ভারতে এমন অনেক আইন রয়েছে, যেগুলিতে খুব ছোটখাটো কোনও ঘটনাকেও ফৌজদারি অপরাধ বলে বিবেচনা করা হয়। যেমন, রাস্তায় গরুর দুধ দোয়ানো বা পোষ্য কুকুরকে যথাযথ অনুশীলন না করানোর জন্য কাউকে গ্রেফতার পর্যন্ত করা যেতে পারে। আবার কোনও জরুরি গাড়িকে রাস্তায় পাশ না-দিলেও জেল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই ধরনের ছোটখাটো ঘটনাগুলি অনেক ক্ষেত্রেই আর ‘ফৌজদারি অপরাধ’ বলে গণ্য হবে না। এই ঘটনাগুলিকে ‘অপরাধমুক্ত’ করে শুধুমাত্র জরিমানার ব্যবস্থা করতে উদ্যোগী হয়েছে কেন্দ্র। সেই লক্ষ্যে সংসদের বাদল অধিবেশনে লোকসভায় জনবিশ্বাস (বিধি সংশোধনী) বিল, ২০২৫-ও পেশ করা হয়েছে।
কেন্দ্রের এই নতুন সংশোধনী বিলে ১০টি মন্ত্রক এবং দফতরের ১৬টি কেন্দ্রীয় আইন সংশোধনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এতে মোট ৩৫৫টি ধারার সংশোধনের উল্লেখ রয়েছে। এর মধ্যে ২৮৮টি ধারাকে ‘অপরাধমুক্ত’ করার কথা বলা হয়েছে। বাকি ৬৭টি ধারায় সংশোধনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে আরও সহজ করে তোলার জন্য। এর মধ্যে রয়েছে, মোটরগাড়ি আইন, নয়াদিল্লি পুরসভা কাউন্সিল আইন, চা আইন-সহ আরও বেশ কিছু আইনের বিধি। এই নিয়ে দ্বিতীয় বার সংসদে ‘জনবিশ্বাস বিল’ আনল কেন্দ্র। এর আগে ২০২৩ সালে পাশ হওয়া জনবিশ্বাস আইনে ১৯টি মন্ত্রক এবং দফতরের ৪২টি কেন্দ্রীয় আইনের ১৮৩টি ধারাকে ‘অপরাধমুক্ত’ করেছে কেন্দ্র। এ বার আরও ৩৫৫টি ধারায় সংশোধনের জন্য উদ্যোগী হয়েছে কেন্দ্র।
ভারতের সংশোধনাগারগুলিতে অনেক সময়েই অতিরিক্ত সংখ্যক আবাসিক রাখতে দেখা যায়। অর্থাৎ, কোনও সংশোধনাগারে যত জন বন্দিকে রাখার ব্যবস্থা রয়েছে, তার চেয়েও বেশি বন্দিকে রাখা হয়। তাঁদের মধ্যে অনেকেই বিচারাধীন বন্দি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আদালতও এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এ অবস্থায় ছোটখাটো অপরাধগুলির জন্যও কাউকে গ্রেফতার করা হলে, জেলে বন্দিসংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। খাতায় কলমে ফৌজদারি অপরাধের বিধান থাকলেও, সাধারণত এই ধরনের ছোটখাটো ঘটনায় তার প্রয়োগ কমই হয়। তা-ও ধারাগুলি পরিবর্তন না-হলে রাষ্ট্রের কাছে স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ খোলা থাকে। অনেকের মতে, এই ঘটনাগুলির ক্ষেত্রে অপরাধ এবং শাস্তির অনুপাত মৌলিক আইনি নীতির পরিপন্থী। এ বার পুরনো ধ্যানধারণার এই ধারাগুলিতে সংশোধন করতে চাইছে কেন্দ্র।
পাশাপাশি দেশের বিচার ব্যবস্থায় আগে থেকেই প্রচুর মামলার চাপ রয়েছে। প্রতিটি আদালতে বহু মামলা জমে আছে। সংবাদমাধ্যম ‘দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’-এর প্রতিবেদন অনুসারে, চলতি বছরের ২৪ অগস্ট পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জেলা আদালতে সাড়ে তিন কোটিরও বেশি ফৌজদারি মামলা বিচারাধীন ছিল। যার মধ্যে ২ কোটি ৩০ লক্ষেরও বেশি মামলা এক বছরের বেশি সময় ধরে চলছে। এ অবস্থায় দেশের বিচার ব্যবস্থার উপর থেকে ছোটখাটো ঘটনাকে কেন্দ্র করে মামলার চাপ কমানোর জন্যই ‘ফৌজদারি অপরাধ’-এর তালিকা থেকে কিছু ধারাকে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে।
কেন্দ্রের এই ভাবনার আভাস দু’বছর আগেই মিলেছিল। ২০২৩ সালে যখন প্রথম জনবিশ্বাস বিলটি পেশ করা হয়েছিল, তখনই বাণিজ্য মন্ত্রকের বিবৃতি এ বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছিল। বিবৃতিতে কেন্দ্র জানিয়েছিল, “ছোটখাটো ভুল-ত্রুটির জন্য যে ফৌজদারি বিধান রয়েছে, তা বিচার ব্যবস্থাকে বাধার মুখে ফলে। এর ফলে গুরুতর অপরাধের বিচার প্রক্রিয়ায় দেরি হয়ে যায়।” সেখানে আরও বলা হয়েছিল, বিচার ব্যবস্থার উপর থেকে অযথা চাপ কমানোর জন্যই এই বিল আনা হয়েছে। এর ফলে বিচার ব্যবস্থা আরও কার্যকর হয়ে উঠবে বলেও সে সময় জানিয়েছিল কেন্দ্র।
নতুন বিলে অনেক ধারায় প্রথম বার নিয়ম ভাঙায় ফলে শুধুমাত্র সাবধান করা হতে পারে। যেমন বর্তমানে ওজন পরিমাপের ক্ষেত্রে গরমিলের জন্য বর্তমানে প্রথম বারের অপরাধে এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। নয়া সংশোধনী বিল অনুসারে, এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে সতর্ক করে ছেড়ে দেওয়া হতে পারে। তার পরেও একই কারণে ধরা পড়লে জরিমানা-সহ শাস্তির বিধানের কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া এই বিল আইনে পরিণত হলে দেশের রাস্তাঘাটেও বেশ কিছু পরিবর্তন দেখা যেতে পারে। বর্তমানে যে ঘটনাগুলির জন্য ‘জরিমানা-সহ শাস্তি’র বিধান রয়েছে, সেগুলির অনেক ক্ষেত্রেই শুধুমাত্র জরিমানা করা হবে। সংবাদমাধ্যম ‘দ্য প্রিন্ট’ অনুসারে, নতুন বিলে হর্ন বাজানো নিষিদ্ধ কোনও এলাকায় অপ্রয়োজনে হর্ন বাজানোর ক্ষেত্রে প্রথমে সতর্ক করে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তার পরেও একই ঘটনা ঘটলে জরিমানা হতে পারে। বর্তমানে জরুরি যানবাহনকে রাস্তা না-ছাড়লে ছ’মাস পর্যন্ত জেল অথবা ১০ হাজার টাকা জরিমানা কিংবা উভয়েই হতে পারে। সংশোধনী বিলে এই ধরনের ঘটনা প্রথম বার ঘটলে জরিমানার কথা বলা হয়েছে। একই আইন বারবার ভাঙলে সেই ক্ষেত্রে কারাদণ্ডের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।