জিএসটি কমানো নিয়ে প্রচারের ঢাকে কাঠি পড়ে গিয়েছে ঠিকই। কিন্তু দেবীপক্ষের গোড়া থেকে জিএসটি-র হার কমলে সত্যিই যাতে জিনিসপত্রের দাম সেই অনুযায়ী কমে— তা নিশ্চিত করতে এখন মোদী সরকারের কালঘাম ছুটছে। মোদী সরকার চাইছে, কোনও ১০০ টাকা দামের জিনিসে জিএসটি-র বোঝা ১০ টাকা কমলে, তার দাম যেন ১০ টাকাই কমে। শিল্প সংস্থা মাত্র ৩ টাকা দাম কমিয়ে বাকি ৭ টাকা যেন মুনাফা হিসেবে নিজের পকেটে না ভরে।
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন, বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গয়াল এ বিষয়ে শিল্পমহলের সঙ্গে দৌত্য ও তাদের আশ্বাসের উপরেই ভরসা করছেন। কিন্তু বিরোধী শিবিরের অভিযোগ, কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত ছিল, মুনাফা লোটা ঠেকাতে জিএসটি আইন মেনে মুনাফাখোরি প্রতিরোধ সংস্থা তৈরি করা। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর প্রধান মুখ্য উপদেষ্টা অমিত মিত্রের অভিযোগ, এ নিয়ে রাজ্যগুলির সঙ্গে কোনওরকম আলোচনাই করেনি মোদী সরকার। ফলে মুনাফা লোটা হলেও তা রোখার কোনও ব্যবস্থাই সরকারের কাছে নেই।
জিএসটি পরিষদে মোদী সরকারের প্রস্তাব অনুযায়ী নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য থেকে উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণের দামি জিনিসে জিএসটি-র হার কমানো হয়েছে। ২২ সেপ্টেম্বর থেকে নতুন জিএসটি-র হার কার্যকর হবে। সরকারের দাবি, জিনিসপত্রের দাম কমে বাজারে কেনাকাটা বাড়বে। কিন্তু দাম যে সত্যিই কমবে, তা কী ভাবে নিশ্চিত করা হবে?
নির্মলা সীতারামনের বক্তব্য, ‘‘যতখানি জিএসটি কমেছে, তার পুরো সুবিধাই যাতে শিল্পমহল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়, তা নিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। শিল্পমহল আশ্বাস দিয়েছে, পুরো সুবিধাই আমজনতার হাতে যাবে। জিএসটি-র হার কমানো অনুযায়ী দাম কমছে কি না, আগামী দেড় মাস কেন্দ্রীয় পরোক্ষ কর পর্ষদ সে দিকে নজর রাখবে।’’ পীযূষ গয়ালের দাবি, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকার নিশ্চিত করবে এবং কড়া নজর রাখবে। শিল্পমহল আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, জিএসটি কমার ১০০ শতাংশ সুবিধা মানুষ পাবে।’’
মুখে যা-ই বলা হোক, কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের অন্দরমহলের চিন্তা হল, শিল্পমহল বা বিমা সংস্থাগুলি জিএসটি কমার পুরো ফায়দা সাধারণ মানুষের হাতে তুলে দেবে না। কিছুটা মুনাফা রাখার চেষ্টা করবে। অতীতেও তাই হয়েছে। অমিত মিত্র রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের কমিটির প্রধান হিসেবে জিএসটি চালুর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন।তাঁর বক্তব্য, ‘‘কেন্দ্রের উচিত ছিল কেন্দ্রীয় জিএসটি আইনের ১৭১ নম্বর ধারা মেনে মুনাফাখোরি প্রতিরোধ সংস্থা তৈরি করা। জিএসটি পরিষদের সেই ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী এ নিয়ে কোনও আলোচনাই করেননি। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরোয়া না করে প্রধানমন্ত্রী আগেই লালকেল্লা থেকে জিএসটি কমানোর কথা ঘোষণা করে দিয়েছেন। এখন কেউ মুনাফা লুটলেও কোথাও সেই অভিযোগ জানানোর ব্যবস্থা নেই। শুধুমাত্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে চিন্তাভাবনা না করে কেন্দ্র কাজ করেছে।’’
জিএসটি চালুর পরে প্রথমে মুনাফাখোরি প্রতিরোধ সংস্থা তৈরি হয়েছিল। তাতে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার মুনাফাখোরির অভিযোগও জমা পড়েছিল। গত বছর কেন্দ্রীয় সরকার বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হয়েছিল, ২০২৫-এর ১ এপ্রিল থেকে আর এই ব্যবস্থা থাকছে না। তা ফিরিয়ে আনারও কোনও পরিকল্পনা নেই। কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের যুক্তি, এর ফলে ‘ইন্সপেকশন রাজ’ তৈরি হয়। ব্যবসার সহজ পরিবেশ নষ্ট নয়। রাজস্বসচিব অরবিন্দ শ্রীবাস্তবের বক্তব্য, ‘‘কেন্দ্রীয় পরোক্ষ কর পর্ষদের সঙ্গে রাজ্য সরকারও নজরদারি করবে, যাতে দাম কমবে। শিল্পমহলকেও বুঝতে হবে, দাম কমলে এবং তার ফলে বেচাকেনা বাড়লে তাদেরই লাভ।’’ বণিকসভা সিআইআই-এর ডিরেক্টর জেনারেল চন্দ্রজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমাদের দৃঢ় ধারণা, শিল্পমহল মানুষকে জিএসটি ছাঁটাইয়ের সুবিধা পৌঁছে দেবে যাতে বাজারেচাহিদা বাড়ে।’’
জিএসটি প্রশ্ন
কেন্দ্র চায়, জিএসটি কমানোর পুরো সুবিধাই যেন উপভোক্তা পায়
শিল্পমহলের আশ্বাস, নজরদারিতে ভরসা নির্মলা, পীযূষের
কিন্তু প্রশ্ন, মুনাফাখোরি প্রতিরোধ সংস্থা না থাকলে নজরদারি কি সম্ভব
'ইনস্পেকশন রাজের' যুক্তিতে এ বছর ১ এপ্রিল থেকে এই ব্যবস্থা উঠে যায়
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)