত মানুষের পক্ষে বেশ বিভ্রান্তিকর।”
উপসর্গ যেমন
নানা পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায় কোনও ব্যক্তি করোনা আক্রান্ত হয়েছেন কি না। কিন্তু লং কোভিড কোনও পরীক্ষায় ধরা পড়ে না। তাই যখন উপসর্গগুলি দেখা দেয়, সেগুলিকে চিহ্নিত করারও কোনও নির্দিষ্ট পরীক্ষা নেই। তখন চিকিৎসকেরা নানা পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে রোগের কারণ বার করেন।
কোভিড সেরে যাওয়ার পরেও অনেকের মধ্যে কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন শ্বাস গ্রহণের সমস্যা, অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ, স্বাদ-গন্ধ কমে যাওয়া, ব্রেন ফগিং বা স্বাভাবিক চিন্তাশক্তি কমে আসা, অনবরত কাশি, মাথা যন্ত্রণা, ঘুমের ব্যাঘাত, অবসাদ, উদ্বেগ, পেটের সমস্যা ইত্যাদি। অনেক সময়ে শরীরের নানা জায়গায় রক্ত জমাট বাঁধতে দেখা যায়।
কেন হয়?
পালমোনোলজিস্ট ডা. অনির্বাণ নিয়োগী এই প্রসঙ্গে বললেন, “সাধারণত ৩৫ থেকে ৪০ বছর বয়সিদের মধ্যে লং কোভিডের সম্ভাবনা বেশি থাকে। শ্বাসকষ্ট, বুকে সর্দি জমা, অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়া, বুকে ব্যথার মতো উপসর্গ দেখা যায়। সমস্যাগুলি থেকে যেতে পারে সারা জীবনের জন্য।” তবে তিনি এ-ও জানাচ্ছেন, এখনও পর্যন্ত লং কোভিড নির্ণয় করারমতো পরীক্ষা আসেনি। তাইকোন সমস্যার জন্য লং কোভিডদায়ী তা বুঝতে ভরসা করতে হয় প্রচলিত পদ্ধতি যেমন রক্তপরীক্ষা, ইসিজি, এমআরআই, সিটি স্ক্যানের উপরেই।
অস্থি বিশেষজ্ঞ ডা. সুদীপ্ত মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “করোনা সংক্রমণের জন্য এমনিতেই নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। কিন্তু লং কোভিডের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, যাঁরা মধুমেহ কিংবা স্থূলতায় ভুগছেন, তাঁদের ক্লান্তি ভাব যেন কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে। মায়েলজিয়া অর্থাৎ পেশিতে প্রচণ্ড ব্যথা, হাঁটু, পা, পিঠে ব্যথার মতো সমস্যাও কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। মহিলাদের মধ্যে অস্টিয়োপোরোসিসও বেড়ে গিয়েছে অন্তত ১৫ শতাংশ। অটোইমিউন আর্থ্রাইটিসের উপসর্গগুলিও বেড়ে যায় এ ক্ষেত্রে।”
চিকিৎসা কী
চিকিৎসকদের মতে, লং কোভিডের চিকিৎসায় সবচেয়ে জরুরি বিষয়টিই হল, সমস্যার মূলে যাওয়া। যেহেতু কোনও নির্দিষ্ট ছকে এই সমস্যাগুলি দেখা দেয় না, তাই আগে পরীক্ষা করে দেখতে হবে শরীরের কোথায় সমস্যা রয়েছে। উচ্চ রক্তচাপ, মধুমেহ, স্থূলতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা, নিয়মিত শারীরচর্চা করা কিছুটা সাহায্য করতে পারে। ছোট ছোট জায়গায় রক্তজমাট বাঁধলে ওষুধের সাহায্যে তা কাটিয়ে দেওয়াও সাহায্য করতে পারে। কাজে আসে স্বাদ-গন্ধ ফেরানোর জন্য নানা ধরনের ওষুধ। আর যদি উদ্বেগ বা অবসাদ গ্রাস করে তা হলে জরুরি মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া। তবে চিকিৎসকেরা এ-ও জানাচ্ছেন, যাঁরা সময়মতো করোনার টিকা নিয়েছেন, তাঁদের এ সমস্যা কম।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)