ব্যস্ত জীবনে অনেক সময়েই দিনের কোনও গুরুত্বপূর্ণ খাবার খাওয়া বাদ পড়ে যায়। দেখা যাবে, অনেকেই হয়তো প্রাতরাশ না করেই কাজে বেরিয়ে পড়েন। আবার অনেকে সারা দিনের কাজের চাপে নৈশভোজ করেন না। পরিস্থিতি কঠিন হলে প্রাতরাশ এবং নৈশাহারের মধ্যে কোন খাবারটি বাদ দেওয়া যেতে পারে, তা নিয়ে মতভেদ দেখা যায়।
আরও পড়ুন:
প্রাতরাশে না নয়
সাধারণত বলা হয়, রাত্রের খাবার না খেলেও, প্রাতরাশ কখনওই বাদ দেওয়া উচিত নয়। কারণ, রাতে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুমের পর শরীরকে চালনা করা জন্য শক্তির প্রয়োজন হয়। চিকিৎসক অমিতাভ ভট্টাচার্য জানালেন, রাতে ঘুমোনোর সময় দেহের সমস্ত বিপাকক্রিয়ার হার কমে যায়। তাঁর কথায়, ‘‘ঘুমের মধ্যে বিভিন্ন হরমোন এবং পাচকরসের ক্ষরণ ধীরে হতে থাকে। সকালে ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গেই তারা সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে তখন আমরা খিদে অনুভব করি।’’ ঘুম থেকে ওঠার পর তাই প্রাতরাশের আগে চা, কফি বা বিস্কুট খেয়ে ক্ষুধানিবৃত্তি করতে হয়। অমিতাভের কথায়, ‘‘রাতে বিশ্রামের জন্য আমাদের পরিপাকতন্ত্র কিছুটা বিশুদ্ধিকরণের সুযোগ পায়। তার পর তার প্রয়োজন একটা ভারী খাবারের।’’
প্রাতরাশ যে অবহেলা করা উচিত নয়, সে কখাই জানালেন পুষ্টিবিদ শম্পা চক্রবর্তীও। বললেন, ‘‘এ রকমও দেখছি, যেখানে অনেকে রাতের খাবার বাদ রাখার পরেও হয়তো প্রাতরাশ না করেই অফিসে চলে যাচ্ছেন।’’ প্রাতরাশ দিনের প্রথম খাবার। তাই এই খাবারকে এড়িয়ে চলা উচিত নয়। শম্পার কথায়, ‘‘প্রাতরাশ না করলে বেলা বাড়ার সঙ্গে শরীরে ক্লান্তি বাসা বাঁধে। কাজে একাগ্রতা কমে আসে। অল্প বয়সে এই ধরনের প্রবণতা শরীর সহ্য করে নেয়। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে নিয়মিত প্রাতরাশ না করলে শরীরে কোনও জটিল রোগ দেখা দিতে পারে।’’ প্রাতরাশ না করলে সময়ের সঙ্গে দেহে ক্যালশিয়ামের মাত্রা কমতে শুরু করে। পাশাপাশি, রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়তে শুরু করে।
প্রাতরাশ অবহেলা করা উচিত নয়। ছবি: সংগৃহীত।
প্রাতরাশ ভারী নয়
প্রাতরাশের ক্ষেত্রে বেশি দেরি করা উচিত নয় বলেই জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। অমিতাভ জানালেন, সকাল ১০টার মধ্যে প্রাতরাশ সেরে নিতে পারলে ভাল। কারণ আরও দেরি হলে, সে ক্ষেত্রে গ্যাসট্রিকের সমস্যা হতে পারে। অমিতাভ বললেন, ‘‘অনেকেই আবার প্রাতরাশ করেন বেলার দিকে। তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আবার মধ্যাহ্ণভোজন করেন। এর ফলে সময়ের অভাবে শরীরের উপর বাড়তি চাপ পড়ে।’’ প্রাতরাশ যদি সঠিক সময়ে করা যায়, সে ক্ষেত্রে দুপুরের খাওয়া বাদ দেওয়া যেতে পারে বলে জানালেন অমিতাভ। তবে তাঁর যুক্তি, ‘‘দুপুরে না খেলে সে দিন রাতে যেন আটটার মধ্যে খাবার খেয়ে নেওয়া হয়, সেটাও খেয়াল রাখতে হবে। অন্যথায় দুটো খাবারের মধ্যে দীর্ঘ ব্যবধান শরীরের ক্ষতি করতে পারে।’’
বাঙালি সমাজের একাংশে প্রাতরাশে পেট ভরে খাওয়ার চল রয়েছে। অনেকেই প্রাতরাশে ভাত খান। শম্পার কথায়, “কেউ খেলে ক্ষতি নেই। কিন্তু প্রাতরাশে একটু হালকা অথচ পুষ্টিগুণে পরিপূর্ণ খাবার খাবার খাওয়া উচিত।’’ যেমন, প্রাতরাশে ভাতের পরিবর্তে ওটস্, চিঁড়ের পোলাও বা দোসা খাওয়া যেতে পারে। যাঁদের ওজন বেশি, তাঁরা চাইলে প্রাতরাশে কোনও স্যালাডের সঙ্গে একটি আধসেদ্ধ ডিম খেতে পারেন। শম্পা জানালেন, দইয়ের ঘোলে ছাতু বা ওটস্ মিশিয়ে নিয়ে খেতে পারলেও পেট অনেক ক্ষণ ভরা থাকে। অথচ, শরীরে বেশি মাত্রায় ক্যালোরি জমা হয় না।
নৈশভোজ গুরুত্বপূর্ণ
সারা দিন অল্প করে বার বার খাবার খাওয়ায় স্বভাব অনেকের মধ্যেই লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু সে ক্ষেত্রে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ বেশি থাকলে সুবিধা হয়। উদাহরণ হিসেবে অমিতাভ মাংস এবং গ্লুকোজ়ের উল্লেখ করলেন। তাঁর কথায়, ‘‘হঠাৎ কারও শরীর খারাপ হলে, তাঁকে যদি মুরগির মাংস এবং গ্লুকোজ খেতে দেওয়া হয়। দেখা যাবে মাংসের তুলনায় গ্লুকোজ় অনেক দ্রুত তাঁকে সুস্থ করে তুলল।’’ সারা দিনে শরীরে কার্বোহাইড্রেটের জোগান দিতে মুড়ি, চিঁড়ে, শসা বা অল্প পরিমাণে বিস্কুট খাওয়া যেতে পারে। অমিতাভের কথায়, ‘‘সারা দিন এ রকম অল্প পরিমাণে খাবার খেলেও রাতের খাবার খেতেই হবে।’’
শম্পা জানালেন, রাতের খাবার না খেলে অনেক সময় ঘুমের সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাঁর কথায়, ‘‘রাতের খাবার হবে সহজপাচ্য। অথচ সেখানে যেন জটিল কার্বোহাইড্রেট থাকে, সে দিকেও খেয়াল রাখতে হবে।’’ রাত্রে খাবার খেতে ইচ্ছে না করলে, হালকা খাবার খাওয়া যেতে পারে। কিন্তু কোনও ভাবেই পেট খালি রাখা উচিত নয়। শম্পার মতে, সে ক্ষেত্রে রাত্রে নিরামিষ খাওয়া যেতে পারে। ঘরোয়া খাবারের মধ্যে, রুটি এবং কোনও তরকারি খাওয়া যেতে পারে। শম্পার কথায়, ‘‘দুধ ভাল ঘুমোতে সাহায্য করে। তাই যাঁদের ল্যাক্টোজ়ে কোনও সমস্যা নেই, তাঁরা চাইলে রাতে অল্প পরিমাণে দুধ বা দুগ্ধজাত কোনও খাবার খেতেই পারেন।’’ যাঁরা ওজন কমাতে চাইছেন,তাঁরা রাতে কোনও স্যালাড বা স্যুপ খেতে পারেন।
রাত জেগে কাজ
অনেকেই রাত জেগে কাজ করেন। আর সেই সঙ্গে চলে স্ন্যাকিং। এর ফলে শরীরে ক্ষতি হয়। অমিতাভ জানালেন, দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকলে গ্যাসট্রিক আলসারের ঝুঁকি বাড়তে থাকে। শম্পা জানালেন, রাত জেগে কাজ করতে হলে খিদে পেলে ফল খাওয়া যেতে পারে। একই সঙ্গে ড্রাই ফ্রুটস বা দইয়ের ঘোল খেতে পারলে, তা শরীরকে চনমনে রাখতে সাহায্য করে। শম্পা জানালেন, ‘‘রাত জেগে কাজের ক্ষেত্রে চা, কফি এবং বিস্কুট বেশি না খাওয়ায়ই ভাল।’’
ছবি: সংগৃহীত।
নৈশভোজ কখন
রাতে খাওয়ার পরেই ঘুমোতে যাওয়া ঠিক নয়। অমিতাভ জানালেন, দুপুরে কেউ না খেলে রাতের খাবার ভারী হতে পারে। কিন্তিু খেয়াল রাখতে হবে, যেন রাত আটটার মধ্যে খাবার খেয়ে নেওয়া হয়। অমিতাভ বললেন, ‘‘সারা দিনে যদি খাওয়ার পরিমাণ বেশি হয়, সে ক্ষেত্রেও রাতের খাবার খাওয়া জরুরি। কিন্তু সেই খাবারকে হালকা হতে হবে। তা না হলে হজমের সমস্যা হতে পারে।’’ বয়স্কদের ক্ষেত্রে আরও বেশি সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। শম্পা জানালেন, রাতে খাবারের পরেই ঘুমোতে গেলে অনেকের বদহজম হতে পারে। তাই ঘুমোতে যাওয়ার অন্তত দু’ঘণ্টা আগে রাতের খাবার খেতে পারলে ভাল হয়। সন্ধ্যায় যদি কেউ বেশি পরিমাণে খাবার খেয়ে ফেলেন, সে ক্ষেত্রে রাতের খাবার বাদ রাখা যেতে পারে।
প্রাতরাশ বনাম নৈশভোজ
শরীরকে সঠিক ভাবে কর্মক্ষম রাখতে দিনের মধ্যে চারটি মূল খাবার খাওয়া উচিত। তার মধ্যে প্রাতরাশ এবং রাতের খাবার রয়েছে। অমিতাভ বললেন, ‘‘চিনা এবং জাপানিরা চার বেলা ভাত খান। আমরা আবার মূলত দুপুরে ভাত খাই। আসলে ক্যালোরির সঠিক ব্যবহার এবং খাদ্যাভ্যাসের উপরে সব কিছু নির্ভর করে। তাই বিষয়টাকে নির্দিষ্ট কোনও মানদণ্ডে মাপা সহজ নয়।” সম্ভব হলে প্রাতরাশ এবং রাতের খাবার— কোনওটাকেই বাদ দেওয়ার পক্ষে নন অমিতাভ।
শম্পার মতে, প্রাতরাশ বা রাতের খাবার,কোনওটাই বাদ দেওয়া উচিত নয়। ব্যক্তির শারীরিক পরিস্থিতির বিচারে যাঁর যতটা প্রয়োজন,তাঁকে ততটাই খাবার খেতে হবে। রাতের খাবার এবং প্রাতরাশ একযোগে বাদ দিলে ক্ষতির পরিমাণ অনেকটাই বেড়ে যায়। শম্পা বললেন, ‘‘সময় নেই বলে কেউ খাবার খাবেন না— সেটা অযৌক্তিক। শরীর কিন্তু ঠিকই তার শোধ তুলে নেয়।’’