রাস্তা থেকে ঘোড়ার খুরে খুরে, রাঙা ধুলোয় মেঘ উড়িয়ে আসেন তিনি! আসেন টগবগিয়ে রাঙা ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে। রবি ঠাকুরের কবিতা থেকে উঠে আসা বীরপুরুষ যেন!
অশ্বারোহী যুবরাজের দেখা পেলেই পিছনে দৌড়তে থাকে সহপাঠীরা। এ দুনিয়ায় দীর্ঘ আটটা বসন্ত কাটিয়ে ফেলা মানুষটামেজাজে যেমন রাজা, তার বাহনের নামও তা-ই!
অসম-মেঘালয় সীমানায় থাকা দক্ষিণ কামরূপে বরবকড়া গ্রামের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র যুবরাজ রাভা আর তার ঘোড়া রাজা এখন সমাজমাধ্যমে ভাইরাল! মাত্র আট বছরের ছেলের এমন টগবগিয়ে স্কুলে আসা, ঘোড়াকে অনায়াস দক্ষতায় ‘পার্ক’ করে, দপদপিয়ে ক্লাসে ঢোকার ছবি তো হামেশা চোখে পড়ে না!
দক্ষিণ পান্তান জনজাতীয় মধ্য ইংলিশ স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র যুবরাজ অবশ্য কখনও ভাবেনি, তার স্কুলে পড়তে আসার সাধারণ ঘটনা এমন সাড়া ফেলবে। কারণ বাইরের লোকের কাছে যা অভিনব, সেটাই যুবরাজের দরিদ্র পরিবারে অনন্যোপায় বাধ্যবাধকতা। অসমান পাহাড়ি পথ আর কাদামাখা রাস্তা মিলিয়ে চার কিলোমিটার পথ আগে বাবার সঙ্গে হেঁটেই যাতায়াত করত সে। কিন্তু ধারদেনা করে বাবা ব্যবসায় মাল টানার জন্য এক টাট্টু ঘোড়া কেনেন। ছেলের নাম যুবরাজ, তাই ঘোড়ার নাম তিনি রাখেন রাজা।
কিন্তু ঘোড়াকে কাজে লাগাবেন কী, ছেলে যে তাকে কাছছাড়া করে না! ঘোড়াও ছেলেকে চোখে হারায়। ঝটপট ঘোড়ায় চড়া শিখে নিয়েছিল যুবরাজ। এখন তো তাদের জুটিকে রাণাপ্রতাপ আর চেতকের সঙ্গে তুলনা করে সকলে। কোনও কোনও দিন ঘোড়াকে বাড়িতেই রেখে আসে সে। কিন্তু স্কুল ছুটির আগেই রাস্তা চিনে রাজা পৌঁছে যায় স্কুলে।
যুবরাজের ঘোড়ায় করে স্কুলে আসার ভিডিয়ো দেখে সম্প্রতি স্থানীয় এক ব্যবসায়ী তাকে নতুন সাইকেল, একটা ফুটবল, ৫০০০ টাকার চেক আর নতুন স্কুলব্যাগ উপহার দেন। যুবরাজের পরিবারকে আশ্বস্ত করেছেন যে, ভবিষ্যতেও তিনি ছেলের শিক্ষায় সহায়তা করবেন।
আজ শিক্ষক দিবসের অনুষ্ঠানের পরে স্কুলের প্রধান শিক্ষক নগেন চন্দ্র দাস ফোনে বলছিলেন, “যুবরাজ আসলে জীবনসংগ্রাম চালিয়েও হারতে না শেখা এই এলাকার পরিবারগুলোর প্রতীক হয়ে উঠেছে। বছরের পর বছর এখানকার অনুন্নয়ন নিয়ে কেউ মাথা ঘামাতেন না। কিন্তু রাজা ও যুবরাজের যৌথ অভিযানে এখন আলো পড়ছে আমাদের উপরেও।”
সহকারী শিক্ষক হৃদয় ডেকার কথায়, “এখানকার প্রত্যন্ত গ্রামে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও মৌলিক সুবিধাগুলির বড় অভাব। বহু আবেদন জানিয়েও রাস্তাঘাটের উন্নতি হয়নি। হয়তো এ বার, আমাদের অশ্বারোহী ছাত্রের সৌজন্যে সুদিন এলেও আসতে পারে।”
যদিও, দিন বদলের সম্ভাবনা, নতুন সাইকেল, ফুটবল, হঠাৎ পাওয়া ৫ হাজার টাকার চেক, এই কোনও কিছুই টানে না ছোট্ট ঘোড়সওয়ারকে। তার নেশা শুধুই তেপান্তরের পাথার পেরোনো। অবশ্য গল্প সত্যি হওয়ার আশায় বুক বাঁধা পাড়ার লোকে বলছে, ভাগ্যে ঘোড়া সঙ্গে ছিল খোকার। এ দুর্দশা কাটত না, তা না হলে!
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)