ডায়াবিটিস এমন এক অসুখ, যা নিঃশব্দ ঘাতকের মতো। সতর্ক না হলেই, ধীরে ধীরে শরীরের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গগুলিকে অকেজো করে ফেলতে পারে। ক্লান্তি, দুর্বলতা এই রোগের অন্যতম উপসর্গ।
এক সময় যা বয়সকালের অসুখ বলে ধরা হত, এখন তা দেখা দিচ্ছে কম বয়সিদের মধ্যেও। পরিবারের কারও ডায়াবিটিস থাকলে, পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে এই অসুখের ঝুঁকি বেড়ে যায়, এমনটাই জানেন সকলে। তবে পূর্ব-ইতিহাস ছাড়াও ইদানীং তরুণ প্রজন্মের মধ্যে টাইপ ২ ডায়াবিটিস বাড়ছে। এ জন্য চিকিৎসকেরা দায়ী করছেন অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসকেই।
আরও পড়ুন:
ডায়াবিটিস এক বার হলে জীবন থেকে বাদ যেতে পারে পছন্দের খাওয়া। শরীরও ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে যায়। অসুখ হওয়ার পরে জীবনযাপনে রাশ টানার থেকে ভাল রোগ প্রতিরোধে উদ্যোগী হওয়া। কী ভাবে তা সম্ভব, বলছেন ডায়াবিটিসের চিকিৎসক অভিজ্ঞান মাঝি।
ডায়াবিটিস রোগ মূলত দু’ধরনের হয় টাইপ-১ ও টাইপ-২। টাইপ ১ ডায়াবিটিস মূলত জিনগত সমস্যা এবং নানা কারণে হয়ে থাকে। শরীরে ইনসুলিন কম মাত্রায় তৈরি হলে বা হরমোনটি তৈরি না হলে এই ধরনের ডায়াবিটিস হয়। টাইপ ১ ডায়াবিটিসকে অটোইমিউন রোগ বলা হয়। অগ্ন্যাশয়ে অবস্থিত ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাওয়ার ফলে যখন মানুষের শরীরে ইনসুলিন উৎপাদন একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়, সে অবস্থাকে টাইপ ১ ডায়াবেটিস বলা হয়। অন্য দিকে, টাইপ ২ ডায়াবিটিস অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বা ওজন সংক্রান্ত কারণে হওয়ার সম্ভবনা থাকে, যার লক্ষণ ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়। এই ধরনের অসুখে শরীরে ইনসুলিন তৈরি হলেও, হরমোনটি সঠিক ভাবে কাজ করতে পারে না। দুই ধরনের ডায়াবিটিসের উপসর্গে বিশেষ তফাত না থাকলেও, টাইপ-২ ডায়াবিটিসের লক্ষণগুলি ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়।
চিকিৎসক জানাচ্ছেন, প্রিডায়াবিটিস থেকে ডায়াবিটিস হয়। অর্থাৎ ডায়াবিটিস হওয়ার আগেও একটি পর্ব থাকে। কিন্তু প্রিডায়াবিটিস থেকে ডায়াবিটিস কখন, কী ভাবে হয়, তা সহজে টের পাওয়া যায় না। শরীরে ইনসুলিন হরমোন কাজ করা বন্ধ করে দেয় এবং রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়ে নিঃশব্দেই। তাই কারও রক্তপরীক্ষা করলে হঠাৎ করেই ডায়াবিটিস ধরা পড়তে পারে। ক্লান্তি, অবসন্ন বোধ, ঘন ঘন প্রস্রাব পাওয়া, ওজন কমে বা বেড়ে যাওয়া, বার বার মূত্রনালির সংক্রমণের মতো উপসর্গ প্রিডায়াবিটিসের লক্ষণ।
নয়ডার যাপন সহায়িকা এবং বিপাকীয় স্বাস্থ্য নিয়ে দীর্ঘ দিন কাজ করছেন দীপিকা রাম্পা। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলছেন, ‘‘টাইপ ২ ডায়াবিটিস এক দিনে হয় না। আগে থেকেই শরীরে ইনসুলিন রেজ়িস্ট্যান্স তৈরি হয়।’’ এ ক্ষেত্রে শরীরে ইনসুলিন হরমোন নিঃসৃত হলেও তা ঠিক ভাবে কাজ করে না। অগ্ন্যাশয় থেকে তৈরি হয় ইনসুলিন, যা শর্করাজাতীয় খাবার থেকে শক্তি তৈরিতে সাহায্য করে। শরীরে যদি সেই হরমোন ঠিক ভাবে কাজ না করে, তা হলেই শুরু হয় সমস্যা।
ইনসুলিন রেজ়িস্ট্যান্স তৈরি হলে, হরমোন ঠিক মতো কাজ না করলে তা শর্করা কাজে লাগিয়ে শক্তি তৈরির বদলে সঞ্চয় করতে থাকে। ফলে শরীর ফ্যাটের পরিমাণ বাড়তে থাকে। আবার ইনসুলিনের মাত্রা কম হলে, সেই ফ্যাট থেকেই শরীর শক্তি তৈরি করে। ফলে ওজন কমে। দীপিকার কথায়, সমস্যা হল উপসর্গগুলি এতটাই সাধারণ যে, কেউ আলাদা করে বুঝতে পারেন না। ক্লান্তি, দুর্বলতা অনেক সময় বেশি পরিশ্রমেও হয়। খাওয়া-দাওয়া ঠিক না হলেও হতে পারে। তাই সমস্যা চিহ্নিত হতেই দেরি হয়ে যায়।
ডায়াবিটিসের মতো অসুখ কী ভাবে এড়ানো যায়?
চিনি খেলে সুগার হয়, প্রচলিত ধারণা রয়েছে। অনেকেই বলেন, ‘‘চিনি খাব না, সুগার হবে।’’ চিকিৎসক বলছেন, চিনি খেলে ডায়াবিটিস হয় না বরং ডায়াবিটিস হলে চিনি খাওয়া বারণ হয়ে যায়। তবে স্বাস্থ্য ভাল রাখতে হলে, চিনি জাতীয় খাবার খাওয়া কমানো দরকার। একই সঙ্গে জরুরি শরীরচর্চা।
চিকিৎসকের পরামর্শ
· নিয়ম করে গায়ে রোদ লাগানো দরকার। খালি পায়ে হাঁটাহাটি করতে পারলে আরও ভাল।
· যন্ত্র, ওয়াইফাইয়ের ব্যবহার কমানো বা এই ধরনের বিকিরণ ক্ষেত্র থেকে দূরে থাকা।
· শরীরের ঘড়ি মেনে জীবনযাপন, সকালে ওঠা, রাতে ঘড়ি ধরে ঘুমিয়ে পড়া।
· স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, তালিকায় অবশ্যই ফাইবার জাতীয় খাবার থাকা দরকার।
· নৈশ আহার দ্রুত সারা।
· কার্বোহাইড্রেটে বা শর্করা জাতীয় খাবারের মাত্রা কমানো।
· নিয়মিত শরীরচর্চা করা।
দীপিকা জানাচ্ছেন, খাওয়ার খানিক পরে ১০ মিনিট পায়াচারি করাও অত্যন্ত ভাল অভ্যাস। তা ছাড়া ওজন নিয়ে শরীরচর্চা করলেও রক্তে শর্করার মাত্রা বশে থাকবে।