Advertisement
E-Paper

Democracy: দেশে ভাঙনতন্ত্র চলছে! সঙ্কটে অমর্ত্য সেনের ভরসা দেশের বিচার বিভাগ

নিজের নামাঙ্কিত ‘অমর্ত্য সেন রিসার্চ সেন্টার’-এর উদ্বোধন করলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ। সেখানেই তিনি দেশের গণতন্ত্র নিয়ে এই মন্তব্য করেন।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০১ জুলাই ২০২২ ০৫:২১
সল্টলেকে গবেষণা কেন্দ্রের উদ্বোধনে অমর্ত্য সেন।

সল্টলেকে গবেষণা কেন্দ্রের উদ্বোধনে অমর্ত্য সেন। নিজস্ব চিত্র

স্মৃতি হাতড়ে অন্নদাশঙ্কর রায়ের শিশুপাঠ্য ছড়ার কাছেই ‘হাত পাতলেন’ অমর্ত্য সেন।

‘তেলের শিশি ভাঙল বলে খুকুর পরে রাগ করো/ তোমরা যে সব ধেড়ে খোকা ভারত ভেঙে ভাগ করো’! বৃহস্পতিবার দুপুরে তাঁর নিজের নামাঙ্কিত ‘অমর্ত্য সেন রিসার্চ সেন্টার’-এর উদ্বোধনী বক্তৃতা শেষে তখন সবে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ। নিজের বক্তৃতার ব্যাখ্যার সূত্রেই বললেন, অন্নদাশঙ্করের ছড়ার এই ভাঙাভাঙি, ভাগাভাগি নিছক ভারত-পাকিস্তানের সীমারেখায় আটকে নেই। তাঁর কথায়, “জাতি হিসেবেই বিভক্ত করা হচ্ছে আমাদের।” এই সঙ্কটে দেশের বিচার বিভাগ একটি বিরাট অবলম্বন বলে তাঁর বিশ্বাসের কথাও বলেছেন অমর্ত্য।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বলেন, “এত বড় বিপদে বিচার বিভাগ হয়তো কিছু করতে পারবে।” অমর্ত্য তাঁর বক্তৃতায় বলেছেন, এ দেশে গণতন্ত্রের তিনটি স্তম্ভের মধ্যে ভারসাম্যের অভাব দেখা যাচ্ছে। আমলাদের আইনসভার সদস্যেরা নিয়ন্ত্রণ করছেন। যে কোনও মূল্যে ক্ষমতা দখলের জন্য তাঁরা ভোট-রাজনীতিতে মত্ত। এ সবই সমস্যার।

এ প্রসঙ্গে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য থাকাকালীন নিজের অভিজ্ঞতার কথাও তুলেছেন অমর্ত্য। বলেছেন, “এক সময়ে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে যুক্ত হয়েছিলাম। ২০১৪ সালের ভোটে পট পরিবর্তনের পরে পরিস্থিতি পাল্টে গেল। শিক্ষা ব্যবস্থা শুধু হিন্দুত্বের ধারা মেনে চলতে পারে না।”

কোভিডের জেরে তৈরি হওয়া আর্থ-সামাজিক সঙ্কট নিয়ে প্রতীচী ইন্ডিয়া ট্রাস্টের রিপোর্টও এ দিন প্রকাশিত হয়েছে। ‘ব্যাক টু স্কুল’ শীর্ষক আলোচনায় স্কুল শিক্ষার ‘ডিজিটাল ডিভাইড’-সঙ্কট নিয়ে উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ এ কে শিবকুমার, শিক্ষাবিদ অনীতা রামপাল বা সমাজবিজ্ঞানী জঁ দ্রেজেরা কথা বলছিলেন। আলোচনায় উঠে এল, অম্বেডকরের কথা। ভারতীয় সংবিধানের রচয়িতা বলেছিলেন যে, সাম্য, সমানাধিকার থাকলেও ভ্রাতৃত্ববোধ বড় কঠিন ব্যাপার। স্কুল থেকে বিচ্ছিন্নতার দিনে একটি মুসলিম বা দলিত পড়ুয়ার মনের অবস্থা পড়া কি আরও কঠিন হয়ে পড়বে না? যেন সেই ধরতাই ছুঁয়েই স্কুল শিক্ষায় দেশের সুবিধাভোগী ও সুবিধাবঞ্চিতদের মধ্যে বিভেদ, বৈষম্য থেকে আজকের ভারতের আরও বৃহত্তর ভাঙনের গল্পে ঢুকে পড়লেন অমর্ত্য। তাঁর কথায়, “স্কুল ব্যবস্থা ভেঙে পড়া বা ভাল স্কুল না-থাকা বিরাট সঙ্কট। তা গোটা দেশের জন্যই সম্ভাব্য বিপর্যয়। কিন্তু আমার সব থেকে বড় ভয় অন্য।” অমর্ত্য বলেন, “গোটা দেশেই ভাঙনতন্ত্র চলছে। বিভাজনের হুমকিকে ভয়ের কারণ আছে। স্কুলপাঠ্য রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, কবীর, দাদূ বা তুলসীদাসের পথ থেকেও আমরা দূরে সরে আসছি।”

এই সঙ্কটে তাঁর শৈশবের কিছু নির্মাণের কাছে ‘হাত পেতেছেন’ প্রবীণ অর্থনীতিবিদ। শান্তিনিকেতনে মোহনদাস গান্ধীর সই নিতে গিয়েছিলেন বালক অমর্ত্য। গান্ধী তখন সইয়ের বিনিময়ে অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য পাঁচ টাকা নিতেন। বড়দের কাছ থেকে টাকা নিয়ে গান্ধীকে দেওয়ার পরে তিনি খাতায় সই করে বলেন, “আজ থেকে অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে তোমার লড়াই শুরু হল।”

ঢাকায় অমর্ত্যের পিতামহ সারদাপ্রসাদ সেন পারিবারিক বাসগৃহের নাম রাখেন ‘জগৎ কুটীর’! যার খোলা জানলায় গোটা জগতের আবাহন। আর মাতামহ ক্ষিতিমোহন সেন হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত সাধনার মন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছিলেন। অমর্ত্যের কথায়, “এ দেশের সাহিত্য, স্থাপত্য, চিত্রকলা, গানবাজনা, নাচ সবেতেই এই যুক্ত সাধনা। তাজমহল থেকে রবি শঙ্কর, আলি আকবর খানের সৃষ্টি— একই বিষয়! ভারত শুধু হিন্দুদের নয়! সবাইকে নিয়ে চলাই আমাদের ঐতিহ্য।”

এই সভায় উপস্থিত শিক্ষকদের মধ্যে থেকে উৎকণ্ঠা শোনা গেল, কিন্তু স্কুলের পাঠ্যক্রমেই তো এই যৌথতার ইতিহাস ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে! প্রশ্ন শুনে দৃঢ় প্রত্যয়ী স্বরে অমর্ত্য বললেন, “ইতিহাস তো সত্যের কথা বলে। মিথ্যের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে/ তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে!” অমর্ত্যের আক্ষেপ, “স্বাধীনতার আগে আত্মীয়েরা অনেকে প্রায়ই জেলে যেতেন। শুনেছিলাম, দেশ স্বাধীন হওয়া অবধি এমন চলবে। স্বাধীন হওয়ার পরেও যে চলবে, তা জানা ছিল না।” দেশ জুড়ে ভাঙনের অপচেষ্টা বন্ধ করার চটজলদি মুশকিল আসান তাঁর কাছে নেই। তবে অমর্ত্য বলেন, “ভাঙন থেকে মুক্তি পেতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে নামতে হবে।” প্রবীণ চিন্তাবিদের সরস সংযোজন, “আমার ৮৮ হল। এখন পড়ে গিয়ে ভাঙলে দুর্ভোগ। তাই চিন্তার যথেষ্ট কারণ আছে!”

নিজের নামে রিসার্চ সেন্টারটি নিয়েও খানিকটা অস্বস্তি কবুল করেছেন অমর্ত্য। প্রতীচীর ম্যানেজিং ট্রাস্টি অন্তরা দেব সেন জানান, সল্টলেকে অমর্ত্য সেনের চিন্তা ও দর্শনের স্মারক এই কেন্দ্রটি একটি গ্রন্থাগার, আলোচনা সভা, প্রেক্ষাগৃহ নিয়ে পথ চলা শুরু করল। এসেছিলেন রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। অমর্ত্য বলেন, “এই উদ্যোগের নামটা আমার জন্য আতঙ্কের (টেরিফাইং)! তবে মনে হয় কলকাতার বৃহৎ যোগের সমন্বয়ের ঐতিহ্য এখানে বজায় থাকবে।”

Amartya Sen Democracy
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy