Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
Manipur Violence

মিথ্যার ভিত্তিতে রক্তপাত! জাতিগত হিংসা কেবল মুখোশ, মণিপুর কি জ্বলছে পপি বনাম পাম তেল যুদ্ধে

কুকিদের একাংশের দাবি, লড়াইয়ের গোপন কারণ হল পপি বনাম পাম চাষের যুদ্ধ। কেন্দ্র দ্বারা চিহ্নিত জমি রাজ্য সরকার বিজেপি ঘনিষ্ঠ একাধিক ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া চেষ্টা করছে।

Manipur Violence.

অশান্ত মণিপুরে জ্বলছে ঘরবাড়ি। ছবি: পিটিআই।

রাজীবাক্ষ রক্ষিত, প্রেমাংশু চৌধুরী
গুয়াহাটি ও নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০২৩ ০৬:৫০
Share: Save:

অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে সংসদে আলোচনার সময় বিরোধী দলগুলির জোট ইন্ডিয়া মণিপুরের হিংসা নিয়ে বিজেপিকে পেড়ে ফেলতে মোটামুটি কোমর কষছে। উল্টো দিকে বিজেপিও তৈরি। গৈরিক তূণীরে গোপনে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে একের পর এক তির সাজানো চলছে। বিজেপি সূত্রে দাবি করা হচ্ছে মণিপুরের পাহাড়ে আফিম চাষের রমরমার সূত্রপাত কংগ্রেসের আমলেই। সেই সঙ্গে গন্ডায়-গন্ডায় কুকি জঙ্গি সংগঠনকে সংঘর্ষবিরতিতে এনে পাহাড়ে ভোটব্যাঙ্ক তৈরির পরম্পরাও কংগ্রেসের তিন দফায় সরকারেরই অবদান। তাই মণিপুরে গত তিন মাস ধরে যে মেইতেই বনাম কুকি সংঘর্ষ চলছে, তার দায় বিজেপি নয়, কংগ্রেসেরই।

উল্টো দিকে কংগ্রেসের যুক্তি, তারাই মণিপুরের বিধানসভায় বারবার মাদকের বিরুদ্ধে অভিযানের দাবি করেছে। গত মার্চ মাসে মণিপুরের বিধানসভায় মাদক-বিরোধী অভিযানে সর্বসম্মতিতে প্রস্তাব পাশ হয়। তাতে সব দল সমর্থন জানিয়েছিল। কংগ্রেসের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওক্রাম ইবোবি সিংহ সেই প্রস্তাব সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু বিজেপির এন বীরেন সিংহের সরকার মেইতেই বনাম কুকি বিভাজন তৈরি করে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা করছে। মাদকের বিরুদ্ধে পপির চাষের বিরোধী অভিযান চালাতে গিয়ে কুকিদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়েছে। তাঁদের পাহাড় থেকে উচ্ছেদের চেষ্টা হয়েছে। সর্বোপরি, সেখানে মোদী সরকার ঘনিষ্ঠ শিল্পগোষ্ঠীকে পাম চাষের জন্য জমি বিলি করতে চাইছে মণিপুরের বিজেপি সরকার।

গত তিন মাস ধরে মণিপুরে কুকি বনাম মেইতেইদের সংঘর্ষের পিছনে পপি খেত ধ্বংস ও পাহাড়-জঙ্গলের জমি পুনরুদ্ধারের যে কারণ দেখানো হচ্ছে, তার সঙ্গে এই নতুন তত্ত্বও ছড়িয়ে পড়েছে রাজ্যে। কুকিদের একাংশ দাবি করছে, লড়াইয়ের গোপন কারণ হল পপি বনাম পাম চাষের যুদ্ধ। মোদী সরকার মণিপুরে ৬টি জেলায় ৬৭ হাজার হেক্টর জমি পাম তেল উৎপাদনের জন্য চিহ্নিত করেছে। ওই জমি রাজ্য সরকার বিজেপি ঘনিষ্ঠ একাধিক ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। কয়েক হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের জন্যই জোর করে জনজাতি এলাকায় জমি দখল করতে চাইছে বিজেপি সরকার।

বিষয়টি নিয়ে দুই রকম বয়ান জটিলতা বাড়িয়েছে। রাজ্যের তথ্য কমিশনার ওইনাম সুনীল বলেন, “সব ভিত্তিহীন। কোনও গোষ্ঠীই চুক্তি করতে আসেনি।” কিন্তু গোদরেজ সংস্থার কর্তারা জানান, গত বছরই রাজ্যের ৭টি জেলায় পাম বীজ চাষের জন্য সরকারের সঙ্গে তাঁদের চুক্তি হয়েছে। জেলাগুলি হল, জিরিবাম, পশ্চিম ইম্ফল, থৌবাল, বিষ্ণুপুর, উখরুল, চাণ্ডেল, চূড়াচাঁদপুর। রাজ্য অয়েল পাম মিশনের উপদেষ্টা এম এস খাইদেম বলেন, “জিরিবামের ৭১৫৫ হেক্টর জমিতে ইতিমধ্যে চাষ শুরুই হয়ে গিয়েছে। গোদরেজ সংস্থাই উৎপাদিত পাম কিনে নেবে। প্রথম পাঁচ বছরের জন্য ভর্তুকি দেবে সরকার। চাষ শুরু হলে কৃষকদের অনেক বেশি রোজগার হবে।” চুক্তি অনুযায়ী, কুকি অধ্যুষিত চূড়াচাঁদপুর পাম চাষের আওতায় পড়ছে। তবে উখরুল নাগা অধ্যুষিত এলাকা। বাকিগুলি মূলত মেইতেই অধ্যুষিত।

মণিপুরের বিজেপি সরকারের দাবি, উচ্ছেদ চালানোর সময়ে কোনও একটি গোষ্ঠীকে নিশানা করা হয়নি। অরণ্য ও পরিবেশ সংরক্ষণের জন্যেই এই কাজ হাতে নেওয়া হয়েছিল। বীরেন বলেন, ‘‘যা করেছি ভালর জন্যেই করেছি। মিথ্যের উপরে ভিত্তি করে রক্তপাত চলছে। চলছে রাজ্য ভাঙার চক্রান্ত। আমরা তা হতে দেব না। তদন্ত কমিশন গঠন হয়েছে। আশা করি প্রকৃত সত্য সামনে আসবে।’’ বিজেপির বক্তব্য, এত দিন রাশ না টানায় মাত্র ২৮ লক্ষ জনসংখ্যার রাজ্যে প্রায় দেড় লক্ষ যুবক-যুবতী আজ মাদকাসক্ত। সঙ্গে রাজ্যে লাফিয়ে বাড়ছে এডস। বিজেপির দাবি, কংগ্রেস মাদক চাষ অবাধে করতে দিয়েছে। তার কমিশন নিয়েছে। কুকি জঙ্গিদের সংঘর্ষবিরতিতে রেখে মাদক চাষে উৎসাহ দিয়েছে ও কুকি এলাকায় ভোট ব্যাঙ্ক অটুট রাখতে সাহায্য নিয়েছে।

কংগ্রেসের অভিযোগ, কারণ যা-ই হোক, বিজেপি আসলে মণিপুরে গোটা দেশের মতো বিভাজনের রাজনীতি করতে চেয়েছিল। তারই ফলে তিন মাস ধরে হিংসা চলছে। আসাম রাইফেলস, মণিপুরের পুলিশ বাহিনীর মধ্যে পর্যন্ত মেইতেই বনাম কুকি বিভাজন হয়ে গিয়েছে। বারবার নিরাপত্তা বাহিনীর অস্ত্র লুট হচ্ছে। কংগ্রেসের প্রধান মুখপাত্র জয়রাম রমেশ বলেন, “সুপ্রিম কোর্ট ১ অগস্টই বলে দিয়েছে, মণিপুরে সাংবিধানিক ব্যবস্থা, আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। তবু প্রধানমন্ত্রী চুপ এবং ব্যর্থ মুখ্যমন্ত্রীকে গদিতে বসিয়ে রেখেছেন।” সিপিআইয়ের জাতীয় সম্পাদক পল্লব সেনগুপ্ত বলেন, বিজেপি আসলে মণিপুরেও বিভাজনের রাজনীতি করে ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিল। ইম্ফলে সিপিআইয়ের রাজ্য পরিষদের বৈঠক সেরে রবিবার পল্লব বলেন, ‘‘এখন শান্তি ফেরাতে কুকি ও মেইতেইদের মুখোমুখি বসাতে হবে। তাই বিধানসভার অধিবেশন খুব জরুরি। সেখানে কুকি বিধায়কেরা এসে তাঁদের ক্ষোভের কথা জানান। বিধানসভায় আলোচনা করেই সমাধান সূত্র খুঁজতে হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

BJP Congress Manipur
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE