E-Paper

কোমরের ব্যথায় সহায় হতে পারে হিপ প্রতিস্থাপন

হিপ রিপ্লেসমেন্ট কি নিরাপদ? কখন করাবেন, কখন করানো যাবে না, খরচ কত, জেনে নিন।

সুনীতা কোলে

শেষ আপডেট: ০৭ জুন ২০২৫ ০৯:২৭

বয়স ৬৫ ছুঁইছুঁই। প্রাক্তন স্কুলশিক্ষক সত্যব্রত অবসরের পরে ঠিক করেছিলেন, প্রতি বছরই ঘুরতে যাবেন। তবে এখন বেড়াতে যাওয়া তো দূর, হাঁটতেও অসুবিধে হচ্ছে। বাঁ দিকের কোমর থেকে ব্যথাটা পায়ের দিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে। সিঁড়ি ভাঙা কষ্টকর হয়ে উঠছে, শৌচাগার ব্যবহারেও সমস্যা। চিকিৎসক জানিয়েছেন, ব্যথার কারণ হিপ জয়েন্ট ক্ষয়ে যাওয়া। দীর্ঘমেয়াদি সমাধান মিলবে একমাত্র হিপ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে।

এমন অভিজ্ঞতা বিরল নয়। হাঁটুর মতোই কোমরের জয়েন্ট, অর্থাৎ হিপ প্রতিস্থাপন বা রিপ্লেসমেন্ট এখন বিভিন্ন হাসপাতালে নিত্যদিনের অস্ত্রোপচার। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৌলতে এক সময়ে যা ছিল সাহসী সিদ্ধান্ত, এখন তা অনেকটাই ‘রুটিন’।

হিপ রিপ্লেসমেন্ট কী?

চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, মানবদেহের ‘হিপ জয়েন্ট’ বা কোমরের সন্ধিস্থলটি একটি বল ও সকেটের মতো গঠন। এই অংশে থাকা কার্টিলেজ বা তরুণাস্থি নষ্ট হয়ে গেলে বল ও সকেট পরস্পরের সঙ্গে ঘষা খেতে থাকে। তা থেকেই শুরু হয় ব্যথা-যন্ত্রণা। কমে যেতে থাকে চলাফেরার ক্ষমতা। তখনই চিকিৎসকেরা সম্পূর্ণ বা আংশিক হিপ প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

কেন নষ্ট হয় হিপ জয়েন্ট?

অস্থিচিকিৎসক সুদীপ্ত মুখোপাধ্যায় বলছেন, “হিপ জয়েন্ট নষ্ট হওয়ার পিছনে থাকতে পারে একাধিক কারণ। তার মধ্যে কোনও দুর্ঘটনা বা পড়ে গিয়ে আঘাত লাগা অন্যতম। এ ছাড়া, অস্টিয়োআর্থ্রাইটিস, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, সোরিয়াটিক আর্থ্রাইটিস বা গাউটি আর্থ্রাইটিসের কারণে এই জয়েন্ট নষ্ট হতে পারে। কারও ওজন বেশি হলে প্রাইমারি অস্টিয়োআর্থ্রাইটিসের জেরে হিপের ক্ষতি হয়। কিছু ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, হিপ জয়েন্টের বল অংশটিতে রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এর জেরে হিপের কার্যক্ষমতা চলে যায়। এ ছাড়া পুরনো বা নতুন কোনও সংক্রমণের জেরেও হতে পারে এই রোগ।

অনেক ক্ষেত্রে আঘাত লাগার পরেও কার্টিলেজ জোড়া লাগানো সম্ভব হয় বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। তা না হলে এই অস্থিসন্ধির কার্যকারিতা ফেরানোর উপায় হল প্রতিস্থাপন। বল ও সকেটের মধ্যে সকেট ঠিক থাকলে অনেক সময়ে শুধু সেই অংশটি প্রতিস্থাপন করা হয়। একেই আংশিক হিপ প্রতিস্থাপন বলে। সাধারণত, কারও বয়স কম হলে চিকিৎসকেরা এই পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

কী ভাবে হয় এই প্রতিস্থাপন?

চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, এই অস্ত্রোপচারে নষ্ট হয়ে যাওয়া বল এবং সকেটের অংশ কেটে বাদ দিয়ে, সেখানে ধাতব বা সেরামিক দিয়ে তৈরি কৃত্রিম জয়েন্ট বা প্রস্থেটিক বসানো হয়। এতে রোগী আবার হাঁটতে পারেন, ব্যথা কমে যায়, জীবনযাত্রার মান বাড়ে।

কারা করাবেন এই অস্ত্রোপচার?

ডা. মুখোপাধ্যায় বললেন, “প্রয়োজনে যে কোনও বয়সেই করানো যায় এই অস্ত্রোপচার। বিভিন্ন কারণে কমবয়সিদের করাতে হতে পারে, যেমন হিপ ফ্র্যাকচার বা জেনেটিক হিপ ডিসপ্ল্যাসিয়া হলে। এই দ্বিতীয় সমস্যাটি থাকলে হিপের গঠনগত ত্রুটি থাকে। সে ক্ষেত্রে ২৫-৩০ বছর বয়সেই অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়। আবার প্রবীণদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন কারণে করাতে হতে পারে। শারীরিক সমস্যা না থাকলে বয়স এই অস্ত্রোপচারের জন্য কোনও বাধা নয়। আশির বেশি বয়সেও সুষ্ঠু ভাবে হতে পারে হিপ প্রতিস্থাপন।” তিনি জানাচ্ছেন, এই অস্ত্রোপচারে হাঁটাচলার ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হয় অনেকটাই।

কারা করাবেন না?

এই অস্ত্রোপচার করানোর আগে বিশদ শারীরিক পরীক্ষা খুবই প্রয়োজনীয়। সব দিক খতিয়ে দেখে কোনও সমস্যা না থাকলে তবেই অস্ত্রোপচারের পথে হাঁটেন অস্থি চিকিৎসকেরা। দেখতে হয়, অস্ত্রোপচারের ধকল শারীরিক ও মানসিক ভাবে সহ্য করার ক্ষমতা রোগীর রয়েছে কি না। দেহে কোনও সংক্রমণ থাকলে তা সারানোর পরে তবেই অস্ত্রোপচার সম্ভব। এ ছাড়া দেখতে হয়, হৃদ্‌যন্ত্র, ফুসফুস, কিডনি ও লিভার সংক্রান্ত কোনও কোমর্বিডিটি রয়েছে কি না। এসব ক্ষেত্রে ব্যথা কমানোর ওষুধদিতে সমস্যা থাকে, কিন্তু অস্ত্রোপচারের পরে ব্যথা কমানোর ওষুধ আবশ্যক। অর্থাৎ হিপ প্রতিস্থাপনের সিদ্ধান্ত নিছক ব্যথার তীব্রতার ভিত্তিতে নয়, রোগীর সামগ্রিক স্বাস্থ্য ও মানসিক প্রস্তুতির উপরেও নির্ভর করে।

অস্ত্রোপচার পরবর্তী সাবধানতা

অস্ত্রোপচার নির্বিঘ্নে হলে ৪৮ ঘণ্টা পর থেকে ওয়াকার ব্যবহার করে রোগীকে হাঁটানো শুরু হয়। কোনও সমস্যা না থাকলে চার-পাঁচ দিনের মধ্যে বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দেন চিকিৎসকেরা। এর পরবর্তী পাঁচ-ছয় সপ্তাহে নজর থাকে প্রতিস্থাপিত অংশের নড়াচড়া স্বাভাবিক করার দিকে। এই সময়ে ফিজ়িয়োথেরাপির ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে পেশির শক্তিও বাড়ানো হয়। ডা. মুখোপাধ্যায় বললেন, “দেহের একটি অস্থিসন্ধি কেটে প্রকৃতিপ্রদত্ত নয়, এমন একটি জিনিস দেহে বসানো হচ্ছে। সেটি যাতে আড়ষ্ট হয়ে না থাকে, তার জন্যই ফিজ়িয়োথেরাপি প্রয়োজন। তার উপরেই নির্ভর করছে রোগী পরে কতটা স্বাভাবিক ভাবে নড়াচড়া করতে পারবেন।”

তিনি জানাচ্ছেন, অস্ত্রোপচারের পরে স্বাভাবিক হাঁটাচলা, সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামায় বাধা থাকে না। তবে মেঝেয় উবু হয়ে বা হাঁটু মুড়ে বসাযাবে না। শৌচাগারে কমোড ব্যবহার করাই শ্রেয়। বেশি দৌড়ঝাঁপ করাও যাবে না।

রোবোটিক অস্ত্রোপচার

এখন বহু অস্ত্রোপচারের মতোই হিপ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রেও রোবোটিক সার্জারি করা হচ্ছে। ডা. মুখোপাধ্যায় বললেন, “হিপ কেটে যে প্রস্থেটিক বা কৃত্রিম হিপ বসানো হয়, তার অ্যালাইনমেন্ট ঠিক রাখার জন্য নিখুঁত হিসাব করা জরুরি। রোবটের মাধ্যমে এই হিসাব করা হলে ভুলের আশঙ্কা অনেকটাই কমে। ফলে অস্ত্রোপচারের সামগ্রিক ঝুঁকি কমে ও সাফল্যেরহার বাড়ে।”

অস্ত্রোপচারের স্থায়িত্ব

চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, অস্ত্রোপচারের পরে ১২-১৫ বছর ঠিক থাকে হিপ। কারও কারও ক্ষেত্রে ২০ বছরও চলে। অল্প বয়সে কারও এই অস্ত্রোপচার হলে দ্বিতীয় বার প্রতিস্থাপন করাতে হতে পারে। প্রবীণদের ক্ষেত্রে সাধারণত দ্বিতীয় বার হিপ প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হয় না। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, হিপের ব্যথা মানেই প্রতিস্থাপন নয়, তবে প্রয়োজনে এটি আশীর্বাদ হতে পারে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Hip Replacements

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy